,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,
‘আপনার আজকের ভর সংখ্যা ৬।
ব্যবসায়িক লেন-দেনের ক্ষেত্রে সামান্য বাধা আসলেও সপ্তাহান্তে বৃহস্পতি গ্রহের শনি বলয় মুক্তি উপলক্ষে পাওনা টাকার পুরোটাই ফেরত পাবেন।
প্রেমের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পাবেন।
রোমান্স শুভ। ’
সকালে চা খেতে খেতে পেপার খুলেই রাশিচক্রের এমন ফলাফল দেখলে কার না ভাল লাগে।
কিন্তু এই রাশি গণনাতে একটা বিশাল খটকা আছে। ধরুণ একজন চাকরীজীবি- তার তো ব্যবসায়িক লেন-দেন শুভ হবার কথা নয়। আবার ধরা যাক এক ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধের কথা- তার তো রোমান্স শুভ হবার কথা নয়। কাজেই বেকার লাইফে মধ্যরাতের তন্দ্রা ভেঙ্গে মাঝদুপুরে উঠে চায়ের কাপের সাথে পেপারের পাতা উল্টানোর সময় রাশি গণনার অংশটা পড়লেও তা কখনোই বিশ্বাস করিনা। আর এতে বিলিভ করা বুঝি উচিতও নয়।
এখন তো আর সেই দিন নেই যে মানুষ ঈশান কোনে মেঘের অস্তিত্ব দেখে ঝড় আসার শংকায় দেবতা উদ্দেশ্যে পূজো দিবে। এখন ক্যাট্রিনা আর নার্গিসের নিশ্চিত খবর পেলে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে দৌড়ায়। কাজেই অদৃশ্যের মাঝে অলৌকিকতার অস্তিত্ব বুঝি না খোজাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বেকারত্বের বিড়ম্বনা ঘুচাতে ভাগ্যদেবীর কৃপা মনে মনে কামনা করলেও আমার দুপুর কাটে জার্মানীতে জার্নাল পাবলিশিং এর জন্য পাঠানো পেপারের রিভিউ চেক বা কোন কোম্পানীতে অনলাইন সিভি ড্রপ করার মত প্র্যক্টিক্যাল কাজ করতে।
পিসিতে কাজ করতে করতে এক সময় ইলেক্ট্রিসিটি তার চরম সময় নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে পালায় আর আমি গরমের হাত থেকে বাচতে ছুট লাগাই পলাশী বা ধানমন্ডির আমার আড্ডার আসরে।
বাসা থেকে বের হবার সময় আম্মুর করা প্রতিদিনের সেই এক প্রশ্ন, ‘কই যাস? কখন ফিরবি?’ আমারও আম্মুকে হতাশ করা সেই এক উত্তর, ‘এই তো আম্মু, একটু বাইরে যাচ্ছি। বেশীক্ষণ লাগবে না। এক-দুই ঘন্টার মধ্যেই চলে আসব। ’ কিন্তু মানিব্যাগ যেদিন গড়ের মাঠে পরিণত হয় সেদিন আর এভাবে পার পাওয়া যায় না। সেদিন আম্মুকে সবকিছু ডিটেইস বলে, বাসায় ফেরার টাইমের ব্যপারে মুচলেকা দিয়ে বের হতে হয়।
এখন ভাবি ছাত্র অবস্থাই হয়তো ভাল ছিল, বিশ টাকার নোট ফটোকপি করে বলতাম- দুশো টাকা খরচ হয়েছে। বাসে করে ভার্সিটিতে যেয়ে বলতাম, আজ সি.এন.জি’ওয়ালা ভাড়া নিয়েছে একশ টাকা। অথচ সেই সময়ে কেবলই ভাবতাম- কবে যে গ্রাজুয়েশনটা শেষ হবে। কবে যে এই বাধাধরা লাইফের ইতি ঘটবে। কিন্তু কথায় আছে না- ‘নদীর এপার কয় ছাড়িয়ে নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
’
আগে একটা শুক্রবার পাবার অপেক্ষায় সারা সপ্তাহ লাফিয়ে লাফিয়ে পার করে দিতাম আর স্পেশাল দিনে পাওয়া এক্সট্রা ছুটিগুলো নিয়ে আসত ঈদ-আনন্দের উপলক্ষ। সেই ছুটিগুলোর কোনটাতে চলে যেতাম পদ্মার চরে সোনারগায়ে। আজীবনের খোকা-পাগলা টাইপের ফটোগ্রাফার বন্ধুদের সাথে মেতে উঠতাম ছবি তোলার উৎসবে। আবার কোনটাতে চলে যেতাম স্টার-কাবাব, নান্না, রয়েল কিংবা হাজীর বিরিয়ানীতে। ভোজনরসিক-পেটুক বন্ধুদের সাথে বেটন রোজ’এ যেয়ে মেতে উঠতাম ব্যুফে খাবার প্রতিযোগীতাতে।
ফেলে আসা দিন গুলোতে শুক্রবারের অন্যরকম একটা আবেদন ছিল। সপ্তাহের এই দিনটা নিয়ে আসত দুপুরে পরিবারের সবার সাথে একসাথে বসে খাবারের উপলক্ষ। ভাই আর বাবার সাথে নামাজ পরে বাসায় ফিরে দরজার সামনে আসতেই আম্মুর যাদুকরী কোন স্পেশাল ডিশের মৌ মৌ গন্ধে প্রাণ ভরে যেত। খাবার টেবিলে বসেই প্লান হতো- বিকেলে কোথায় বেড়াতে যাব। কোনদিন যেতাম খালার বাসায়, আবার কোনদিন চলে যেতাম চাচার বাসায়।
সারাটা দিন টুক করে কোনদিক দিয়ে যে শেষ হয়ে যেত টেরই পেতাম না। অথচ আজ সেই শুক্রবারটারই বিশেষ চাকচিক্য আর নেই। নেই হঠাৎ কোন অকেশনে পাওয়া ছুটির আবেদন।
সেদিন শুক্রবারের আড্ডায় আশ্চর্য হয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কিরে আজ তুই এত তাড়াতাড়ি যে! আগে তো কোন শুক্রবারে তোরে এত আগে আসতে দেখিনি। ’ সে আমারে বিরসভাবে উত্তর দিল- ‘কি আর কমু দোস্তো।
আজ শুক্রবার, তাই সবাই বাসায়। ছোটচাচা, বড়চাচা, ফুফু সবাই। প্রতিদিনের এই চেহারা শুক্রবারে সবাইরে দেখাইতে ভাল্লাগে না। ’ আমি বুঝলাম জয়েন্ট ফ্যামিলিতে অতি আদরে বেড়ে ওঠা আমার এই বন্ধুটিরও শুক্রবারের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে। এখন হয়তো ছোটচাচা স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে ডেকে বলে- ‘কি ভাতিজা, খবর-টবর কি’ আর বেচারা বোধহয় ভাবে যে তার চাচা কোন জব অফারের খবর শোনার আশায় তাকে ডাকছে।
দাদী যখন বাসায় আসা মেহমানদের গর্বভরে বলে- ‘দেখসোনি, নাতী অহন আমার ইঞ্জিনিয়ার। ’ বেচারা হয়তো তারপর থেকে ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রশ্ন থেকে রেহাই পেতে সেই মেহমানদেরই এড়িয়ে চলে।
ক্যারিয়ার নিয়ে এহেন বিড়ম্বনার কথা আমরা বড়ভাইদের কাছ থেকে আগে শুনতাম। আর তাছাড়া সাটিফিকেট পাবার পর দুইমাসের মত বেকারত্ব আমাদের মত দেশের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ। কিন্তু সোনার হরিণটা যে আমাদের এক্ষুণি চাই, আমরা যে সময়ক্ষেপণ করতে রাজি নই।
অথচ আমরা আবার খুবই চুজি। জব লোকেশন হতে হবে বারিধারা বা গুলশানে, স্যালারি হতে হবে অ্যাট্রাক্টিভ আর অফারটা হতে লুক্রেটিভ। এই ধরণের হাজারো ধানাই-পানাইয়ের পর খুব কম জনেরই লাক ফেভার করছে। আমরা যখন এই সব গল্প অন্য ভার্সিটির বন্ধুদের কাছে করি তখন ওরা তন্ময় হয়ে শোনে, কেউ বিশ্বাস করে, কেউবা হেসে উড়ায় আবার কেউবা বলে- ‘আর ব্যাটা, রাখতো এইসব প্যাচাল। ছয়মাস পর আমগো রেজাল্ট দিলে তখন দেখা যাইবো কি হয়।
’
গ্রাজুয়েশনের পর শুক্রবারের এই ধরণের বিড়ম্বনা হয়তো কোন বেকার যুবতীর সহ্য করতে হয় না। আর তাছাড়া আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ‘বেকার যুবতী’ নামক শব্দটির ব্যবহার আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। এখানে যেন নিয়মই হয়ে দাড়িয়েছে যে যুবক হবে বেকার আর যুবতী হবে সেই বেকার যুবকের পরিবারের সদস্য, প্রেমিকা বা সহধর্মীনি। আগে যখন ‘বেকারত্ব একটি সামাজিক অভিশাপ’ টাইপের রচনা পড়তাম সেখানে চাকরী খুজে ক্লান্ত যুবকের ক্ষয়ে যাওয়া জুতার কথা থাকলেও বেকার যুবতীর ক্ষয়ে যাওয়া হিলের কথা কখনো পড়িনি। আমার বন্ধুটির মত আরো অনেক বেকার যুবক যখন অহেতুক কল্পনাবিলাসী হয়ে নিরন্তর সম্পর্কের কাছে থেকে মুক্তি পেতে পরিবার থেকে ছুটে বেরিয়ে আড্ডার আসরে আসছে ঠিক তখনি হয়তো সদ্য গ্রাজুয়েট কোন বেকার যুবতী মেয়ে পরিবারের আরো সান্নিধ্যে থেকে ‘পাত্রী দেখা’ অনুষ্ঠানের জন্য মেকাপ নিচ্ছে।
বেকার যুবক যখন স্টাডি লাইফের হিসাব মেলানোয় ব্যস্ত, বেকার যুবতী তখন লাইফের সেকেন্ড ইনিংসের প্রস্তুতিতে মগ্ন।
আর আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা আবার মজনু সেজে লাইলীকে হৃদয় দিয়ে বসে আছে তাদের অবস্থা তো আরো করুণ। দেখা যাচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথে গ্রাজুয়েশন করলেও নিশ্চিত সুখের আবাসনের নিশ্চয়তার ভার সদ্য বেকারত্বের খেতাব প্রাপ্ত প্রেমিকটিকেই নিতে হচ্ছে। হায়ার স্টাটিজের চেষ্টারত যুবকের কল্পনাতে ভেসে উঠছে প্রিয় সঙ্গীনির নিরন্তর তাগিদ, ‘তাড়াতাড়ি কিছু একটা কর। চাচা-ফুফুরা কিন্তু পাত্র খোজা শুরু করে দিয়েছে।
’ আমাদের সমাজে ছেলেরা কর্মহীন বসে থাকলে ‘বেকার’ আর মেয়েরা বসে থাকলে হবু ‘পাত্রীতে’ পরিণত হয়।
তবে এই ধরণের মানসিক টানাপোড়েন থেকে কিন্তু পারিবারিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। যেমন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির বিল ব্যাংকে গিয়ে দিয়ে আসা, ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া উঠানো, খালি হওয়া ফ্লাটের সংস্কার কাজ তদারকি করা, বোনকে কোচিং থেকে নিয়ে আসা কিংবা দাদাকে ডাক্তার দেখানো। তখন কর্মহীন যুবকটি হয়ত আপন পারিবারিক অপরিহার্যতার কথা ভেবে মনের শান্তি খুজে নিবে আর টানা অবসরের বিস্বাদ থেকে মুক্তির আনন্দে নিত্য নতুন কাজে নিজেকে জড়াতে চাইবে।
এমনিভাবে আমাদের মত বেকার যুবকেরা কর্মহীন হয়েও হাজারো কাজের মাঝে ডুবে থেকে এ পৃথিবীতে আমাদের অপরিহার্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এক সময়ের জনপ্রিয় মার্কিন অভিনেতা স্ল্যাপি হোয়াইট কৌতুক করে বলেছিলেন, “ঘুম ভেঙ্গে ওঠার মুহুর্ত থেকে শত কাজের মাঝে জড়িয়ে যাওয়াই বেকারত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য”
হ্যা, ঠিক তাই। আমরা নতুন দিনের সম্ভাবনার আশায় বিভোর হয়ে স্বপ্নের জাল বুনে যাচ্ছি। নিরন্তর অবসরে মনের ক্যানভাসে অনাগত মূহুর্তগুলো তুলির আচড়ে রাঙ্গিয়ে তোলাটাও যে একটা বিশাল কাজ তা এখন বুঝতে পারছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।