গত বছরের মত এবারও পহেলা বৈশাখ জঙ্গলে একা একা পালন করার কথা ছিল। সেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তৈরীও ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা জরূরী কাজে ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করতে হল। আমার জন্য ভালোই হল, সবার সাথে বর্ষবরণ করা যাবে।
বছরের শেষ দিনটায় রওনা দিব।
এদিকে দুপুরবেলা একটা দাওয়াত আছে। বৈসাবি উৎসব শুরু হয় এই দিনটা থেকেই, সেই উৎসবের দাওয়াত। উৎসবেও যেতে চাই, আবার ঢাকায় আসাও জরূরী। ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, গিয়ে সবার সাথে দেখা করেই চলে আসব। অফিস করে তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বোচকা-বুচকি সহ রওনা দিলাম দাওয়াতে।
ও, বৈশাখীর জামা পরে নিতে ভুললাম না।
ওখানে যেতেই খেতে বসিয়ে দিল। আমার হাতে তখন এক ঘন্টাও নেই। একে একে অন্য সবাই এল, সবাই বৈশাখীর সাজে। সবাই দেখল আমি কেমন করে সবাইকে রেখে একলা গাপুস গুপুস খাচ্ছি।
অবশ্য বাচ্চারাও বসে পড়ল আমার সাথে। খাওয়া দাওয়া শেষে যখন কি না সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দেয়া শুরু করল, আমাকে তখুনি বোচকা-বুচকি হাতে রওনা দিতে হল।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিয়ে দিলাম। বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পারলাম। পেছনের দিকের সিট, তবু তো পাওয়া গেছে।
এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হল। কিন্তু ধরা খেতেই হল। দেশের সব মানুষ মনে হয় বৈশাখী উৎসব পালন করতে ঢাকার দিকে ছুটেছে, নইলে এত জ্যাম হয় কিভাবে। পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে শুধু জ্যামে আটকে থাকলাম, আর বাসে বসে বসে গরমে সিদ্ধ হলাম। ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম, এক ঘন্টার বেশি সম্ভব হয়নি।
চিন্তা করে দেখলাম ঢাকায় বাস টার্মিনালে পৌঁছাতে যেরকম রাত হয়ে যাবে, আমার পক্ষে একা বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না। কেন যে মেয়ে হয়ে জন্মেছিলাম । টারজানকে তলব করলাম। কিন্তু সেও তো পড়েছে ঢাকার ভেতরের জ্যামে। বাস টার্মিনালে পৌঁছে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।
কত মানুষ আসছে, যাচ্ছে। পাশের কাউন্টারে এক লোক আরেকজনকে বলছে, এইবার পহেলা বৈশাখ কি গার্মেন্টসের লোকজনই করবে নাকি?
কাকে বলল কথাটা? আমিই তো এখানে বৈশাখী জামা পরে আছি। আমাকে গার্মেন্টসের লোকজন বলল নাকি? তারপর খেয়াল হল, সারাদিন গরমের মধ্যে বাসে বসে সিদ্ধ হয়ে যে চেহারা হয়েছে আমার, ফকিরনী যে বলেনি এই তো বেশি। যা হোক, অবশেষে টারজান জ্যামের পাহাড় পেরিয়ে আসতে সক্ষম হল আর আমরা বাসায় গেলাম। এরপর গোসল করে খেয়ে দেয়ে যে ঘুমটা দিলাম, সূর্যোদয় দেখা তো দূরের কথা, পরদিন দুপুর বারোটায় ঘুম ভাঙল।
উঠে দেখি পাঁচ পদের ভর্তা আর পান্তা তৈরী। আমাদের দুজনের কেউই অবশ্য পান্তা খাই না, তাই আমাদের জন্য গরম ভাত। সাদা-লাল বৈশাখী শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিলাম, টারজান পরল পাতা রঙের ফতুয়া। রাস্তায় বের হয়ে বর্ষবরণের উৎসবে সামিল হয়ে গেলাম। সাদা-লালের বন্যায় মিশে গেলাম দুজনে।
সবার হাতে মেলা থেকে কেনা ডুগডুগি, হাতপাখা, বেলুন আরও কত কি। আমরা নিলাম মুরালি, গজা, নিমকি, শামুক পিঠা, নাড়ু, বাতাসা, কদমা, বাদাম পাপড়ি আরও নানান রকম মিষ্টি।
রওনা দিলাম আরেক বাড়ির উদ্দেশ্যে যেখানে তিন ভাগ্নে-ভাগ্নী আমাদের অপেক্ষায় আছে। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে বৈশাখী সাজে যাব ভূতের আড্ডায়। তিনটা দলে ভাগ হয়ে সবাই রওনা দিয়ে দিল।
আমাদের দলটা একটু পিছিয়ে পড়েছিল। আমাদের দলে ছিলাম আমি, টারজান আর আমার জানের জান ভাগ্নে। সবাই চলে যাওয়ার পর ভাগ্নে আমাদের ধাক্কা দিতে থাকল, চল চল সবাই তো চলে গেল। টারজান বলল, আমরা বরং থেকেই যাই, আমাদের যাওয়ার কী দরকার। শুনে ভাগ্নের মুখ কালো হয়ে গেল।
চোখ ছল ছল করে ওঠার আগেই বেচারাকে বলে দিলাম, আরে যাবো তো, তোমার খালু দুষ্টুমি করছে।
ওখানে গিয়ে দেখি অন্যরাও তখুনি পৌঁছেছে। আমাদের রিকশা অনেক তাড়াতাড়ি চালিয়ে এনেছে। ভূতের আড্ডার সামনে নামতেই দেখি লাইট নিভে গেল, আর একজন বয়স্ক মহিলা তিন পিচ্চিকে নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে এল। আমরা ঢুকলাম, আর শুরু হল ভূতের নাচ।
আজ তারা সবাই নাচছে 'মেলায় যাইরে' গানের সাথে। বড় ভাগ্নে খুবই মজা পেয়েছে, ছোটজন মজা তো পেয়েছে, সাথে একটুখানি ভয়ও পেয়েছে, যদিও সেটা স্বীকার করেনি, শুধু মাকে একটু আকড়ে ধরে ছিল আর কি। আর ভাগ্নী বেচারী বুঝতেই পারেনি কী করা উচিৎ। ওদিকে বড় ভাগ্নে বারবার জানতে চাইছিল, ভূতের নাচ কতক্ষণ পর পর হয়? আবার কখন আসবে?
বেচারার ভূতের নাচ আরেকবার দেখার শখ আর পূরণ হল না। এত ভিড় ছিল যে খাওয়া শেষ করেই উঠে আসতে হল, অনেকে বসার জায়গা পাচ্ছিল না।
এরপর সবাই যার যার মত নিজের নিজের বাড়ি চলে এলাম। ক্লান্ত ছিলাম অনেক, তবুও ভেবে দেখলাম, নতুন বছরের প্রথম দিনটা মন্দ কাটাইনি।
সবাইকে নতুন বছরের পুরনো শুভেচ্ছা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।