ডারউইন এর বিবর্তনবাদ সম্ভবত মানব ইতিহাসেও অন্যতম আলোচ্য এবং সমালোচিত তত্ত্বগুলোর একটি…আমরা কেউ যদি গ্যালিলিও,নিউটন,আইনস্টাইন এর তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করি তবে তাকে ডারউইন এর তত্ত্বকে তারো আগে স্বীকার করে নিতে হবে। কারন গতিসূত্র অথবা আপেক্ষিকতা যেখানে কাগজে হিসেব কষে প্রমান করতে হয়,সেখানে বিবর্তনবাদের সত্যতার প্রমান আমাদের প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়ানো।
তবে বিবর্তনবাদ বিতর্কের পেছনে ধর্মীয় কারন না যতটা ঠিক ততটা সম্ভবত মানুষের আত্মসম্মানবোধ!গাছে ঝুলে থাকা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীগুলোকে যেন মানুষ কোনোভাবেই নিজের পূর্বপুরুষ ভাবতে পারেনা। অথচ ‘ডারউইন’ সাহেবের তত্ত্বে মানুষ আর বানরের আত্মিক(!) সম্পর্কই আসলে মুল প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রসঙ্গ নয়,যুগান্তকারী এই গবেষনার প্রকৃত মহত্ব আরো অনেক গভীরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা এই মহাবিজ্ঞানীর সারা জীবনের সাধনার ফসলকে শুধু এই একটি প্রসঙ্গে এনেই অবমূল্যায়ন করে ফেলি।
ডারউইন যদি আর একটু চতুর হতেন তিনি হয়তবা বলতেন,মানুষ পাখিদের জাতভাই(সকল সৃষ্টিই একে অন্যের সাথে কোনোভাবে সম্বন্ধযুক্ত)। তখন মনে হয় তিনি তার পক্ষে অনেক মানুষকে পেয়ে যেতেন। কারন মানুষ সম্ভবত পাখি হতে সবচেয়ে বেশী ভালবাসবে, একথা অবলীলায় বলা যায়।
প্রানীজগতের শ্রেনীবিন্যাসে মানুষ আর পাখিদের অবস্থান বেশ দূরে হলেও প্রকৃতি তার এই অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টিটিকে মানুষের সাথে অন্যভাবে সম্পর্ক তৈরী করে দিয়েছে। তা হল বুদ্ধিমত্তায়।
কি অবাক হচ্ছেন? যদিও পাখিরা ঠিক আপনার মতো এত জটিল চিন্তা করতে পারেনা…কিন্তু তার চিন্তার পরিসীমা মানূষ ছাড়া অন্যান্য প্রাইমেটদের চেয়ে কোনো অংশে ফেলনা নয়।
এজন্য মনে হয় সাদা চোখে খুব বেশী দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমদের। গ্রামে বাবুই পাখির বাসা দেখেছেন তো? শিল্পের বড়াই তো শুধু তারই করা সাজে। কোথা হতে পেলো সে এতটুকু মাথায় এত বুদ্ধি? আগেই বলেছি,গল্প হয়ে না থেকে ঈশপের কাক নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে তার ক্ষমতার প্রমান দিয়ে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মানুষ আরো অবাক হয়ে দেখলো তাকে যখন বিভিন্ন আকারের নুড়িপাথর দেওয়া হয় সে পাত্রের সবচেয়ে তলানীতে ফেলার জন্য অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে বড় নুড়িটিই বেছে নেয়।
এতে তার কাজটি সহজ হয়ে যায় অনেক!শুধু পাত্র থেকে পানি খাওয়ায় কেনো…অন্যান্য হাতিয়ার ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানেও কাক জাতীয়(Corvids) পাখিরা বেশ পারদর্শী!
প্রাচীন চিনদেশের ইতিহাস থেকে জানা যায় সেখানে কৃষকরা মাছ ধরার জন্য পোষা পাখিদের ব্যবহার করত। কয়েকটি মাছ পানি থেকে তুলে আনার জন্য পাখিটি একটি করে মাছ উপহার পেতো। পরবর্তিতে ১৯৭০ সালে বিজ্ঞানী 'Pamela Egremont' এর গবেষনায় উঠে এলো পাখিদের গণনা করার অদ্ভুত ক্ষমতার কথা! তিনি দেখলেন গাংচিল জাতীয়(Cormorants) পাখিরা ‘আট’ পর্যন্ত গোনার ক্ষমতা রাখে। আপনি তাকে দিয়ে সাতটি মাছ ধরানোর পর তাকে কোনোভাবেই পরের মাছটি ধরার জন্য বাধ্য করতে পারবেনা না,যদিনা একটি পাখিটির নিজের জন্য বরাদ্দ না দেন!
পাখিদের শেখার ক্ষমতাও মানুষের মনে আশ্চর্যের জন্ম দেয়। টিয়া বা ময়না পাখিকে আমরা কথা বলতে যখন দেখি তখন আমরা আনন্দিত হই।
তবে একটু নজর দিলেই বুঝে ফেলি তারা আসলে না বুঝে বলছে। কিন্তু কার্টুন চরিত্র মিনা-রাজুতে আমরা যে বুদ্ধিমান টিয়াপাখি ‘মিঠু’ কে দেখেছিলাম সে কিন্তু একেবারে অবান্তর কোনো ধারনা নয়!গান গাওয়া পাখিরা নিজেদের মধ্যে নানা রকম গান(twit) দিয়ে কথা আদান-প্রদান করে। গল্পের টোনা-টুনিরা তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্যি!
আরো আছে,অন্যান্য প্রানীরা সাধারনত তাদের আক্রমনকারীদের গতি প্রকৃতি দেখে বুঝে যে কে তার শত্রু। তবে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে অনেক পাখিরা এখানে অন্যরকম। বাচ্চা পাখিদেরকে তাদের বাবা-মা শিক্ষা দেয় কোনটি তাদের শত্রু আর কে মিত্র।
পাখিদের এসব অদ্ভুত কীর্তির বর্ননার শেষে একটি তথ্য জেনে খুশি হবেন, আয়নায় নিজেকে চেনার ক্ষমতা পাখিদের মধ্যে শুধু আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের রয়েছে। খুব উচ্চশ্রেনীর ম্যামাল ছাড়া কিন্তু এই ক্ষমতা প্রানীজগতের আর কারো নেই।
শিম্পাঞ্জী,বেবুনদের চিন্তার ক্ষমতা(cognitive ability) থাকলেও আপনি যদি তাদের সাথে পাখিদেরটি মিলিয়ে ফেলেন তাহলে কিন্তু ভুল করছেন। এখানে যে জিনিষটি বিজ্ঞানীদের ‘হা হওয়া চোয়ালে’ ব্যাথা ধরিয়ে দিয়েছে সেটি হচ্ছে পাখিদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ‘সেরেব্রাল করটেক্স’ এর অনুপস্থিতি! তখন ওপারে বসে ডারউইন সাহেব নিশ্চই কিছুটা বিব্রত এবং বোকা বোকা মুখ করে ঈশ্বরের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং ঈশ্বর মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘Let’s see’। তবে এপারে ডারউইন এর সমালোচকরা যাযাপরনাই আনন্দিত হয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই।
ডারউইন এর শিষ্য জীববিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে দেখে এসেছেন বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রক হচ্ছে প্রাইমেটদের সেরেব্রাল করটেক্স, সেখানে এতটুকু মাথার টিকটিকির বংশধরেরা সেরেব্রাল করটেক্স ছাড়া এত চিন্তা করার সাহস পেলো কোত্থেকে?! ডারউইন এর শিষ্যরা অনেক গবেষনার পর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে পাখিদের মস্তিষ্কে উন্নত ‘ব্যাসাল গানগ্লিয়া’র(basal ganglia) সন্ধান পেলেন, এবং সিদ্ধান্তে আসলেন তাদের মস্তিষ্কের এই অংশটিই তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছে। কারন আমদের মস্তিষ্কেও ‘ব্যাসাল গানগ্লিয়া’ আছে। দেখা গেলো যাদের ব্যাসাল গ্যানগ্লিয়া সবচেয়ে বড় সেসব পাখিদের চিন্তার ক্ষমতাও(cognitive ability) বেশী।
ওপারে ডারউইন তো শিষ্যদের এই সফলতায় দারুন খুশি, ঈশ্বরকে মনে হয় সমুচিত জবাবটা দেওয়া যাবে এবার। কিন্তু তিনি দেখলেন…নাহ,ঈশ্বরের বাঁকা হাসিটা মুছেনি এখনো…এদিকে শিষ্যরাও দেখলেন, এই যুক্তি টিকছে না।
কারন, ব্যাসাল গ্যানগ্লিয়া পাখিদের সম্পুর্ন মস্তিষ্কের খুব অল্প স্থান জুড়ে আছে। তাছাড়া আধুনিক সিটি স্ক্যান,এম,আর,আই থেকে দেখা গেলো তারা চিন্তা করার সময় মস্তিষ্কের নানা অংশ সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছে। অবশেষে মানুষ পাখিদের চিন্তাশক্তির জন্য দায়ী Hyperstriatum ventral খোঁজ পেলো সম্প্রতি। দেখা গেল,টিয়া এবং কাক জাতীয় পাখিদের মস্তিষ্কের এই অংশটি উন্নত ম্যামালদের মতই একই অনুপাতে(brain and body ratio) আছে। এটিই পাখিদের চিন্তাশক্তির মূল নিয়ামক।
প্রতিবারের মত বিজ্ঞানেরই জয় হলো।
ডারউইন আপাতত বেশ খুশী মন নিয়ে ফিরে গেছেন। তবে কেন জানি ঈশ্বরের স্মীত হাসিটি মোছেনি।
কেন তা জানিনা…!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।