আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা কোন অমানিশার দিকে ধাবিত হচ্ছি ? নূরে আলম সিদ্দিকী:



আমরা যাচ্ছি কোথায়? সমগ্র জাতি সামগ্রিকভাবে প্রতিদিনে নয় প্রতি সেকেন্ডে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্তে তলিয়ে যাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রেই গোটা জাতি আজ একটি হতাশায় নিমজ্জিত। নির্বাচনের আর তিন মাস বাকি। এখন মানুষ ভাববে কে সরকার গঠন করবে, কি ধরনের কর্মসূচি থাকবে, কিভাবে আগামী পাঁচ বছরে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে? কিন্তু কি বুদ্ধিজীবী, কি সাংবাদিক, কি সুশীল সমাজ, কি ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক নিশ্চিত নয় সংঘাতবিমুক্ত, রক্তপাতহীন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা। দুঃখজনক হলেও এটা বাস্তব দেশটি দুটি মেরুকরণে বিভক্ত হয়ে গেছে।

সেখানে সহস্র ত্রুটি-বিচ্যুতি, দুর্নীতি ও নৈতিকতাহীনতা থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় কোন মেরুকরণের সম্ভাবনা প্রতিভাত হচ্ছে না। তাই আজ দুই শীর্ষ নেতৃতের চিন্তা চেতনায়, বাদ-প্রতিবাদে একটি বিষয়ই প্রতিফলিত হচ্ছে- ক্ষমতার প্রতি তাদের অমোঘ মোহ, আকর্ষণ এবং একজন আরেকজনকে সরাসরি প্রতিহিংসাপরায়ণতায় আক্রমণ করা। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতেও নির্বাচন আসন্ন। যেটি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ এবং নানা দল-মত-বর্ণ-গোত্রে বিভক্ত; আমাদের দেশের মতো হোমোজিনাস নয়। কিন্তু আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করেছি সেখানে গণতন্ত্রের যে একটা ঐতিহ্য সেটা ক্রমেই তার ভিত্তি, বেদিমূলকে শক্ত করছে, পাদপীঠকে শক্ত করছে।

এক একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক একটি নতুন ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। যে সোনিয়া গান্ধী সংসদীয় দলের দ্বারা নির্বাচিত, বর্ষীয়ান নেতা জ্যোতি বসু কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়ে অনুরোধ করলেন, সমস্ত দেশ ধরে নিয়েছিল সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কিন্তু একটা আপত্তি উঠেছিল। সেই আপত্তিটা হচ্ছে একজন বিদেশিনী (ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত) ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে না। শারদ পাওয়ার এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও।

সোনিয়া গান্ধী রাষ্ট্রভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন, সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি কি?। একটা অদ্ভুত প্রজ্ঞা প্রদীপ্ত হাসি দিয়ে মনমোহন সিংকে দেখিয়ে বললেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করুন। সবাই স্তম্ভিত, হতবাক। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে জনমতের প্রতি যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন, এমনকি শারদ পাওয়ারকে তিনি আবার পুনর্বাসিত করেছেন রাজনীতিতে, সোনিয়া গান্ধীর এ দূরদর্শিতা শুধু তার মহত্ত্বকেই প্রকাশ করেনি বরং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভাব ও মূর্তিকে বিশ্বজুড়ে প্রজ্জ্বলিত করেছে। কিন্তু আমাদের এই ‘দুই নেত্রী’র দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই আমিত্বর অহংবোধের পরিমণ্ডল থেকে দু’জনের কেউ বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

সবকিছুর উপরে জাতি, দেশ, অর্থনীতি, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র। এর সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওদের হৃদয়ের মানচিত্রে লেখা আমিত্ববোধ এবং সেই আমিত্ববোধটি হচ্ছে ক্ষমতার প্রতি অনবদ্য আকর্ষণ, সেই আমিত্বটির পেছনে অর্থনৈতিক লিপ্সা। রাজনৈতিক দল তো নিঃসন্দেহে কোন আশ্রম নয়। রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় আরোহণ করে এসে তার দলীয় কর্মসূচির আলোকে দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। সরকারে এলে পূর্ব সরকার যা যা বলেন, যা যা করেন তিনি সুবোধ রমণীর মতো একই সুরে কথা বলেন, একই কাজ করেন।

আবার সরকার থেকে বিরোধী দলে গেলেও পূর্বের বিরোধী দলের কর্মসূচিকে তিনি অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। এ এক অভিনব খেলা এবং এ খেলার শিকার দেশের আপামর জনগণ। একজন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোন ব্যবস্থাকে মেনে নেবেন না, আরেক জন দম্ভ করে বলছেন, পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলেও, সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলেও, গিরিশৃঙ্গমালা খচিত হিমালয় ভারত মহাসাগরে বিলীন হয়ে গেলেও তিনি অনির্বাচিত র্নিদলীয় সরকার মেনে নেবেন না। পৃথিবীতে এমনও গণতান্ত্রিক দেশ আছে যেখানে গণতন্ত্র স্থায়ীত্ব লাভ করেছে, যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, যেখানে গণতন্ত্র গণতান্ত্রিক ধারায় চলছে সেখানে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এ পরাজয়ের মুখে সব দায়দায়িত্ব আপন স্কন্ধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীই স্বপ্রণোদিত হয়ে পদত্যাগ করতেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায়শ বলছেন, অন্য কোন দেশে তত্ত্বাবধায়কের তো দরকার হয় না।

অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীই তো নির্বাচন করেন। কিন্তুু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অবকাঠামোয়, সংসদে, দলের মধ্যে, চিন্তা চেতনার মধ্যে কি সেই পরিবেশ আছে? প্রধানমন্ত্রীর এই দাবিটা নিরর্থক, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরে আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করি যে, কি একটা অদ্ভুত আবদার তারা করে বসেছেন এবং লক্ষ্য করছি, ধীর পায়ে অন্ধকার অমানিশা যেমন পৃথিবীটাকে গ্রাস করে, তেমনি নির্বাচন কমিশন সরকারের ইঙ্গিতে সেই দিকে এগোচ্ছে- দলের থেকে মনোনয়ন না পেলে তিনি আর বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবেও দাঁড়াতে পারবে না। পৃথিবীর আর একটা দেশে এটা আছে এই উদাহরণ যদি দিতে পারেন তাহলে আমি যে কোন শাস্তি নিতে রাজি আছি। এমনিতেই ফখরুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা নিয়ম করে গেছে যে কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়াতে হলে অগ্রিম দশ পার্সেন্ট লোকের সাক্ষরযুক্ত আবেদন লাগবে।

শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকারের ধারা অনুযায়ী (যে কোন লোক তার নির্বাচনী অংশগ্রহণে অযোগ্যতার আওতার বাইরে হলে) স্বতন্ত্র নির্বাচন করার অধিকার তার আছে। এটাই তো একটা ইনডিকেশন। এ দেশে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয় বরং নিয়ন্ত্রিত। পৃথিবীর কোথাও গণতান্ত্রিক অবকাঠামোয় এত বড় স্বেচ্ছাচার আছে কিনা আমার সন্দেহ। আমি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কটাক্ষ করছি না, ১৯৮১ সাল থেকে ২০১৩, ৩২ বছর ধরে কি চায়না, কি রাশিয়া, একমাত্র কিউবা আর মধ্যপ্রাচ্যের দু-একটি দেশ ছাড়া ৩২ বছর ধরে একটি দলের পদ, তাও আপন যোগ্যতায় নয়, কেউ উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে, কেউ স্বামীর জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন, কিন্তু ওটি আর ছাড়াছাড়ির কোন নাম নেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কাউন্সিল আহ্বান করে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে কামরুজ্জামান সাহেবকে সভাপতির পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান আমল থেকেই এই যে আমলাতান্ত্রিক এবং সামরিক দৌরাত্ম্যের যাঁতাকলে সমগ্র জাতি পিষ্ট হলো তার কারণ হচ্ছে ভারতের মূল যিনি নেতা, মহাত্মা গান্ধী, তিনি ঋষির জীবন গ্রহণ করলেন। আর ভারতের কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হলেন, মাউন্টব্যাটেনকে তার স্বপদে গভর্নর জেনারেল পদে বহাল রাখলেন। আর পাকিস্তানের যিনি মূল স্থপতি, জিন্নাহ সাহেব, তিনি গভর্নর জেনারেল হলেন। ফলে ওখান থেকেই সামরিক এবং বেসামরিক চক্রের যে একটা অবতারণার সৃষ্টি হলো সেই পাকিস্তানেও কিন্তু আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো।

এই সামরিক এবং প্রশাসনিক বলয়ের মধ্যেও নিঃসঙ্কোচে একটি জিনিস তুলে ধরা যায়, পাকিস্তানে বিচার বিভাগ অকুতোভয়ে সত্যটিকে তুলে ধরতে দ্বিধাবোধ করেনি। জাস্টিস কাইনী, বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী, বিচারপতি মুর্শেদ এবং বিচারপতি ইব্রাহিম ঘোরতর স্বৈরাচারের যুগে বিচারবিভাগের গৌরবকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু আমাদের একটা সেক্টর এখানে নেই যে সেক্টরে আমরা নির্ভর করতে পারি, যে সেক্টর দলীয় পরিমণ্ডলের প্রভাব বিমুক্ত। সেটা বিচার ব্যবস্থা বলুন, প্রশাসন বলুন, এটা কিন্তু সত্যিকার অর্থে দলীয়করণের এই যে প্রবণতা, দুর্নীতির এই যে মহামারী রূপ এটা শুরু হয়েছিল ২০০১-এর পর থেকে বিকটভাবে, প্রকটভাবে। কিন্তু তার পরে যারা ক্ষমতায় এলেন তারা এটাকে তো রোধ করলেনই না বরং মহামারী আকারে ছড়িয়ে দিলেন।

হয়েছিল বন্যা, বানিয়ে দিলেন সিডর। যে দিনটিই যাচ্ছে মনে হচ্ছে গত দিন বোধহয় দুর্নীতি আজকের দিনের চেয়ে কম ছিল। এখন এসে গিয়েছে পার্সেন্টেজ। এখন আর কেউ ঘুষ চায় না। যে কোন কাজ পেতে হলে মূলধনের একটা পার্সেন্টেজ দিতে হবে (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।

আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, ব্যক্তিগতভাবে বার বার এ কথাটি বলি আমি। এই দুই নেত্রী মনে করেন আমি কটাক্ষ করি, আমি সমালোচনা করি। কিন্তু আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মায়েদের ডাক দিয়েছিলাম তার সন্তানদের রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। আমি বৈধব্যের যন্ত্রণায় কাতর বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, যেদিন তোমার ত্যাগের বিনিময়ে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে সেদিন হবে তোমার পাওনা।

আমার যে বোনটি ধর্ষিতা তার করুণ আর্তনাদের মুখে তাকে বলতাম, স্বাধীনতার সূর্য উঠলে তার বিকীর্ণ অগ্নিকণায় মুছিয়ে দেবো তোমার মুখের উপরে ছড়ানো থুতু। যদি আজকের প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মকে প্রশ্ন করে কেন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তোমরা? তখন কণ্ঠ আমাদের রুদ্ধ হয়ে যায়, বিবেক আমাদের নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তেতাল্লিশ বছরেও যে দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নি, কি দলে, কি সংসদে, তবে সেদিন কি আমরা মরীচিকার পেছনে ছুটেছিলাম? আজ আমরা কোন অমানিশার দিকে ছুটে চলেছি? সৌজন্যে মানবজমিন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।