আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝেঙ হে: চিনের কলম্বাস ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
ঝেঙ হে: (১৩৭১-১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ) পঞ্চদশ শতকের চিনের মুসলিম অ্যাডমিরাল । তৎকালীন মিঙ সম্রাটের নির্দেশে বেশ কয়েকটি নৌ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- যে অভিযান নৌচালনাবিদ্যার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অ্যাডমিরাল ঝেঙ হে-এর নেতৃত্বে বিশাল নৌবহর চিন থেকে যাত্রা করে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল অবধি পৌঁছেছিল।

চিনা পন্যের বিনিময়ে জাহাজে তুলেছিলেন লম্বা গলার জিরাফ এবং ডোরাকাটা জেব্রা । সেই প্রথম জিরাফ আর জেব্রা দেখল চিনারা ... চিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ঝেঙ হে-র নৌ অভিযান ছিল এক নজীরবিহীন ঘটনা ... চিন আজ আফ্রিকা পুর্নগঠনের আত্মনিয়োগ করেছে ... যে পথ দেখিয়েছিলেন পঞ্চদশ শতকের একজন মুসলিম চিনা নৌ-সেনাপতি ... মিঙ সাম্রাজ্যের মানচিত্র। মিঙ সাম্রাজ্যের সময়কাল ১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ । এই সময়কালে চিনের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নত সাধিত হয়েছিল। বিশেষ করে মিঙ সম্রাট চেঙ জু-র সময়ে।

সম্রাট চেঙ জু-র সময়কাল: ১৪০৩ থেকে ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দ। তিনিই ঝেঙ হে কে সামুদ্রিক অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। নৌ অভিযানের পিছনে চারটি কারণ ছিল। (১) বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন। (২) ব্যবসা-বানিজ্য এবং (৩) সম্রাট-এর জন্য বিলাসবহুল সামগ্রী সংগ্রহ এবং মিঙ সম্রাট চেঙ জু-র প্রভাব ও প্রতিপত্তি দেখানো ।

১৩৭১ খ্রিস্টাব্দে চিনের ইউনান প্রদেশে ঝেঙ হে-র জন্ম । তার পারিবারিক নাম ছিল মা হি। পরিবারটি ছিল মুসলিম। তাঁর পূর্বপুরুষরা নাম সৈয়দ আজজাল শামশ আল দ্বিন, তিনি পারস্যের থেকে চিনে এসেছিল । ঝেঙ হে-র বাবা এবং দাদা দুজনেই পবিত্র হজ পালন করেছিলেন।

এভাবে বালকের চোখে সদূরের স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন। মানচিত্রে নানজিং। মিঙ আমলে চিনের রাজধানী ছিল নানজিং। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে মিঙ সৈন্যরা ইউনান প্রদেশ আক্রমন করে দখল করে নেয়। ঝেঙ হে তখন ১১ বছরের বালক।

তাকে খোজা করে নানজিং রাজদরবারে নিযুক্ত করা হয় ... কিন্তু, ঝেঙ হে-র ভবিতব্য ছিল অন্যরকম ... ... ব্যাখ্যা করি। চিনে তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছিল । অর্থাৎ, মিঙ সাম্রাজ্য ক্রমশ চিনজুড়ে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করছিল। ঝেঙ হে এই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় মিঙ সাম্রাজ্যের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন । পুরস্কার হিসেবে তাকে সরকারি পদ দেওয়া হয়।

এই শুরু ... এর পরের ঘটনা দ্রুত ঘটছিল। ঝেঙ হে। তাঁর সর্ম্পকে ঐতিহাসিক দলিলে লেখা হয়েছে ঝেঙ হে ছিলেন দীর্ঘদেহী। বলিষ্ঠ গড়ন, স্পস্ট অবয়ব, বাঘের মত চলন, পরিস্কার জোরালো কন্ঠস্বর। রাজপুত্র চেঙ জু বিদ্যমান শাসকের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান করেন এবং ঝেঙ হে রাজপুত্রকে সাহায্য করেছিলেন।

এতে ঝেঙ হে-র জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। সফল অভ্যূত্থানের পর রাজপুত্র চেঙ জু মিঙ সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। কৃতজ্ঞ সম্রাট ঝেঙ হে -র কাছে মিঙ সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর সমূদয় কর্তৃত্বের ভার অর্পন করেন। সম্রাট চেঙ জু । নৌঅভিযানের কারণ আগেই বলা হয়েছে এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল মিঙ আমলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণেই।

তৎকালীন সময়ে চিনারা ভারত মহাসাগরকে বলত পশ্চিম সমুদ্র। ঝেঙ হে কে Admiral of the Western Ocean উপাধি দান করে চৈনিক নৌবহর পরিচালনা করতে নির্দেশ দেন সম্রাট চেঙ জু । চিনের Suzhou-এর মানচিত্র। ঝেঙ হে-র নেতৃত্বে নৌবহর ভেসেছিল চিনের এই Suzhou বন্দর থেকেই । প্রথম নৌ অভিযাত্রায় ছিল ৩০০ নৌযান।

প্রতিটিতে নৌযানে ৫০০ নাবিক ও সৈন্য। সব মিলিয়ে ২৭/২৮০০০ সৈন্য! দৃশ্যটি কল্পনা করা দুঃসাধ্য। একটা প্রশ্ন উদয় হতে পারে । চিনের পুবে প্রশান্ত মহাসাগর। ঝেঙ হে সে দিকে পাড়ি জমান নি কেন? অবশ্য এর উত্তর দেওয়া যায়।

প্রথমত, চিনের কাছে পুবদিক ছিল অজানা। তবে ভারত, আরব এবং রোম চিনের পরিচিত ছিল। কাজেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়তেই ঝেঙ হে কে পশ্চিম সাগরে জাহাজ ভাসানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মিঙ সম্রাট। ঝেঙ হে-র জাহাজ। ঝেঙ হে-র নৌ বহরে নানা ধরনের নানা আকৃতির জাহাজ ছিল।

যেমন, ট্রেজার শিপ (যেখানে কাপ্তান (ঝেঙ হে) এবং তার সহকর্মীরা থাকত ), ইকুয়িন শিপ ( ঘোড়া এবং উপঢৌকন বহন করত) ... সাপলাই শিপ (খাবার বহন করত) ঝেঙ হে-র নৌবহর ব্রুনেই মালয় দ্বীপপুঞ্জ থাইল্যান্ড (তখন শ্যামদেশ) ভারত আরব এবং পূর্ব আফ্রিকার উপকূল ছুঁয়েছিল । বিনিময় হয়েছিল পণ্যের, প্রযুক্তির এবং সংস্কৃতির । তবে সবর্ত্রই যে সৌহাদ্য বিনিময় হয়েছিল, তা কিন্তু নয়, যুদ্ধও হয়েছিল। ঝেঙ হে অসম সাহসী বীর ছিলেন। সে কথা লেখা রয়েছে চৈনিক দলিলপত্রে।

ঝেঙ হে-র নৌপথ । চিনারা সোনা রূপা পোর্সেলিন আর রেশম দিত আর বিনিময়ে নিত অস্ট্রিচ, জেব্রা, উট, হাতির দাঁত এবং জিরাফ। চিনা শিল্পীর আঁকা জিরাফ। চিনা রাজকীয় বাগানে রাখা হত। ১৪০৫ এবং ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সর্বমোট সাতবার নৌঅভিযানে বেরিয়েছিলেন ঝেঙ হে।

নৌ পথ অবশ্য নতুন না। আরব উপদ্বীপের সঙ্গে চিনের ব্যবসা চলত অনেক আগে থেকেই, এমন কী রোমানদের সঙ্গেও চিনাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল । তবে ঝেঙ হে-র নৌ বহরের কলেবর ছিল বিশাল। সঙ্গে ছিল সৈন্যসামন্ত। কাজেই ঝেঙ হে-র নৌঅভিযান সাধারন বানিজ্য যাত্রা ছিল না।

তা ছাড়া আজকের মতো সেকালেও ভারত মহাসাগরে দলদস্যুদের বড় উৎপাত ছিল। ঝেঙ হে সেই সব নির্মম জলডাকুদের নির্মমভাবে দমন করেছিলেন। ঝেঙ হে। ঝেঙ হে-র নৌযাত্রা আরব বণিকদের বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল। ইতালির ভেনিসিয় বনিকদেরও বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল ।

এই প্রসঙ্গে জনৈক ঐতিহাসিক বলেছেন: : Zheng He's voyages are 87 years earlier than that of Columbus, 93 years earlier than that of Gama, and 116 years earlier than that of Magellan. ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে ঝেঙ হে। শেষবার নৌযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর এবং পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল অতিক্রম করে ফেরার পথে মারা যান ঝেঙ হে । বয়স তখন ৬৫। ইউরোপীয় নাবিকদের অভিযান শুরুর অর্ধশতাধিক বছর আগেই এক বিচিত্র নৌঅভিযাত্রা সম্পন্ন করেছিলেন ঝেঙ হে।

ঝেঙ হে -র মূর্তি। আজও চিনেরা ঝেঙ হে কে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঝেঙ হে-র জাহাজটি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এমন কী বড় জাহাজ নির্মান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এসব ঘটেছিল আত্মঘাতী রাজনৈতিক কারণে।

যার ফল ভালো হয়নি। নৌপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল চিন। পরে যখন বানিজ্য ও লুটপাত করতে ইউরোপীয়রা আসে, চিনারা তাদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। ইউরোপীয়রা চিনের সাথে অপমানজনক বানিজ্য চুক্তি করে এবং চিনের জনগনের ওপর আফিমের নেশা চাপিয়ে দেয়। বিস্তারিত দেখুন ... Click This Link 1421: The Year China discovered the World by Gavin Menzies বইটির প্রচ্ছদ সম্প্রতি গাভিন মেনজিয়েস 1421: The Year China discovered the World by নামে একটি বই লিখেছেন।

বইটিতে দাবি করা হয়েছে ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন ঝেঙ হে । যুক্তির স্বপক্ষে মেনজিয়েস তাঁর বইতে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের একটি মানচিত্র দাখিল করেন। মেনজিয়েস এর এই দাবি সত্য হলে নৌবিদ্যার ইতিহাসে ঝেঙ হে- এর অবদানের কথা নতুন করে ভাবতে হবে। শিল্পীর চোখে ঝেঙ হে- এর নৌবহর ছবি : ইন্টারনেট তথ্যসূত্র: Click This Link http://www.islamfortoday.com/zhenghe.htm Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।