চিত্ত যেথা ভয়শূন্য রাজনীতি এবং জামায়াত সম্পর্কে কয়েকটা ভ্রান্ত ধারণা জনমানসে প্রোথিত হয়ে গেছে। ইদানিং মিডিয়াতে কখনো কখনো উপস্থাপক আলোচকদের এই বিষয়ে দুর্বল আলোচনা বেশ ব্যথিত করে। জামায়াত একটি নিবন্ধিত দল, নির্বাচন করে, সংসদে বসে তাই জামাত একটি গণতান্ত্রিক দল, এই হচ্ছে কারো কারো ভাবনা। এ বিষয়ে সকলের বোধ্য আলোচনাও দুর্লভ।
প্রথমত জামায়াত কখনোই মৌলবাদী শক্তি নয় ছিলও না কখনো।
ইসলামের মুল নীতিতে যারা আস্থাবান তাঁরা মৌলবাদী। মাহাথীর মোহাম্মদ বলেছেন, “আমি মৌলবাদী”। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, মৌলবাদ মানে হল মৌলিক নিয়মগুলো মেনে চলা। মৌলবাদ শব্দের অর্থ কোন ধর্মের মূলভিত্তি ও আদর্শকে নিগুড় অনুসন্ধান করে তা যথাযথরূপ অনুসরণে সচেষ্ট হওয়া। যারা সচেষ্ট হয় তাদেরকে মৌলবাদী বলে।
সেদিক দিয়ে জামায়াত মৌলবাদী নয় বরং সংস্কারবাদী, জামায়াত ইসলামের আধুনিকায়নে বিশ্বাস করে। ইসলামের মৌলিক ধারায় জামায়াত বিশ্বাসী নয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মউদুদী ইসলামকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছে, সেটা মৌলিক ইসলাম নয় বরং ইসলামের একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা। আয়াতুল্লাহ খোমিনী, হিজবুল্লাহ বা মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার উপর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ধারাগুলো প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী। মুল ইসলাম বা মৌলবাদী ইসলাম পুঁজিবাদ, রাজতন্ত্র এবং ব্যাক্তিতন্ত্রের বিরোধী।
ইসলামের সঙ্গে পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়া ব্যাক্তিতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও সভ্যতার সঙ্গে অন্তর্নিহিত সংঘাত আছে। জামায়াত মুল ইসলামকে বদলে ফেলে, নিজের একটা ব্যাখ্যা দাড় করায়। সেই কারণে জামায়াতের রাজনীতির মধ্যে পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা নেই, মৌলবাদও নেই। এই গেলো মৌলবাদের প্রশ্ন। এবারে আসুন আমরা দেখি গণতন্ত্রের প্রশ্নে।
গণতন্ত্র ও জামাতের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ধারনাটা আরও একটু ঝালিয়ে নেয়া দরকার। প্রথাগত রাজনীতির যে ধারা, বিশেষ করে বড় দলগুলো আমাদের যেভাবে গণতন্ত্র শেখায় সেটা হচ্ছে গণতন্ত্রে বহু দল থাকবে, তাঁদের নিজ নিজ দলের সমর্থক বাড়াবার অধিকার থাকবে। সে কারণে তাঁদের মত প্রকাশ ও মত প্রচারের অধিকারও থাকবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর দেশে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে মানুষ যে দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে তাঁরা সরকার গঠন করবে। এই হচ্ছে গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা।
এই ধারণা অনুসারে জামাতকে গণতান্ত্রিক দল না বলে উপায় নেই। কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রচলিত এই ধারণা গণতন্ত্র নয়। এগুলোকে গণতান্ত্রিক চর্চার উপায় বলা যেতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র নয়। ঠিক যেমন ধর্মীয় আচার পালন করলেই কেউ ধার্মিক হয়ে যায়না। গণতন্ত্র চর্চার হাজারো নিয়ম থাকতে পারে।
শাহবাগ যেমন তরুণদের মাধ্যমে জনগনের সার্বভৌম ইচ্ছা ধ্বনিত করেছে, এটাও একটা গণতান্ত্রিক চর্চা। তাই গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে ফারাক করতে পারাটা জরুরী। গণতন্ত্র যদি না থাকে তবে চর্চা অর্থহীন, প্রাণহীন আচারে পরিনত হয়।
গণতন্ত্রকে হয়ে উঠতে হয় নাগরিকদের প্রান ধর্ম। সেটা প্রতিষ্ঠিত হলে চর্চাও প্রান পায়।
তাহলে গণতন্ত্রের প্রান ধর্ম কী? গণতন্ত্রের প্রান ধর্ম হচ্ছে; ব্যক্তি সার্বভৌম, মানুষ স্বাধীন। একথাই আমরা সহজ করে বলি জনগণ সার্বভৌম। রাষ্ট্র নয়, সরকার নয়, দল নয়। জামাতের গণতন্ত্রের সাথে সংঘাতটা ঠিক এই জায়গাতেই, সংঘাতটা প্রান ধর্মের সাথেই। জামাত মনে করেনা জনগণ সার্বভৌম তারা বলে আল্লাহ (সৃষ্টিকর্তা) সার্বভৌম।
এই কথাটা বেশ ইসলামিক মনে হয়। কিন্তু ব্যাখ্যা করলে দেখবো ইসলামের মর্মার্থের সঙ্গে এই বক্তব্যের মৌলিক বিরোধ আছে। জামাত মনে করে জনগনের ভালো মন্দের বিচারের ক্ষমতা নাই, কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক সেটা বিচারের বিবেক বা ক্ষমতা জনগণের থাকেনা। অতএব, নিজের সংবিধান, নিজের বিধান, নিজের আইন নিজে প্রণয়নের ক্ষমতা জনগনের থাকেনা। সুতরাং, জনগণকে চলতে হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী।
বিশেষত সে বিধান জামাত যেভাবে ব্যাখ্যা করে সেভাবে।
আল্লাহ (সৃষ্টিকর্তা) সার্বভৌম, তিনিই সকল ক্ষমতার মালিক, এটা কেবল ইসলাম নয় সকল একেশ্বরবাদী ধর্মেরই শিক্ষা। কিন্তু বিশেষ করে ইসলামে জাগতিক সার্বভৌমত্বের একটা চমৎকার অভাবনীয় শিক্ষা আছে যেটা জামাত নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। ইসলাম একটি অসাধারণ ধর্ম এবং তাঁর বিচত্র সৃষ্টিশীল দিক বিভিন্নকালে দার্শনিক ও ভাবুকদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র এবং মানুষের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একটি জটিল দার্শনিক সমস্যার মীমাংসা প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের বিশেষ করে ইসলামের সম্পর্কটা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ধর্মের “সার্বভৌম” শব্দটি কী অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই সৃষ্টি জগতের শর্ত হচ্ছেন আল্লাহ (সৃষ্টিকর্তা), আমাদের অস্তিত্বের শর্ত তিনি, এই অর্থে সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় সার্বভৌম। কারণ পৃথিবী এনং পৃথিবীর সমস্ত প্রান সৃষ্টি করেছেন তিনি। কিন্তু বিশেষ করে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বাধীন ইচ্ছা এবং বিবেক সম্পন্ন করে। এই ইচ্ছা এবং বিবেককে ব্যবহারের সার্বভৌম ক্ষমতাও তিনি মানুষকে দিয়েছেন, সেই কারনেই মানুষ আশরাফুল মখলুকাত।
ঠিক এই জায়গায় অনেক নাস্তিক বলতে চান যদি এই মহাবিশ্বের সব কিছু সৃষ্টিকর্তাই প্রোগ্রাম করে থাকেন তবে সব অন্যায় ও অন্যায্য বিষয়ও উনার প্রোগ্রাম করা, এর দায় কেন মানুষের হবে। এই প্রশ্নটা বেশ জটিল এবং একটা দার্শনিক সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু আশরাফুল মখলুকাতের কনসেপ্ট এই দার্শনিক সমস্যাকে দূর করে। সৃষ্টিকর্তার কাছে থেকে সৃষ্টির সুবাদে যে সার্বভৌম ক্ষমতা আমরা পেয়েছি সেই ক্ষমতার কারনেই পৃথিবীর সব কর্মের কর্তা হয়ে উঠি আমরা, পৃথিবীর সকল কর্মের দায় এবং কৃতিত্ব আমাদের। সেকারণেই এই ভালো কাজের পুরস্কারের যোগ্যতা আমরা অর্জন করি এবং মন্দ কাজের শাস্তি পাওয়ার উচিত্ত্য তৈরি হয়।
ইচ্ছা ও বিবেকের সার্বভৌমত্ব আশরাফুল মখলুকাতের না থাকলে পৃথিবীতে আমাদের কৃত সব কাজের কর্তা থাকতেন তিনি এবং আমাদের পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত হবার ন্যায্যতা থাকতো না। যেখানে ব্যাক্তির সার্বভৌমত্ব ইসলামে নিশ্চিত করা হয়েছে সেখানে জামাতের শ্লোগান পৃথিবীতে “ আল্লাহর আইন” শুধু গণতন্ত্রের সাথে নয়, খোদ ধর্মের সাথেই সাংঘর্সিক হয়ে যায়। জনগনের সার্বভৌমত্ব যেখানে ইসলামে স্বীকৃত সেখানে জামাত সেটা অস্বীকার করে প্রকারান্তরে নিজেদেরকেই অগণতান্ত্রিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
সহায়ক সূচীঃ
গণতন্ত্র এবং ঘাতক নির্মূলের রাজনীতি। গণতন্ত্রের সঙ্গে জামাত-শিবিরের মৌলিক সংঘাতটা কোথায়? ফরহাদ মজাহার
What is Political Islam, by Charles Hirschkind
Islam and democracy, Uneasy companions, The Economist.
Islam and Democracy , Eliane Ursula Ettmueller।
Islam and Democracy September 2002 | Special Report by David Smock, United Institute of peace ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।