নিউক্লিয়ার চুল্লীতে ঘটানো হয় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। বিক্রিয়া মানেই পরিবর্তন আর সাথে সাথে তাপশক্তির আদান-প্রদান। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৌলসমূহের কোন পরিবর্তন হয় না, কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় মৌলেরই পরিবর্তন হয়। দুইভাবে এই ঘটনা ঘটে- যখন দুই বা ততোধিক মৌল যুক্ত হয়ে একটি মৌল গঠন করে তখন বলা হয় ফিউশন, আর উল্টাভাবে, যখন একটি মৌল ভেঙ্গে দুই বা ততোধিক মৌল তৈরি করে তখন বলা হয় ফিশন। উভয় প্রক্রিয়াতেই প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়।
এই শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে বানানো হয় পারমাণবিক বোমা অথবা বিদ্যুৎ।
গত দেড়-দু'শ বছরে তাপশক্তিকে কাজে লাগানোর তাপগতিবিদ্যার চর্চা হয়েছে প্রচুর। এ বিদ্যার মূলমন্ত্র তিনটি। প্রথম কলেমা লোকজনের মুখে মুখে- 'শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, কেবল শক্তির নানা রূপে রূপান্তর সম্ভব'। এই মন্ত্র 'শক্তির নিত্যতার সূত্র' নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় মন্ত্র বুঝাই যাচ্ছে শক্তির রূপান্তর সম্পর্কিত, কারণ অন্য কিছুতো সম্ভবই না। যান্ত্রিক, তাপ, আলোক, নিউক্লিয়ার, বিদ্যুৎ এরূপ নানাবিধ শক্তির রূপান্তরের পদ্ধতি বা যন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়-'এমন যন্ত্র সম্ভব নয় যা শতভাগ তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যান্ত্রিকশক্তি বানাতে পারে'। ২০-৪০ শতাংশের বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন তাপযন্ত্র এখনও বানানো সম্ভব হয়নি। আশেপাশে তাপ শক্তির ছড়িয়ে পড়ে এবং এর থেকে পরিবেশের বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মান্ডের নাকি বিশৃংখল হওয়াটাই চিরন্তন।
তাপরসায়নে বিশৃংখলা পরিমাপের জন্য -২৭৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ব্রহ্মান্ডের একটি সুষম স্ফটিককে বিশৃংখলাহীন 'প্রমাণ অবস্থা' ধরাই হলো সর্বশেষ তৃতীয় সূত্র। তাপগতিবিদ্যার এই জ্ঞান বর্তমান বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি।
মৌলের কথায় আসা যাক। হোমো স্যাপিয়েন্সের (মানুষ) সচেতনতার আবির্ভাব আর জগৎকে জানতে চাওয়া (কি!) একই সুতায় গাঁথা। পুরাকালে ভারতীয়রা পঞ্চভুতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম) বা ভুতচতুষ্ঠয়ের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ-চার্বাকরা) সমন্বয়ে জগৎ তৈরি বলে মনে করতো।
পরের দিকে খ্রিষ্টের প্রায় ছয়শ বছর আগে বৈশেষিক গুরু কাশ্যপ বা কণাভুক- কণাদ বিকাশ ঘটায় কণাবাদ বা পরমাণুবাদের। প্রায় একই সময়ে গ্রীসের ডেমোক্রিটাসরাও জড়িত ছিল একই চর্চায়। পরমাণুবাদের মোদ্দা কথা হলো 'জগৎ তৈরির ক্ষুদ্র এককের' ধারণা ভারতীয়রা বলে কণা বা অণু/পরমাণু, ইংরজরা বলে অ্যাটম যা আর ভাংগা যায় না। এরপর প্রায় দুইহাজার বছর এ নিয়ে তেমন নাড়াচাড়া হয় নি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পরমাণুবাদ পুনরায় আলোচনায় নিয়ে আসে ডাল্টন।
এখন এই ধারণায় নানাবিধ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। অবিভাজ্যতার ধারণা পাল্টে পরমাণুতে খোঁজ মিলেছে তিনটি মৌল কণিকার। ঋণাত্নক (ইলেকট্রন), ধনাত্নক (প্রোটন), ও নিরপেক্ষ (নিউট্রন) আধানযুক্ত (চার্জ) তিন ধরণের কণিকার ভরও ভিন্ন ভিন্ন। পরমাণু আধান নিরপেক্ষ (নিউট্রাল)। সাধারণভাবেই তাহলে পরমাণুতে ঋণাত্নক ও ধনাত্নক আধানযুক্ত কণিকা সমান হবে।
কণিকাদেরও কাটা ছেড়া করে বেরুচ্ছে কোয়ার্ক! তবে এই তিন মৌল কণিকার ধারণার উপর ভর করেই বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত জগৎকে বিশ্ল্যেষণ করে ও কাজে লাগায় নানান কারিগরিতে।
পরমাণুর আয়নামহলের রুপের সাথে মানুষের পরিচিতি পুরাকাল থেকেই। রাদারফোর্ড পরমাণুর রূপ বর্ণনায় প্রথম একে তুলনা করে সৌরজগতের সাথে। সৌরমণ্ডলের সাথে রাশিচক্রের যোগসাজশে মানুষ ও প্রকৃতির গতিবিধির কি এক মনোরম জ্যোতিষ বিজ্ঞানের চর্চা ছিল ভারতে! ডিমের কুসুমের মতো সৌরজগতের কেন্দ্রে যেমন থাকে সূর্য, ঠিক তেমন পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ধনাত্নক আধানযুক্ত ও নিরপেক্ষ কণিকাসমূহের যুথবদ্ধ অবস্থান। যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে গ্রহসমূহের ন্যায় ঋনাত্নক আধানযুক্ত কণিকাসমূহ বিভিন্ন দুরত্বে সদা ঘূর্ণয়মান থাকে। দুরত্ব অনুসারে ধরা হয় বিভিন্ন শক্তিস্তর। কেন্দ্র হতে বিভিন্ন দুরত্বে ঘূর্ণয়মান এই কণিকাসমূহের শক্তিস্তরের পরিবর্তন বা আন্তঃকণিকার বিভিন্ন শক্তির গণনায় ধ্রুপদি পদার্থবিদ্যা অপ্রতুল হলে আবির্ভাব হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার (মেকানিক্স)। বস্তু ও শক্তির ভিতর সম্পর্কায়ন করে সাড়া ফেলে দেয় আইনস্টাইন।
মূলত চার ধরণের শক্তি- মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকীয়, শক্তিশালী আন্তনিউক্লিয়ার ও দুর্বল আন্তনিউক্লিয়ার শক্তি আছে জগতে।
সব শক্তিই এক শক্তি একথা বলার সাধনায় আছে অনেকে। (ভারতীয় শৈব বা শাক্তরা শিব বা কালির পূজা মাধ্যমে শক্তির পূজা করে)। তড়িৎচুম্বকীয় ও দুর্বল আন্তনিউক্লিয়ার শক্তি একীভুত করে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পায় আব্দুস সালাম।
পরমাণুর কথাতেই মনোনিবেশ করা যাক। ধনাত্নক কণিকার সংখ্যা ১ হতে শুরু করে শতাধিক পর্যন্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু তৈরি করে।
তবে এর মধ্যে ৮৮টি স্থায়ী প্রাকৃতিক মৌল বাকিগুলো প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম অস্থায়ী মৌল। অস্থায়ী মৌল মানেই তেজষ্ক্রিয় মৌল। নিউক্লয়াসের ধনাত্নক ও ঋণাত্নক কণিকার অনুপাতের হেরফেরের কারণে যখন কোন মৌল ভেঙ্গে যায় তখনই নির্গত হয় আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। ভিন্ন ভিন্ন শক্তি ও ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই রশ্মিসমূহই ছড়ায় তেজস্ক্রিয়তা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া।
ইউরেনিয়াম-২৩৫ মৌলকে (যা একটি তেজষ্ক্রিয় মৌল) চুল্লীর ভিতর পরমাণুর নিরপেক্ষ কণিকা (নিউট্রন) দ্বারা আঘাত করলে বিভিন্ন প্রকার ফিশন উৎপাদ যেমন নেপচুনিয়াম, প্লুটুনিয়াম, অ্যামরেসিয়াম ইত্যাদি ও প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। ২৩৫ গ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে ফিশনের মাধ্যমে প্রায় ২০ টেরা জুল শক্তি উৎপন্ন হয়। ২০ টেরা জুল শক্তি মানে প্রায় ৭৫ লক্ষ ঘোড়া এক ঘন্টায় যে পরিমাণ কাজ করতে পারে। কিন্তু মাত্র ৪% ইউরেনিয়াম শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগে বাকি ৯৬% চলে যায় বর্জ্যের সাথে। আর তাপগতিবিজ্ঞান থেকে আমরা জানি যে মাত্র এক তৃতীয়াংশের মতো তাপকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারি বাকিটা ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে।
ব্যাপক পরিমাণে তৈরি হওয়া এ্ই তাপশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পানি চালনা করে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয় সার্বক্ষনিক। তাপের সাহায্যে পানি গরম করে উৎপাদিত বাষ্পের দ্বারা ঘুরানো হয় টারবাইন। তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ।
শক্তি উৎপাদনের এই ফ্রাংকেনস্টাইন মানুষের জন্য বহু দুর্যোগ নিয়ে এসেছে এবং নানান অজানা দুর্গতি অপেক্ষা করছে মানুষ ও আমাদের প্রিয় এই আবাসের জন্য।
১ম পর্ব
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।