বৃথা হয়রানি
অামার লেখা প্রথম উপন্যাসটি সংক্ষিপ্ত অাকারে তুলে ধরলাম। ২০০৭-এ দৈনিক অাজাদী-তে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কেমন হলো জানালে খুশি হবো।
ও জোনাকী, কি সুখে ঐ ডানা দু’টি মেলেছো
আঁধার-সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছো
১.
আজ একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।
বাড়ি থেকে চিঠি আসার রেওয়াজ কোনো কালেই ছিল না।
মাসান্তে মানিঅর্ডার পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফর্মের নীচে লেখা থাকে ‘ভালো থেকো’ ‘শরীরের প্রতি যত্ন নিও’ জাতীয় দুয়েক লাইন। প্রতিবারই একই কথা, একই হস্তাক্ষর। মাঝে মাঝে চপলের খুব হাসি পায়, মনে হয়, একই লেখা বুঝি প্রতিবার সাইক্লোস্টাইল করে পাঠায়।
প্রতিবারের লেখক মেজদা, টাকাগুলো পাঠায়ও সে।
বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তবে তার উপার্জনের উৎস সম্পর্কে কারো কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। ও একটা বহু চ্যানেলওলা টিভির মতো, কখন কোন চ্যানেলে আছে, চট্ করে বলে দেয়া মুশকিল। কখনো বালুর কন্ট্যাক্টারি, কখনো পোস্টার মারার ঠিকা, দোকান সাজানোর কাজ, স্টক মালের ব্যবসা, নববর্ষের আগে ফুলের পাইকার, ঈদের আগে কার্ডের, পুজোর তিন দিন আবার ফটো’র। তার করা হয়নি এমন ব্যবসা জগতে কমই আছে।
একবার স্মাগলারিঙে নেমেছিল। হাতে-নাতে ধরাও পড়েছে। পার্টি তখন ক্ষমতায়, তাই অল্পে সেরেছে।
আর কিছু করুক বা না করুক একটা কাজে সে খুব নিবেদিত; তা হলো পার্টিওয়ার্ক। মিছিল-মিটিং-কাউন্সিল সারাক্ষণ এসব নিয়েই তার ছোটাছুটি।
অবশ্য এটাই এখন তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পার্টি অপোজিশনে, প্রায় পুলিশ এসে হুজ্জোত করে। রাতে নাকি বাসায় থাকে না।
দশাননের মতো দশ দিকে মাথা বাড়িয়ে লোকটা যে খুব একটা সুবিধায় আছে, তা নয়। কোনপ্রকারে সংসারটা চলে যায়।
বছর খানেক হলো বিয়ে করেছে, বৌদীর বাপের বাড়ি অবস্থাপন্ন। তাই ঘেঁচাঘেঁচি লেগেই থাকে। ভাগ্যিস, চপল দূরে থেকে বেঁচেছে।
সারাদিন দানবের মতো খাটে, কিন্তু উঠবার কোন লক্ষণ নেই। মাঝে মাঝে আফসোস করে,‘...শালার ভাগ্যটাই যত নষ্টের গোড়া।
পথে পথে কেবল বাগড়া দেয়। এভাবে যদি রাতদিন না খেটে মরতাম, কবে রাস্তা থেকে ছুঁড়ে মারত। ’
লোকে কত সহজে তরতরিয়ে ওঠে যায় ওপরে। মেজদা কেবল সিঁড়িই ভাঙে- উঠতে পারে না।
চপলের বাবা চিঠি লেখেন না।
তার চিঠি লেখার প্রশ্নই আসে না, তিনি হচ্ছেন গণিতশাস্ত্রের শিক্ষক। সাহিত্য (চিঠি লেখা তার মতে সাহিত্য) করার মতো সময় তার কই? তার ধারণা, সাহিত্য হচ্ছে অলস লোকের কর্ম। চপল এ-জীবনে কখনো তাকে চিঠি লিখতে বা পাঠাতে দেখেনি।
কিন্তু, আজ এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। চপলের বাবা চিঠি পাঠিয়েছেন।
প্রথমে চিঠি পেয়ে অবাক হয়েছিল চপল। অপরিচিত হস্তাক্ষর, অপরিচিত সম্বোধন। চিঠির একবারে তলানিতে গিয়ে লেখক সম্পর্কে নিশ্চিত হলো। অনেক কথাই লিখেছেন। চিঠি লিখতে, শরীরের প্রতি যত্ন নিতে, বেশি বেশি পড়তে, পরিবারের অন্য সবার কুশলাদি।
একেবারে শেষ ধাপে এসে আর্থিক অনটনের কথা লিখেছেন; খুব সংক্ষেপে। যেন ব্যাপারটা তিনি জানাতে চান না, অথচ না জানালেও নয়। নিজে কিছু করার জন্য বলেছেন।
অনেকদিন ধরেই চপল চেষ্টা করছে কিছু একটা করার। মাসান্তে যে হাজার দুয়েক টাকা আসে, তা থেকে রুম ভাড়া বাবদ ৭০০ টাকা সালাম ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়ার পর, কী আর থাকে? একটা টিউশনি থাকায় বেঁচেছে।
হাজারটা যোগ-বিয়োগ করে কোনপ্রকারে মাসটা কেটে যায়। না কাটলে পঁচিশ তারিখ এসে ধার করতে হয় স্নিগ্ধার কাছে। ওতো মা লক্ষ্মী, টাকার কোনো অভাব নেই, কোত্থেকে কোত্থেকে যেন ঠিকই একটা পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে বলবে, এই লাস্ট, আর মাথা কুটলেও পাবি না।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চপলের যখন ঝিমুনি ধরেছে, খাটে গা এলিয়ে দিয়ে একটু চোখ বুঁজবে, ওমনি দরজায় সজোরে ধাক্কা। দরজা খুলেই দেখে সেলিম ভাই, পেছনে অবন্তি।
মাস ছয়েক হয় ওদের পরিচয়।
সেলিম ভাইয়ের সেই বিখ্যাত হাই-ভোল্টেজের হাসি। হাসির ইঙ্গিতে চপল চটিপায়ে বেরিয়ে পড়ল। অবন্তি এতে অবশ্য বিব্রত হল। কণ্ঠে একটা কৃত্রিম উৎকণ্ঠা সাজিয়ে বলল,
আরে যাচ্ছেন কই।
বসেন... বসেন...
চপল একটা নির্লিপ্ত হাসি দিয়ে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে পড়ে।
আনমনে রাস্তায় হাঁটে। মাথার ভেতরে একটা প্রশ্নই শুধু কুণ্ডলী পাকায়, বাবা কেন চিঠি দিলেন; মেজদা কই?
২.
স্নিগ্ধার গা-জ্বালা করছে। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই তড়াক করে ওঠে বলতে: আচ্ছা, আসি।
কিন্তু সম্ভব না।
তার সৌজন্যবোধে বাধছে। এসেই যখন পড়েছি, ভালো-মন্দ দুটো কথা বলি, নইলে কেমন নাটক নাটক দেখায়। স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ‘কুল স্নিগ্ধা, কুল’। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করব না।
বোর্ডের প্রশ্নগুলো যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে কেটে পড়ব। হ্যাঁ অথবা না। কথা প্যাঁচাতে চাইলে সরাসরি বলে দেব: আজ বেশি কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মাথা ধরেছে। একটা ডিসপ্রিন খেয়েছি।
তারপরও কাজ হয়নি। ব্যাগে পুরো পাতাটা আছে। দেখবেন-
আচ্ছা আপনার নাম...
স্নিগ্ধা চমকে ওঠে। ছাগলটা লতলতে এক জিহ্বা ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সুযোগ পেলেই চেটে ফেলবে।
নাহ, স্নিগ্ধা আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। একটা সামান্য মার্কেটিং ম্যানেজারের চাকরির জন্য এতোদূর নামতে হবে! মাই গড। বলতেই যত গালভারী, মার্কেটিং ম্যানেজার, বাস্তবে দেখা যাবে কেরানি কিংবা রিসিপশনিস্টের কাজ।
কাইন্ডলি আমার সিভিটা দেখুন। স্নিগ্ধা চোখে চোখে তাকিয়ে উত্তর করে।
তাতেই কাজ হয়। ভদ্রলোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে লগুড়ের মতো ভারী দুটো হাত সরিয়ে কাগজগুলো ওল্টাতে লাগেন।
আপনার তো এক্সিলেনট রেজাল্ট। অল ফাস্ট ক্লাস। তা লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কিছু করেন?
সরি!
মানে গান-বাজনা ইত্যাদি।
চোয়াল ঝুলিয়ে হেসে ওঠে ছাগলটা।
স্নিগ্ধার মেজাজ আরো চড়ে যায়।
মনে মনে বলে: হÑ জানি, দেখবি আমার খেমটা নাচ?
কিন্তু নিপাট একটা ভালোমানুষি মুখ করে সে বলল,
নাহ, আসলে ওগুলো হয়ে ওঠেনি।
আমাদের স্যার কিন্তু খুব কালচারাল মাইন্ডের। চ্যাংড়া বোর্ড মেম্বারটি যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
এই তো গতবার কালচারাল এ্যাওয়ার্ড...
ছাগলটার দুপাশে আরো দুই বোর্ড মেম্বার। একজনের বয়স ত্রিশের ঘরে; অন্যজন এর দ্বিগুণ। চুলগুলো সব পেকে কাশফুল হয়ে গেছে। চ্যাংড়া মেম্বারটির দৃষ্টি ছাগলটার দিকে। ছাগলের প্রতিটি কথায় মাথা ঝাঁকাচ্ছে।
আর বুড়ো মিয়া ‘সব বুঝি’ একটা ভাব করে চশমা ডিঙিয়ে তাকানোর কসরৎ করছেন। কিন্তু দুজনের আসল দৃষ্টিটা স্নিগ্ধার ওপর। সরাসরি না তাকালেও আড়চোখে দেখে নিচ্ছে তাকে। তার পা, পায়ের নখ; পাজামা, পাজামায় ঢাকা ঊরু; বুক, বুকের ড্রইং...। কোরবানীর হাটে লোকেরা যেভাবে গরু দেখে।
গরুর গায়ের গোশত। স্নিগ্ধা বেশ বুঝতে পারছে।
বলুন তো ঢ়ঁমহধপরড়ঁং শব্দটির অর্থ কী? সাদা চুলো ঝুঁকে পড়লেন স্নিগ্ধার দিকে।
আরে ভাই রাখেন তো, উনি কী ইংরেজ সাহিত্যের ছাত্রীÑ এতো কঠিন শব্দের অর্থ জানবে। আর এই পুগনা না পুংটা এসব আমাদের অফিসিয়াল কাজেও লাগে না।
স্নিগ্ধা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
তা, আমি সরাসরি কিছু প্রশ্ন করব। প্যাঁচাবেন না। এক কথায় উত্তর দেবেন। ছাগলটা নিজের হাতে লাগাম তুলে নিল।
আপনি কি এই চাকরিটা করবেন?
করার জন্যই তো এসেছি।
স্নিগ্ধা মনে মনে বলল: মরে গেলেও না।
উঁহু, হলো না। সরাসরি বলুন-
করবো।
দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল: এবার কেটে পড়তে পারলে বাঁচি।
ক’দিন?
এর চেয়ে ভালো অফার না পাওয়া পর্যন্ত।
মিনিমাম ছ’মাস চাকরির গ্যারেন্টি দিতে হবে। সাদা চুলো বলল।
দেখি।
তাহলে তো হলো না।
দেখি দেখি করে আমাদের ডোবাবেন, তা হবে না। সরাসারি বলুন।
করব।
আপনার স্টার্টিং কিন্তু ১০ হাজার, ৬মাস পর পর ইনক্রিমেন্ট। তবে বেতন একসঙ্গে পাবেন না।
আমাদের এখানে সবকিছুই ইনস্টলমেন্ট বেসিস। মাসের ৬, ১২, ১৮, ২৪ ও ৩০ তারিখ ইনস্টলমেন্ট পাবেন। প্রতি ইনস্টলমেন্ট ২০০০ টাকা করে।
কিন্তু ফেব্র“য়ারি মাসে...
ও আপনাকে ভাবতে হবে না। রাজি থাকেন তো কাল ৫ তারিখ, জয়েন করে ফেলুন।
১২ তারিখ এক ইনস্টলমেন্ট পেয়ে যাবেন।
স্নিগ্ধা চিন্তাও করতে পারেনি এতো সহজে চাকরিটা হবে। আর বেতনও খারাপ না। প্রথমে এদেরকে যতটা খারাপ লেগেছিল এখন ওতটা লাগছে না। স্নিগ্ধা ভাবল: এক ইনস্টলমেন্ট করেই দেখি না।
অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় ব্যাকলিটেড সাইনবোর্ডটা দেখে নিল স্নিগ্ধা। গাঢ় নীল জমিনের ওপর বেশ বলিষ্ঠ অক্ষরে লেখা ‘স্বপ্নদীপ ইনস্টলমেন্ট (প্রাঃ) লিঃ (এসইএল)’। মনে মনে হাসল। ঘন্টাখানেক আগেও যে লোকগুলোকে গালমন্দ করেছে, এখন তাদেরকে প্রভু জ্ঞান হচ্ছে।
৩.
মরচে-পড়া লাল লোহার গেট।
পাশে কড়ইগাছের পায়ে ছড়ানো রোদের আলপনা। ঝিরঝিরে বাতাস। কাছে কোনো মসজিদ থেকে কাঁপা কাঁপা আজানের সুর। পাহাড়তলীর এ জায়গাটা চপলের খুব প্রিয়। প্রতি শনিবার চপল এখানে আসে।
অবশ্য প্রকৃতি দেখতে নয়। চপল বাড়ি ফেরে না অনেকদিন। চপলদের গ্রামের ছেলে সোলেমান; রেলে চাকরি করে। প্রতি বৃহস্পতিবার ও বাড়ি যায়, ফেরে শনিবার। শনিবার বিকেলে রেল কারখানার গেটে তাই ওঁৎ পেতে থাকে চপল।
সাড়ে চারটায় সাইরেন বাজে। সোলেমান বের হয়। মাগরিবের আজান পর্যন্ত খুঁটেখুঁটে সোলেমানের কাছ থেকে বাড়ির খবর নেয়।
একসময় সোলেমানের কথার ঐরাবতে চেপে ও চলে যায় বাড়ির পেছনের জুঁই গাছটার কাছে। ওখানে একটা বাস্তুসাপের বাস।
কাঁচা গোবরের গন্ধের সঙ্গে জুঁইয়ের ঘ্রাণ মিশে মাতাল করে তুলে দক্ষিণা বাতাস। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঘুপচে অন্ধকার। সেই পটভূমিকায় তারার মতো জ্বলে ওঠে জোনাকিরা। বাবা বলতেন, সূর্য না হতে পারো জোনাকি হও।
কুপি হয়ে ঘরের চালে কালি জমিয়ে জীবনটা নাশ করো না।
মা খিড়কি দুয়ার পুঁছে আর বাসন্তীকে ডাকে, ‘ও বাসু, দেখতো কে এলো!’ মাথা ঘুরে তাকাবার সময় নেই তার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুয়ার পুঁছে সেঁজুতি দিতে হবে। আরেকটু দেরি হলেই মা লক্ষ্মী তার আশীর্বাদের ঝাঁপি হাতে ফিরে যাবেন।
‘ও বাসু, বাসু রে...। ’ উঠোন ভরা এক পাল হাঁসকে সানকি ভরে ভুষি খেতে দেয় বাসন্তী। তারই বা সময় কই! তিন্নি লুচি ভাজছে। লুচি ভাজার ঝ্যাৎ ঝ্যাৎ আওয়াজ ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে মিশে একাত্ম হয়ে যায়। চপলের ছোট ভাই উৎপল গাই-বাছুরগুলোকে গোয়ালে তোলে।
কোন ফাঁকে লাল গাই’র ছোট বাছুরটা ছাড়া পেয়ে সারা বাড়ি ছুটছে। অন্ধকার দেখে থমকে যায়, ভয়ে পা বাড়ায় না, আবার তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে উল্টো দৌড়। বেচারা উৎপল বাছুরটার পেছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপায়। বাবা পরমহংস দেবের মতো আসন পেতে, হাঁটুর ওপর দুহাত টানটান করে, বসে থাকেন। ‘কীরে, সন্ধ্যা হয়ে গেলো, এখনো সেঁজুতি দিলি না।
এতো অলক্ষীর নিবাস রে...’ বাবা আপনমনে বলে যান।
খিড়কি দুয়ারে উঁকি মারলে দেখা যায় মা বালতির ওপর ত্যানা নিংড়াতে নিংড়াতে বলে,‘লোকটার তর সয় না’। মায়ের গায়ের ত্রিভুবন ভোলানো গন্ধ। কিছুটা চামেলির, কিছুটা সোঁদা, কিছুটা গরম মশলার, গোয়ালঘরের, ত্রিফলা তেলের। মা গো, মা আমারÑ।
চপলের কণ্ঠ ধরে আসে।
রেলের সাইরেন বেজে ওঠে।
চপলকে দেখে থমথমে মুখ করে তাকায় সোলেমান।
ভাই, গ্রামের খবর কি?
বাড়ির খবর জানো না! অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সোলেমান।
না তো, কি হইছে?
ওই মোশারইফ্যা, গেলো জ্যৈষ্ঠে গৌতমদের বাড়িতে যে আগুন দিল, সে খুন হইছে।
কি বলো।
হ্যাঁ। দেশের সবগুলো পত্রিকাই তো নিউজ করছে, তোমার চউখে পড়ে নাই?
নাহ...
চপল মনে মনে বলল: পত্রিকা পড়লে না চোখে পড়বে।
অপোজিশন পার্টির যত লোকজনরের পাইছে আসামী করে ওরা কেস ফাইল করছে। তোমার ভাইয়ের নামও আছে।
খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হলো চপলের কাছে।
মোশারফের মেডিকেলে নেয়ার পর প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। ডাক্তার বলে, কুইক ব্লাড। তোমার ভাই নাকি দুই ব্যাগ রক্তও দিছে।
চপল মুচকি হাসে।
এ আর নতুন কি।
কিন্তু মরে যাওয়ার সাথে সাথে তারা কেস করল। সেখানে তোমার ভাইজান ৫ নাম্বার আসামী। ও তো আর জানে না। সারাদিন মেডিকেলে আর গোরস্থানে দৌড়াদৌড়ি কইরা রাইতে গেছে ঘুমাইতে, ওমনি পুলিশ আইস্যা দরজা ধাক্কায়।
বুক ঠেলে কান্না আসতে লাগল চপলের। ও আর কিছু শুনতে পারছে না। তার সহজ-সরল মেজদাটা আর কত লাঞ্ছিত হবে এ সমাজের কাছে। শেষমেশ খুনের আসামী!
মনটাকে আর আটকে রাখতে পারল না চপল। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা রেখে ও ছুটলে দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে।
৪.
প্রথম দিন স্নিগ্ধার আর অফিস করা হলো না। জয়েনিং লেটারে সাইন, সবার সঙ্গে পরিচয়, তারপর ডিজিএম এজাজ সাহেবের ছোট্ট একটা ব্রিফ। ফেরার আগে এজাজ কতগুলো ভিসিডি দিলেন। ওসব ভালো করে দেখে আত্মস্থ করতে হবে। কোনো কিছু না বুঝলে উনি তো আছেন।
আপতত উনিই স্নিগ্ধার বস। দু’মাস তাঁর সঙ্গে থেকে শিখবে কিভাবে কাস্টমারদের মোটিভেট করতে হয়। এরপর স্নিগ্ধা স্বাধীনভাবে কাজে নামবে।
অফিসটা চারতলা। নিচতলায় শোরুম, দোতলায় অফিস, তিনতলায় রেস্টহাউস আর চারতলায় গুদাম।
ফয়সাল নামের এক ছেলের সঙ্গে ঘুরেঘুরে পুরো অফিসটা দেখল। ভালোই লেগেছে ওর। অফিসের সবার মধ্যে একটা উদ্দীপনা আছে। কাস্টমাররা নেহাৎ কাস্টমার নয়, তারও প্রতিষ্ঠানটির ছোটখাটো শেয়ার হোল্ডার। প্রতিটি বিক্রিতে তাদের একাউন্টে কিছু পয়েন্ট জমা হয়।
পয়েন্ট জমতে জমতে একটা বড়ো অংক হলে বেশ কিছু টাকা পায়।
পরদিন অফিসে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল স্নিগ্ধা। হ্যাংলা গড়নের এক মেয়ে এসে ওর হাত দুটো ধরল,
কেমন আছো ভাই। আগে কোথায় ছিলে?
একটা কিন্ডারগার্টেনে।
তা ডিজিএম স্যারের লেকচার কিছু বুঝেছো?
স্নিগ্ধা মাথা নাড়ালো।
বুঝবে না, কেউ বুঝে না। একটা কথাই শুধু বারবার বলেন। দেখো না, তাকে বোঝাতে গিয়ে কেমন ঝাড়ি খাও। বলবে, এতো জটিল করে বললে কাস্টমার বুঝবে কেমনে। নইলে বলবে, ভালোই তো মুখস্ত করেছো; তবে এতে এ লাইনে কাজ হবে না।
তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই, ডিজিএম স্যারের বকবকানি ফলো না করে বরং ভিসিডিগুলো দেখো, কিছু জানার থাকলে ফয়সালকে বলতে পারো। তবে...
স্নিগ্ধার দিকে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটি।
খুব সাবধান। ছেলেটা কিন্তু... না থাক কিছুদিন মিশলেই টের পাবে।
ফয়সাল তার হাতের কাজগুলো অন্য কলিগকে বুঝিয়ে দিয়ে ওঠে আসে।
চলেন, নিচে যাই, কফি খেয়ে খেয়ে কথা হবে।
ফয়সাল এগিয়ে আসতে দেখে হ্যাংলা মেয়েটা সরে যায়।
না, আজ থাক। দেখি অফিসের কাজকারবার। তা, আপনি উঠে এলেন কেন?
অন ইয়র অনার ম্যাডাম... রাজকীয় কায়দায় ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল ফয়সাল।
থ্যাংক ইউ।
আজ কিন্তু আপনাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে।
থ্যাংক ইউ, এ্যাগেইন।
৫.
এখন আর চপলদের বাড়ি যেতে কোনো কষ্ট নেই। বৈষ্ণবীর ভিটা পর্যন্ত ইট বিছানোর কাজ হয়ে গেছে।
স্টেশন থেকে এক ঘন্টা পরপর ভটভটি ছাড়ে, মাত্র তিন টাকায় তাদের বাড়ির গম ক্ষেত।
যোগাযোগের মতো আরো অনেক কিছুই পাল্টে গেছে গ্রামের। রাস্তার পাশে অপরিচিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে নতুন বসানো বিদ্যুতের খুঁটি। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। গোধূলির চোরাআলোয় চারদিক কেমন ঘোরলাগা।
বাড়িগুলোর আগের সেই দিলখোলা চেহারা নেই। কেউ নারকেলের পাতা দিয়ে, কেউ চকচকে রূপালি ঢেউটিনে, কেউ রীতিমতো দেয়াল তুলে নিজের ভিটেটাকে পৃথক করে নিয়েছে পুরো গ্রাম থেকে। কি যেন একটা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা। চোখ ধাঁধিয়ে বাড়ির জানালাগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিদ্যুতের আলোয়। হঠাৎ করে চপলের মনে হয় ভুল কোথাও এসে পড়েছে।
শুক্লা একাদশীর চাঁদটা তখন মাথার ওপর। বিধবার মতো ফ্যাকসে মুখে আঁচল চাপিয়ে ও শুধু মিটিমিটি হাসে।
চপলকে দেখে বাবা পাথরের চোখে তাকিয়ে রইলেন। উনার চোখের দিকে তাকানোর সাহস কোনো কালেই ছিল না চপলের, আজও হলো না। বাবার চোখের নীচে শুধু একটা প্রশ্নই ঝুলে আছে অশ্র“বিন্দুর মতো: কেন এলি?
রিনির কলরোল শুনে মা রৈ রৈ করে ছুটে এলো।
ভয় আর উচ্ছ্বাস দুটি বিপরীত অনুভূতির চক্রে পড়ে ক্ষণেক বিমূঢ় হয়ে রইল। পরক্ষণে ডানপিটে কিশোরীর মতো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে চপলকে। মায়ের গায়ের সেই পরিচিত গন্ধটা অনেকক্ষণ, ঠিক কতোক্ষণ মনে নেই, মদিরার মতো আচ্ছন্ন করে রাখে চপলকে। নেশা কেটে যেতে দেখে মা ছেলেকে ঘিরে ঝাঁক ঝাঁক উৎসুক চোখ।
অনেকদিন পর চপলদের বাড়িতে আত্মীয়দের মিলনমেলা বসেছে।
ছোটদের ছোটাছুটি, বৌ-ঝিদের খোশগল্প, পুরুষদের হৈচৈ সব মিলে উৎসব উৎসব ভাব। যদিও উপলক্ষটা মোটেও প্রীতিকর নয়।
দুই মামা এসেছেন, যার মধ্যে একজন জজ কোর্টের উকিল, তাদের তৎপরতাই বেশি। আর বাকীরা সবাই এদের কর্মকাণ্ডের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। কোন একটা ত্র“টি পেলে ঘুরে ঘুরে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
পিসতোত বোন অমলা চপলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, সব সমস্যার মূলে তোর ঐ এ্যাডভোকেট মামা। সেদিন রাতে নগদ কিছু দিয়ে যদি দারোগার সঙ্গে রফা করে ফেলতেন, তাহলে পানি আজ এদ্দূর গড়াত না।
চপলের বড়ো মামা চোখ-কান-খোলা লোক। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সবার সামনে তিনি চপলকে বললেন, তুমি আসছো, ভালোই হইছে। তবে না আসলে আরো ভালো হইত।
শুনলাম তোমার নাকি মাস্টার্স ফাইনাল চলতেছে। পরীক্ষাটা দিয়াই আসতা। যাই হোক, তুমি যা ভালো বুঝেছো করেছো, আমার বিশেষ কিছু বলার নাই। আমি অন্য একটা বিষয়ে তোমাকে বলতে চাই। তের-চৌদ্দ ঘন্টা এখানে অবস্থান করে তুমি নিশ্চয়ই অনেক কথা শুনেছো।
শোনাই স্বাভাবিক। তবে একটা কথা জেনে রেখো, আমি নি:সন্তান লোক, আমি তোমাদের নিজের সন্তান ভেবে তৃপ্তি পাই। পিতা হিসেবে একজন পুত্রের জন্য যতটুকু করা যায়, আইনজীবী হিসেবে মক্কেলের জন্যÑ তার সবটুকুই আমি করেছি। কিন্তু সুপল যে চোরাবালিতে পড়েছে, সে বড়ো গভীরÑভয়াবহ। তা থেকে তোলা যে অসম্ভব তা নয়, তবে এর জন্য চাই ধৈর্য্য ও সময়।
আশাকরি, তুমি আমার কথাগুলো বুঝেছো।
বাবা চপলের সঙ্গে এ যাত্রায় কোন কথাই বল্লেন না। চপল জানলো, মেজদা এ্যারেস্ট হওয়ার পর তিনি নাকি বিরাট গণ্ডগোল বাধান। দাদাকে ত্যাজ্য করবেন, নিজে থানায় যাবেন না- কাউকে যেতেও দেবেন না। মিডেল কাস্ট সেন্টিমেন্ট আরকি!
কিন্তু মেজদাকে ত্যাজ্য করলে তাদের কী দশা হবে, তা সম্ভবত একবারও ভেবে দেখেননি।
ত্যাগ করার জন্যও যথেস্ট সামর্থ্যরে প্রয়োজন হয়। আজ থেকে পনের-বিশ বছর আগে যা তার ছিল, এইচএসসিতে খারাপ করায় বড়ো ছেলেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই সামর্থ্য ও অবস্থান আজ কোনটাই তার নেই।
বড়ো মামা এসে বাবাকে চুপ করান। তারপর থেকে তার মুখে রা নেই। মর্মরমূর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকেন এক জায়গায়।
৬.
রাত দুটা পর্যন্ত সবগুলো কাগজপত্র আর সিডি দেখে স্নিগ্ধা তৈরি হয়ে নিল।
পরদিন ঠিক ন’টায় অফিসে এসে সোজা এজাজ সাহেবের রুমে।
মে আই কাম ইন স্যার।
শিওর শিওর। সিট ডাউন, প্লিজ! আই এ্যাম ওয়েটিং ফর ইউ।
স্নিগ্ধা বসল।
তা... কাগজগুলো সব দেখেছেন।
জ্বি।
আমার হাতে সময় নেই, একদল কোরিয়ান ডেলিগ্রেট আসবে, আমাদের ওয়াশিং মেশিনের প্ল্যান্টের সাইট দেখতে, ঠিক সাড়ে ন’টায় ওদের সঙ্গে বসতে হবে। ঘড়ি দেখে বললেন।
আমার হাতে মাত্র দশ মিনিট সময়। তুমি দ্রুত বলো তো, কাল তোমাকে কি কি বুঝিয়েছি।
স্নিগ্ধা এবার একটা চোরা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তার মতো করে সব গুছিয়ে বলল।
গুড, গুড।
তুমি তো দারুণ ট্যালেন্ট মেয়ে। খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছো।
দু মাসের ট্রেনিং পোস্টপন্ড করে স্নিগ্ধাকে মার্কেটিং সেকশনে রেফার করা হলো। স্নিগ্ধার কাজটা শোরুমে। কলিগদের ওর মোটামুটি ভালোই লেগেছে।
সেই হ্যাংলা করে মেয়েটার নাম শাজনীন। নীলা লম্বা, সুদর্শনা। ফয়সালের একবারেই বিপরীত শামীম। আগ বাড়িয়ে তো কথা বলবেই না, একটা প্রশ্ন করলে অনেক ভেবে-চিন্তে উত্তর দেয়। মাহমুদ দারুণ চটপটে।
তবে কথাবার্তা কেমন ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত। সহদেব একেবারেই গোবেচারাÑ মুখচোরা।
স্নিগ্ধার ইমডিয়েট বস হিসেবে আছেন দু’জন সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার। খায়রুল কবির ও এহসান মনি। প্রথম দিন শুধু এহসান সাহেবের সঙ্গে কথা হলো।
স্নিগ্ধার পরিচয় পেয়ে আকর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, ওয়েল ডান, এবার ঝাঁপিয়ে পড়ো কাজে। চাপাটা ঠিক রাখবা, সব ঠিক... এদেশের পাবলিকরে একবার গিলাই ফেললে হইলো, তারপর আফিমের মতো শুধু ওইটাই খুঁজবো।
শোরুমের ইনচার্জ খায়রুল কবির। তাই এহসানের সঙ্গে স্নিগ্ধার আপতত সরাসরি কোন কাজ নেই।
চাকরির চতুর্থ দিনে কাজ মিলল স্নিগ্ধার।
তার কলিগরা তাকে এ্যাপ্রিশিয়েট করে বলল, আপনি তো বেশ লাকি, মিনিমাম দু’মাস ডিজিএম সাহেবের বকবকানি না শুনে কেউ পোস্টিং পায় না।
তবে এই পোস্টিং সাময়িক। দু’মাস তাকে এদিক-ওদিক নেড়ে-চেড়ে দেখা হবে, কোথায় সেট করলে ভালো হয়।
শোরুমের তিনটি কাউন্টার। প্রতিটি কাউন্টারে একজন করে জুনিয়র মার্কেটিং অফিসার।
স্নিগ্ধার কাজ হচ্ছে ঘুরেঘুরে দেখা। কে কি কিনছে। কারো কিছু জানার থাকলে তা তাকে জানানো।
এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। উনি এখনকার সদস্য।
এটা-ওটা বেচে দিয়ে কিছু বোনাস পয়েন্ট পেয়েছেন। সেই পয়েন্টের বিপরীতে কিছু কিনবেন বলে এসেছেন।
একটা ওয়াটার ফিল্টারের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ইবা লইবা না।
কিল্লাই? বাড়িত গি পানি ফুডাই ন’ খাওয়াই।
আরে... ফুডাইলে বেক জীবাণু ন’ মরে ... বেগে লত ত ... লই না একগা ...
ভদ্রলোক খুব আহ্লাদ করে বললেন।
একটিং করদে’ না! নুন আনতে ফানতা ফুরায় আবার ফিল্টার মারোর। কালিয়া কইলাম না নন্টুইয়ার লাই ইংরেজির মাস্টার রাখন পরিব...
আরে বাজি... গরম অই যর কিল্লাই? ফিল্টার ন লইলা আরি, একগা ...
এই ডাহাইত্যা দোয়ান তুন কিচছু ন লইয়ুম। ফিল্টার ইবার দাম লেইক্যা আড়াই হাজার টিয়াঁ। এনে রে’জদ্দিন বাজারত পনরশ টিয়ার দর বেচের। বেক জিনিসের গলাকাটা দাম...
ইল্লাই ক'দে মাইয়া মানুষোর কথা ন’ হুনোন।
তুই কি বুঝিবা না বোনাস পয়ন্টোর হিসাব!
তুমুল ঝগড়া লেগেছে এই দম্পতির মধ্যে, স্নিগ্ধা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এ সময় মাহমুদ এসে খুব বিনীতভাবে তাদের থামতে বলল। তাতে মহিলা দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল। শেষমেশ ভদ্রলোক দাবড়ানি খাওয়া কুকুরের মতো ঘাড় নামিয়ে কেটে পড়লেন। পেছন পেছনে তার স্ত্রী।
৭.
টানা-বারেন্দার একমাথায় হাজতখানা। চপল সোজা চলে যাচ্ছিল সেদিকে। মেজদা এখন থানা কাস্টডিতেই। ডিউটিতে থাকা কনস্টেবলটি কিছুক্ষণ অবাকদৃষ্টিতে দেখল তাকে। তারপর বাধ সাধল।
এই মিয়া, তুমি কে? কই যাও?
আমার নাম চপল। যাচ্ছি হাজতে। আমার ভাই...
ওদিকে যাওয়া যাবে না।
যাওয়া যাবে না! কিন্তু কাস্টডি’র সামনে এতো মানুষ গেলো কি করে?
থতমত খেয়ে যায় কনস্টেবলটি।
থানায় ওসি সাহেব আছেন... যাওয়া যাবে না।
তাহলে ওসি সাহেবের কাছে যেতে বলছেন?
না না, ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়া অনুমতি নিয়া আসো।
চপলদের গ্রামের উঠতি মাস্তান ট্যারা সিদ্দিক। একসময় চপলের সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। ডিউটি অফিসারের রুমে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল। এক দারোগার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে।
দুজনই আলাপে ব্যস্ত। চপল দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার দিকে ভ্র“ক্ষেপের সময় নেই কারো। সিদ্দিককে দেখেও না দেখার ভান করে চপল সরাসরি দারোগাকে বলল, আমার ভাই কাস্টডিতে, তার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
দারোগা মুখ ভেংচে বলে, না না, হবে না।
ওসি সাহেব এখন থানায়।
আরে, তুমি চপল না? সিদ্দিক ঘাড় ফিরে তাকায়।
চপলের মুখ থেকে ‘আপনি’ সম্বোন্ধনটা হুট করে বেরিয়ে আসছিল, দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুই সিদ্দিক না!
তাইলে চিনতে পারছস। কি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবি? চল্।
দাদার গালে চাপ চাপ দাড়ি।
রক্তজবার মতো লাল দুটো চোখ। দেখতে ‘যুবা’ ফ্লিমের অভিষেকের মতো দেখাচ্ছে। কিছুদিন হয় পুলকদের বাসায় ছবিটা দেখেছে। রাণী-অভিষেকের অভিনয় এখনো তার চোখের পাতায় লেগে আছে।
দাদার মুখ রাগে থমথম।
একলা আসতে পারসি না, সাথে আবার লোকজন লাগে কেন?
সিদ্দিক বুঝতে পেরে চপলকে বলল, তুই থাক, আমি আসি।
সিদ্দিক চলে যাওয়ার পর মেজদা জানতে চাইল,
কিরে, কেমন আছিস!
চপলের খুব কান্না পাচ্ছে। সে কি বলবে? তোমাকে কষ্টে রেখে আমরা খুব ভালো আছি।
আরে পাগলা তোর চোখ তো ছলছল করতেছে। কুছ পরোয়া নেহি, আর কয়টা দিন।
আমি কি খুন করেছি যে ওরা আমারে জেলে আটকায়া রাখবো।
দাদা তোর এখানে খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
এখানে আর কিসের কষ্ট, কষ্ট তো শুরু হবে জেলে। জেলেই যদি না গেলাম তো কিসের পলিটিক্স করি। জানিস তো বঙ্গবন্ধু ২৪ বছর জেলে ছিলেন, ম্যান্ডেলা ২৭ বছর। জেলেই একজন রাজনীতিবিদের ধৈর্য্যরে পরীক্ষা...
চপলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার মেজদার লেকচার শুরু হলো।
দেশটা ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বুঝিস কিছু! ইলেকশনের পর যে তাণ্ডবটাই না চালাল। গৌতমদের চিনতি না, হ্যাঁ মীরগঞ্জের, বেচারা তো ইলেকশনের পরপরই গায়েব। গেলো বছর মোশারফ-সিদ্দিক এরা হামলা চালায় ওদের বাড়িতে। গৌতমের ছোট বোনটাকে, ফাইভে পড়ে বোধহয়, গ্যাং-র্যাপ করল। মাসী করজোড়ে কত মিনতি করল, আমার মাইয়াডা তো ছোড, তোমরা একজন একজন কইরা আসো।
কে শোনে কার কথা। এসব তো পত্র-পত্রিকায় আসছে, পড়স না তুই! মেয়েটা এখনো নাকি চিটাগাং মেডিকেলে আছে, পারলে একবার দেখে আসিস।
আচ্ছা ,ঠিক আছে।
গৌতমের পরিবারের ঘটনা চপল পত্রিকায় পড়েনি। মেজদার মুখে শুনে তার প্রচণ্ড খারাপ লাগল।
আর ক’দিন ব্যাটাদের, চিন্তা করিস না, জলিল সাহেব বলছে না ৩০ এপ্রিল- ট্রাম্পকার্ড, এর মধ্যেই দেখিস...
চপল কি বলবে, ও শুধুই শুনে যাচ্ছে।
তুই ভালো আছস তো, চপল। কতদিন পর দেখা। তা মাস্টার্স শেষ হইছে তোর?
পরীক্ষা চলছে।
তুই আইলি ক্যান? পরীক্ষাটা ভালো কইরা দে, একবার তো ড্রপ মারলি।
তোকে কিন্তু অনেকদূরে যাইতে হবে। আমরা ভাইবোনরা তো সব বীজতলাতেই নষ্ট হইয়া গেলাম, তুই আমাদের আশার আলো। বিসিএসটা দিবি। এডমিনিস্ট্রেশনে ঢুকবি। দেখবি পৃথিবীটার মজাই আলাদা।
চপল মৃদু হাসে। মনে মনে ভাবে, তার মতো লাড্ডুমার্কা ছেলের হবে বিসিএস, তাহলেই সেরেছে।
কিন্তু মুখে কিছু বলল না। হতভাগা মেজদটা স্বপ্নের মধ্যেই থাক।
বউদি আসেনি?
একটা ম্লান হাসি দিল মেজদা।
তা মামা তোকে জামিনের ব্যাপারে কিছু বলছে?
চপল মাথা নাড়ায়।
ভগবান জানে, কতদিন এ গরাদের ভিতরে থাকতে হয়। খুব কষ্ট হয় বুঝলি, রাতে ঘুম হয় না, টেনশনে, মনে হয় ঘুমালেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলাইয়া দিবো। দিতেও পারে, কত নিরপরাধী মানুষের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে হরহামেশা।
চিন্তা করিস না দাদা, মামা বলেছে দ্রুত তোকে ছাড়িয়ে নেবে।
কিভাবে ছাড়াবে, ¯িপ্রডি ট্রাইব্যুনালের কেস, তিন মাসের আগে তো জামিন নাই।
৮.
স্বপ্নদীপ নিয়ে বাজারে অনেক গুজব। অনেক রটনা। এখানে নাকি হাজার তিনেক টাকা ইনভেস্ট করে মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করা যায়। এটা অবশ্য পুরোপুরি গুজব নয়।
৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেছে এমন দুয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে স্নিগ্ধার। তবে এ আয় বাধাধরা কিছু নয়। ফিল্ডওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে। একমাসে ৪০ হাজার হলে পরে মাসে তা চারশ’তেও নেমে আসতে পারে।
স্নিগ্ধা এখন ভেতরকার অংকগুলো বোঝে, তবে পুরোপুরি নয়।
কিছু কিছু এখনো তার কাছে রহস্যময়। মনেহয় কোথাও একটা ফাঁক আছে; ধরতে পারে না। এজাজ সাহেবের কাছে বুঝতে গিয়েছিল। উনিও খুব একটা ক্লিয়ার নন।
ওবায়েদ একদিন কথায় কথায় বলছিলো, তোমাদের কোম্পানি ধরা খাবে।
বড়ো ধরণের একটা ধরা।
কিভাবে?
একেবারেই সিম্পল ম্যাথ। অন্যকিছুর কথা বাদ দেই, শুধু মেম্বার কালেকশনের কথা বলি। একজন মেম্বার হতে চাইলে প্রথমে তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় একটা একাউন্ট খুলতে হয়। তারপর আরো ৯ জনের একাউন্ট খোলাতে হয়।
তবেই সে হয় পূর্ণাঙ্গ মেম্বার, তাই না?
হুঁ।
ধরো প্রথম সার্কেলে ১০ জন একাউন্ট খুলল। তারা মেম্বার হওয়ার জন্য ৯ জন করে আরো ৯০ জনের একাউন্ট খোলালো। তাহলে দ্বিতীয় সার্কেলে হচ্ছে ১০০ জন। এভাবে তৃতীয় সার্কেলে হবে ১০০০ জন।
অর্থাৎ ১০ গুণিতক হারে বাড়বে। এ শহরে তোমাদের মেম্বার হওয়ার মতো কত লোক আছে, ধরি ১০ লাখ। পুরো ১০ লাখ লোকের একাউন্ট খোলাতে ৬ টি সার্কেলই যথেষ্ট। হিসেবে করে দেখো। যদিও এটা হবার নয়।
গবেটের সংখ্যা শতে ত্রিশের বেশি হয় না। তর্কের খাতিরে ধরলাম ১০ লাখই হলো। ৫ ম সার্কেলে পর্যন্ত যারা একাউন্ট খুলবে, তারা কিছু হলেও লাভ পাবে, নিদেনপক্ষে মেম্বারশিপ। কিন্তু ষষ্ঠ সার্কেলে এসে যোগ দেয়া ৯ লাখ মানুষকে মেম্বার হতে হলে ৯ জন করে আরো ৮১ লাখ লোক জুটাত হবে। এই লোক তারা পাবে কই? তারা তো মেম্বার হতে পারবেই না, উপরন্তু তাদের জমা দেয়া সাড়ে তিন হাজার টাকা খোয়া যাবে।
অর্থাৎ ১ লাখ লোক লাভবান হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৯ লাখ লোক। এতে তোমাদের কোম্পানির প্রফিট হবে সোয়া তিন শ কোটি টাকা! এটাতো একটা দিক, এরকম প্রতিটি কলকব্জায় এর ঠগবাজি।
ওবায়েদের কথা শুনে স্নিগ্ধার তো ভিরমি খাওয়ার দশা। এভাবে অলো-আঁধারির মাঝেই দিন কাটছে ওর।
অফিসের এনভারোনমেন্ট খুব মনমতো হয়েছে।
এতেই ও তৃপ্ত। কে কাকে ঠকালো, কে লাভে লাল হলো- এতো কিছু জেনে তার কি হবে! মাস শেষে বেতনটা পেলেই হলো।
৯.
চপল মাত্র খেতে বসেছে, নির্মল দা’র লন্ড্রির খোকন এসে জানালো, থানার কোন্ দারোগা নাকি তাকে ফোনে ডাকছে। প্রথমবার ও খোকনের কথা বোঝেনি। ছেলেটা আপনা থেকে আবার রিপ্লাই করল।
আমার কাছে দারোগা কেন ফোন করবে? আমি একটা মানুষ হলাম। সারাজীবন কয়েদখানায় পুরে রাখলেও কেউ এসে খবর নেবে না- তাকে আবার দারোগার কি কাজ? চপল মনে মনে ভাবল। নাকি খোকন ভুল শুনেছে!
খোকন চোখমুখ পাকিয়ে হাজারটা দেব-দেবীর দিব্যি কাটাতে লাগে।
সালাম ভাই লিডার মানুষ, তার সাহস একটু বেশি। তিনি হাত থেকে মোটা চালের ভাতগুলো ঝরঝর করে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার পরিচিত কোন দারোগা-টারোগা আছে ?
চপল রোবটের মতো ঘাড় নাড়ায়।
বড়ো সমস্যার কথা, দেশের পরিস্থিতি তো ভালো না, কাল দেখলা না পুলিশ কেমন ট্রাক বোঝাই অস্ত্র নিয়া যাইতাছে... তোমার পরিচিত কেউ আছে নাকি স্মাগলারিং-টাগলারিং করে...
হুট করে চপলের মেজদার কথা মনে পড়ল। মেজদা তো এ্যারেস্ট, পুলিশের জিম্মায়, তার জন্য নিশ্চয়ই পুলিশ চপলকে খুঁজবে না।
চপল আবার মাথা নাড়ায়।
সালাম ভাই বাঁ-হাতে ডান-হাতের আস্তিন টেনে নিয়ে বললেন, খারাপ কোনো কাজে যখন নাই, পলিটিক্সও করো না... তয় আর ভয় কি- আল্লা ভরসা।
চপলের হৃদপিণ্ডটা কানের কাছে এসে ঢিবঢিব করেছে।
ইচ্ছে হচ্ছে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু চপল তো দৌড়াতে পারে না, তার এ্যাজমা।
মোবাইলের অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো পুলকের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ, দোস্, এতো দেরি ক্যান, আমার তো বারটা বাজায়া দিছো। আগেও একদিন ফোন করছিলাম, হালায় তোরে ডাইক্যা দেয় না, কয় কি কইবেন কন? আমি কইলাম কি জানোস...। পুলকের কথা যেন আর থামে না।
ওর চরিত্রটাই এমন। যখন খুব জোশে থাকে, মুখ থেকে অনর্গল আঞ্চলিক বুলি বেরোয়। এমন সিটিউশনে বুঝে নিতে হবে একটা খুশির খবর আছে। সেই খবরটা শোনার জন্য চপল মনে মনে প্রস্তুত হল।
এ্যাই তোর চাকরি-বাকরি কিছু হইছে।
না।
তাইলে কাইলকা চইলা আয় আমগো বাড়ি।
দোতলায় উঠতে বাঁয়ে একটা বড়ো রুম, কাচারি ঘরের মতো। পুলকের বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকেন, রাজ্যের লোক কিলবিল করে ওখানে। আজ অবশ্য পুলকের বাবা নেই, পার্লামেন্ট বসেছেÑ তাই ঢাকায়।
চপল একবার উঁকি মারল সেই রুমটায়। দু'সেট সোফা আর কিছু এলোমেলো কাঠের চেয়ার। ভাঙা হাটের দৃশ্য।
পুলকের রুমের এক পাল্লা দরজাটা হাঁ করে মেলা। এতো তাড়াতাড়ি তো ওর ঘুম থেকে ওঠার কথা না।
চপলকে দেখে কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে এলো পুলক।
আয়, আয়।
কিরে আজ এতো আর্লি ঘুম ভাঙলো যে!
প্রতিদিন কি আর বেলা করে ঘুমুতে ইচ্ছে করে।
দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ হলো।
পুলক হুকুমের কায়দায় বলল, ইয়েস, কাম ইন।
বেয়ারা দু’মগ হরলিক্স মেশানো কফি দিয়ে এলো। ধূমায়িত মগে হরল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।