আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সকল গরু অদৃশ্য হয়ে গেছে

আমি তোমায় বুঝেছি সমগ্র বুঝহীনতার ভেতর দিয়ে।

খুব পরিচিত একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করা যাক। এতই পরিচিত যে, এই কৌতুক শুনে কেউ এখন আর হাসে না। কোন একজনকে নাকি নদীর রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। বেচারার ঈমান ছিলো মুখস্ত বিদ্যায় আর কিছুতেই না।

তিনি মুখস্ত করেছিলেন গরুর রচনা। লিখতে শুরু করলেন, ‘নদীর নাম মধুমতি। নদীর পাশে বিশাল একটা মাঠ। মাঠে একটা গরু বাধা ছিলো। গরু একটা গৃহপালিত প্রাণী।

গরুর দুটি চোখ-দুটি কান-দুটি শিং….’। গরুর রচনা- আমরা কারো কোনো লেখাকে তুচ্ছ করার জন্য হর-হামেশা এটা বলে থাকি [কাউকে তুচ্ছার্থে বলি গরু, আমিও জীবনে অনেককবার শুনেছি]। একবার টিউটোরিয়ালে প্রশ্ন ছিলো ‘রেনে ডেকার্টকে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয় কেন’?, আমার এক বন্ধু ‘রেনে ডেকার্টকে জনক কেন বলা হবে না, যেহেতু তিনি দর্শনের জনক, যেহেতু বলা হয়ে থাকে’, এই টাইপের কথা-বার্তা দিয়ে পাচ পৃষ্ঠা সাবাড় করে দিলো। এই নিয়ে ম্যাডামসহ আমরা বাদ-বাকি পোলাপান ক্লাসে ব্যাপক হাসাহাসি করলাম। কে যেন বলল এটা হলো গরুর রচনা।

আবার হাসাহাসি। আসলে কি গরুর রচনা। কোন রকমে কিছুটা লিখে দিলেই কি গরুর রচনা হয়। অথবা একজাতের শিক্ষক আছে, তারা পৃষ্ঠা গুনে নাম্বার দেন। এই শিক্ষকের পরীক্ষাগুলোকে কেউবা গুরুত্ব দেয় না আবার কেউ স্বভাবজাত প্রতিভায় যা ইচ্ছে তা লিখে দিয়ে আসে।

আমার এক বন্ধু ইস্কুলে বাংলা খাতায় লিখেছিল, ‘দেখা হে পেহেলী বার, সাজান কি আখো মে পেয়ার…’। এগুলোকেও বলা হয় গরুর রচনা। শেষ পর্যন্ত গরুর রচনার গুরুত্ব না বুঝে আমরা তাকে হেলার-ঠাট্টার বিষয় বানিয়ে ফেলেছি। অথচ, ছোট বেলায় যে গরুর রচনা লিখেছি তার অসাধারণ মূল্য ও মর্যাদা আছে- সেটা আমরা খেয়াল করি না। ক্লাস সিক্সে ইংরেজীতে প্যারাগ্রাফ ‘দি কাউ’ আর বাংলায় রচনা ‘গরু’।

বিড়ালের রচনা আসলেও একই ফর্মুলা, এধার-উধার মাত্র। তো গরু কেন? গরু এবং হাম্বা এই বঙ্গদেশে বর্ণপরিচয়ের মতো। যদিও এই শহরে এমনকি আজকের দিনে গ্রামে গরু দুস্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। এক কুরবান ঈদে এই জ্যান্ত প্রাণীটাকে দেখা যায়। যখন আমরা কোন একটা জিনিসকে ব্যাখ্যা করতে যাই- তখন আসলে তার চারপাশে ঘুরে আসি।

গরুর রচনা আর তো কিছু না, চেনা-জানা গরুর চারপাশে ঘুরে আসা। ব্যাখ্যার প্রথম ধাপে চেনা জিনিস দেওয়ার সুবিধা আছে। এতে ব্যাখ্যা দেবার ফর্মুলা শিখতে হয় না। দেখে শুনে বুঝে মনের মধ্যে সহজে সেট হয়ে যায়। আর দেখা এবং শ্রুতির মধ্যে তো পার্থক্য আছেই।

তাহলে এটা হলো কোন কিছুকে কিভাবে পরিচিত করতে হয়, তা শেখানোর প্রথম ধাপ। একেবারে বস্তুগত বিষয়। কোন ছলনা নাই। এর মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করার, বর্ণনা করার প্রবণতা তৈরী হয়। [যদিও জৈন দর্শন মতে দুনিয়ার কোন জিনিসকে সর্বাংশে চেনা যায় না, আসলেও তাই- তারপরও এটা ধরে নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন?] দুনিয়াতে কল্পনাশক্তির দরকার আছে।

কল্পনাশক্তির ব্যাপ্তি অনাগত সময়কে নিজের মতো সাজানোরও ফুসরত দেয়। কিন্তু তার আগে থাকা চাই দেখা দুনিয়াকে বা বস্তুকে বর্ণনা করার ক্ষমতা। শিশু মনের মধ্যে যে দুই তিনটা প্রাণীর ডাক কড়া ছাপ ফেলে, সেগুলো হলো হাম্বা, ম্যাও, কা-কা-কা। এই চেনা জানা জিনিসগুলোকে নিয়ে বেশি ততপরতা দেখালে সাধারণ দেখার বাইরে যে আরো কিছু আছে সেটা পষ্ট হয়। আর তা যখন বইয়ের মধ্যে উঠে আসে তখন শুধুমাত্র মুখস্ত করার চেয়ে নিজের দেখাকে বলতে পারার সুযোগ ঘটে।

এই সুযোগও আসে কে কতো ভালোভাবে দেখল তা পরীক্ষা করার। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার বটে। অবশ্যই সেই সুযোগ মুখস্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আবার কল্পনার জগতের ব্যাখ্যাও চেনা জানা জগতের জিনিস-পত্তর দিয়ে হয়। যে দেখা দুনিয়াকে সুক্ষভাবে বর্ণনা করতে পারে না, তার পক্ষে অদেখা-বানানো দুনিয়ার বর্ণনা দেয়া সহজ নয়।

অসম্ভবও হতে পারে। এটা যুক্তি পদ্ধতির মতো। জানা থেকে অজানায় যাওয়ায়। এর ভেতর নিয়ে একটা পদ্ধতিও তৈয়ার হয়। কিন্তু গরুর রচনার এই বিষয়টা কি আমরা সহজে খেয়াল করি।

মনে হয় না। বরং, গরুর রচনা ব্যর্থ লেখকের কপালে কলংকের তিলক চিহ্ন হয়ে জ্বলজ্বল করে। গরুর রচনার মধ্যে কি কি থাকে। গরুর দৈহিক বর্ণনা, উপকারিতা আর ক্ষেত্র বিষয়ে গরু রেগে তেড়ে আসে এবং গরু একটি উপকারী প্রাণী। এই বর্ণনার মধ্যে বাহুল্য নাই-অতি প্রশংসা নাই।

আছে সহজভাবে দেখা। গুনের বর্ণনা। কিন্তু এই গরুর রচনা থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা কি শিখি। কিছুই শিখি না। বড়জোড় বড়ো একটা লেখা কিভাবে ধৈর্য্য ধরে মুখস্ত করতে হয় আর লিখতে হয় তা শিখি।

এর বেশি আর কি দরকার। কিন্তু সেই গরুর রচনাটাই শিখি না। যা শিখি, সেটাও ভুলে যাই। কেননা, আমাদের বয়সকালে কোন রচনাই আসলে গরুর রচনা থাকে না। নিজ নিজ মতাদর্শ, স্বার্থ, ধামা ধরতে গিয়ে আমরা লিখে যাই।

সেইখানে কেউ ভিলেন কেউ নায়ক। কিন্তু কেউ একটা প্রকৃত গরুর মতো বর্ণিত হয় না। তাই আমাদের কোন প্রকৃত ইতিহাস নাই। তা প্রতিমুহুর্তে নির্মিত হয়। নানা জনে নানা ভাবে।

বাল্যকাল অপাপবিদ্ধ সময়। বড়ো হতে থাকলে পাপের খাতাও খুলে যায়। এখন যদি গরুর রচনা লিখতে যাই- সেই গরু হয়তো আকাশে উড়বে নয়তো গাছে থাকবে। এর চেয়ে এই ভাবি- আহা, গরু সকল অদৃশ্য হয়ে গেছে। > পোষ্টে ব্যবহৃত ছবি নেয়া হয়েছে মানি সেভিং মম সাইট থেকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।