নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
পর্ব ১: Click This Link
পর্ব ২: Click This Link
পর্ব ৩: Click This Link
পর্ব ৪: Click This Link
***
স্বামীর জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষায় থেকে সন্ধ্যায় সাইকেলের ঘন্টা শোনে ময়মুনা। মামুন দেরী হলেও দিন থাকতে থাকতে ঘরে ফেরে। বিছানা থেকে উঠে দরজায় এগিয়ে যেতেই মামুন বলল,
একটা খারাপ খবর আছে।
কি?
ময়মুনার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় মন ভরে যায়
শহীদুলের বইন মন হয় বাচব না - মামুন বলল।
বাজারে এই খবরডা আসছে। তোমার কথা ঠিক। জরিনার জামাই সউদিতেই থাকে। খোঁজ লয় না, পয়সা পাতি দেয় না, নিরুদ্দেশ। কেউ কয় মইরা গেছে।
আহহারে! মাইয়াডা কাম করত তালুকদারের বাড়িত। তালুকদারের নস্ট স্বভাব। হেই হের সর্বনাশ করছে। পেট বান্ধানির পরে হুরমতি বেওয়ারে ডাকাইছে। আর নালি কাটতি গিয়া অখন সমানে রক্ত যাইতাছে।
আমি বারেক আর জব্বর গেছিলাম খবর শুইনা।
ময়মুনার চোখে পানি আসে। আপনে হাসপাতালে গেছিলেন? দেইখা আইছেন? আমি দেখতে যামু।
জরিনার সঙ্গে ছোট বেলায় অনেক খেলেছে। জরিনার বাবা মানুষটা দিলদরদী ছিল।
বিপদে আপদে খোঁজ নিয়েছে কত। তালুকদারদের অবস্থা যখন খারাপ ছিল তখন সেই তালুকদারদেও খোঁজ নিয়েছে।
বিষন্ন মন নিয়ে পাটিতে মামুন খেতে বসে। মুসুর শইলডা ভালা হইছে। মুসুর তো নাক বদ্ধ আছিল দেখছি।
তেল মালিশ করছ?
হা অখন ভালা
রাতের খাবার শেষ হয়। মামুনের চোখে ভাসছে হাসপাতালের দৃশ্যটা। গন্ধটা শুনলেই মনে হয় মৃত্যু মৃত্যু। সাদা কাফনের কাপড় দিয়ে মনে হয় পোষাক বানায় ডাক্তারেরা। আতঙ্কগ্রস্ত লাগে।
পুরুষদের অবশ্য ভিতরে ঢোকা নিষেধ। দুর থেকে দেখেছিল নাকে নল দিয়ে বাতাস দিচ্ছে আর মেয়েটা কাপড়ে ঢেকে পড়ে আছে নিথর দেহে।
গ্রামের মহিলারা ভিড় এড়াতে ঢুকতে না দেয়ায় কান্না কাটি করছে। সে জেনেছে ওর চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা লাগবে। দুই তিন লাখ।
আজকে রক্ত দিয়েছে, ডাক্তার বলেছে আজ রাতটা দেখে এম্বুলেন্সে ঢাকায় নিতে হবে কালের মধ্যে।
পরদিন ভোরে সাইকেল নিয়ে আবারও ছুটে যায় মামুন। দোকানে এমন ক্যাশ নাই যে এখন দেয়া যাবে। যাবার সময় ময়মুনা তাকে ডাকল। তার বিয়ের সময়ের বহু যত্নের একজোড়া কানের সোনার দুল দিয়ে দিল।
হাসপাতালে গেটে শহীদুল দাড়িয়ে ছিল। সে বলল রক্তপড়া থেমেছে আর জ্ঞান ফিরে পানি পানি করেছে।
****
সোমবার সকালে সমিতির ঘরে সালিশ হবে। তালুকদারের বাড়ির বিরুদ্ধে গ্রামের সবাই ক্ষিপ্ত হয়। তালুকদারের বাড়িতে জানানো হয় সে বাড়ি নেই।
উপস্থিত জনগণ জরিনাকে খারাপ মেয়ে বলে, বলে মাইয়া মানুষ ভালা থাকে না বইলাই পুরুষরা নষ্ট হয়। বৃদ্ধ লোকজন খারাপ মেয়ে গ্রামছাড়া করে গ্রাম পরিচ্ছন্ন রাখতে বলে।
মামুন সিদ্ধান্ত জানায় সে তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা করবে। শুনে বারেক জব্বর সবাই বলে যে অযথা পয়সা নষ্ট করে লাভ নাই। তার চেয়ে তালুকদাররে ডেকে মিটমাট করে দিলেই হবে।
সমিতির দু তিন জন তালুকদারের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠকে আগ্রহী হল।
গ্রামের হাফেজ সাহেব গণ্য মান্য লোক। উনি শরিয়ত অনুযায়ী চার জন স্বাক্ষী ছাড়া কোন পুরুষকে "জিনার" দায়ে অভিযুক্ত করা কবির গুনাহ বলে ঘোষণা করেন। শুক্রবার দিন বাদ জুম্মা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে এই বলে সবাই বাড়ি ফিরে আসে। তবে কিছু বখাটে তরুণ সালিশে হৈ চৈ করে তারা তালুকদারের ফাসি চাই বলে মিছিল করে।
সোমবার দিন বাজার জুড়ে উত্তেজনা থাকে । শহীদুলের বৃদ্ধা মা বাড়িতে একলা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাকে অবস্থা দেখতে দুপুরে খেয়ে একটা বাটিতে কিছু রান্না করে দিয়ে আসে মামুন। সারাদিন দোকান বন্ধই থাকে। দুএক দিন না খুললে কিছু হবে না।
শহীদুলদের দুর সম্পর্কে চাচাতো ভাই বোনেরা খবর পেয়ে আসে। সুতরাং শহীদের মা নিয়ে ভাবনা কমে যায়।
এদিকে মঙ্গলবার ভোর থেকে মুষল ধারায় বৃষ্টিতে গ্রাম প্লাবিত হয়। মামুন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর অনুভব করে শরীরে। শহীদুল জানিয়ে যায় তার বোনের অবস্থার অবনতি হয়েছে।
তবে অবিলম্বে পাঁচ হাজার টাকার লাগবে। মামুন গা গরম নিয়েই দোকানে আসে। ক্যাশ থেকে এক হাজার দেয়। বাকিটা বারেক মিয়ার কাছে পাওয়া যায়। পরের মাসে পচিশটাকা হারে সুদে চার হাজার টাকা ফেরত দেবার শর্ত নির্ধারিত হয়।
শহীদুল টাকাটা নিয়ে মামুনকে জানিয়ে যায় যে তার এক চাচী এসেছে। হাসপাতালে সে না থাকলেও হবে। সে বিষ্যুদবার থেকে সে দোকানে বসবে।
তারপর দুটো দিন জ্বরের ঘোরে মামুন মাথা তুলতে পারে নি। ময়মুনা জলপট্টি দিয়ে বুকে শরিষার তেল মালিশ করে, নামাজ পড়ে খোদার কাছে প্রার্থনা করে স্বামীর আরোগ্য চায়।
ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে মামুনের খারাপ লাগে। জ্বর নেমে গেলে দুর্বল শরীর নিয়েই বিষ্যুদবার দোকানে আসে মামুন।
ঝক ঝকে রোদ উঠেছে বাইরে। মাথার উপর চিল চক্কর দিচ্ছে। দোকানের কাছে এসে ফের দুর্বলতায় আক্রান্ত থাকে।
মাথাটা চক্কর দেয়। শহীদুল তখনো আসে নি। দোকান তালা ঝুলছে। সে সামনের ঝাপিটা না খুলে পিছনের ছোট দরজার চাবি খোলে। দোকানের মালপত্র রাখার ঘরটাতে ঢুকে খাটের উপর কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
ঘুমের ভেতর দু'এক বার মনে হয় শহীদুল এসেছে। দোকানটা খুলেছে। বেড়ার ওপাশে মসুরির ডালের দাম দর করছে, এলাচি লবঙ্গ কিনছে, সাগুদানা কিনছে কেউ। কতক্ষণ অন্ধকার ঘরটাতে শুয়েছিল মামুনের মনে নেই। এক সময় তার ঘুম ভাঙে।
দোকানে একটা পরিচিত একটা মেয়ের গলা শুনতে পায়। সুরাইয়া এসেছে?
জরিনাবুর শইল কেমন? কবে আইসো?
একটু ভালা, স্যালাইন দিতাসে। আইজই দোকান খুলছি।
খস খস শব্দ হয়। যে মোবাইলডা দিসিলা আমারে, ফিরত দিবার আইলাম।
এইডা বেইচা জরিনাবুজানের চিকিসসার টেকা যোগাও।
ও পাশে চুপচাপ। শহীদ অনিচ্ছুক ভাবে সুরাইয়ার কাছ থেকে তার উপহারটা ফেরত নেয়।
তুমি অনেক ভালা, সুরেহা। আমি যা দিসি নিবার চাইনা।
আরে পুরুষ মানুষ ফোস ফোস কান্দনের কি অইছে? এর চায়া ভালা জিনিস দিও পরে
আর ..
আমার বিয়া হইলে আমার জামাই কত্ত সেট দিবো - পরিস্থিতি হালকা করতে চায় মেয়েটা।
কারে বিয়া? মমিন্যারে? দু:খের ভেতর ক্ষেপে যায় শহীদুল।
কেউরে না, একটা খবর কই। বাজারের বারেক মিয়া, ঘটক দিয়া বিবাহের প্রস্তাব পাঠাইছে।
কি কও?
হ! আমারে প্রায়ই দুর থন ডাকে।
এইডা ওইডা সাধে। বাপের বয়সী মানুষ, বুঝি নাই। আর উনার মাইয়া আমার ইস্কুলে পড়ে ।
তুমি কি কইছ?
মায়েরে কইছি, শিক্ষিত মানুষ ছাড়া বিয়া করণ ঠিক না।
মামুন ভাইজানের বলে জ্বর?
হ,
মামুন ভাইজানের কথা আম্মারে কইছি।
উনি শিক্ষিত মানুষ বইলাই না কত ভালা। কত দিন একলা দোকানে আইছি। কত কথা কইছি। কই কোন দিন তো কুনজরে চায় নাই!
শহীদুল দোকানের ঝাঁপি খোলার পর ছোট ঘরে আসে নি, তাই মামুনকে দেখে নি। সে নি:সংকোচে বলল, মামুন ভাইজান মানুষডা ফেরেশতার মতন।
এমন সময় কিছু একটা নিয়ে মৃদুস্বরে বচসা হয়।
সুরেহা, এই টেকা আমি নিমুনা।
আরে নেও। অত শরমের কি, চুরি করি নাই। বুবুর ভাল হয়া ফিরুক এর পরে ফিরত দিও।
সুরাইয়া চলে যাচ্ছে। মামুন তার অবস্থান জেনে নিজেকে পাল্টে ফেলল। মেয়েটা হয়তো অন্যদিনের মতো সুন্দর একটা জামা পড়েছে। টুকটুকে লাল সেণ্ডেলে ফিতে। তার বহুদিনের জমানো টাকাগুলোও দিয়েছে শহীদুলের জন্য ..এটা ভাবতে কোথাও একটা অহংকার হল তারও।
মামুন উঠে বসল। অসুস্থ শরীর অস্বীকার করে ভাল লাগাটা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ:।
(শেষ)
----
গল্পটা ছয় পর্বে শেষ করার পর মনে হল, শেষ দুটি পর্ব বাদ দিয়ে শেষটা অন্য ভাবেও হতে পারত। দ্বিতীয় ভাবনাটিও দ্রুত তুলে দিলাম।
ড্রাফট ২.০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।