সাদেকুর রহমান : স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতি বিভক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার দৃপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার ৪১তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়েছে। গোটা জাতি এদিন সংবিধান সমুন্নত রাখা, তাঁবেদার হটানো, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষুধামুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। স্বাধীনতার সূবর্ণ উৎসবের দশ বছর আগে এবার সরকারি ও বেসরকারি সকল আয়োজনেই ছিল ভাবাবেগের সম্মিলন, বাড়তি কিছু। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে স্বাধীনতা দিবস উৎসবমুখর ছিল। এ দিনের কর্মসূচির মূল কেন্দ্র সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় এবং ভোর থেকে দুপুরের পরও জনতার ঢল ছিল সেখানে।
জাতীয় দিবস উপলক্ষে গতকাল ছিল সরকারি ছুটি। এ দিনের রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামবেল ওয়াংচুকের সরব উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সকালে বর্ণাঢ্য শিশু-কিশোর সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ এবং সন্ধ্যায় জমকালো আতশবাজি স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
পরদিন ২৭ মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ আশ্বস্ত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশ্য স্বাধীনতার ঘোষক কে- তা নিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ইতিহাস বিকৃত করে সত্যকে অস্বীকার করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এদিন তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সূর্যোদয়ের সময় ৩১ বার তোপধ্বনি করে দিবসের অনুষ্ঠানমালার সূচনা করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সদরদফতরসমূহ, বিভিন্ন ইউনিট এবং ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ভবন, ফটক ও তদসংলগ্ন এলাকা, এমপি চেক পোস্ট এবং নৌবাহিনীর জাহাজসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
দেশের অব্যাহত শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রগতি কামনা করে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সব মসজিদে বিশেষ মুনাজাতের আয়োজন করা হয়। সূর্যোদয়ের সময় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুস্তবক অর্পণ করেন এবং উক্ত অনুষ্ঠানে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে সমন্বিত গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এদিকে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বাদকদল যথাক্রমে ক্রিসেন্ট লেক (সংসদ ভবন এলাকা), ফার্মগেটস্থ পার্ক এলাকায় এবং মিরপুরস্থ শের-ই-বাংলা জাতীয় স্ট্রেডিয়ামে বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করে। এছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, পুলিশ এবং আনসার ও ভিডিপি'র সম্মিলিত বাদক দল বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত বাদ্য পরিবেশন করে। এছাড়াও, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কয়েকটি জাহাজ সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা ও বরিশালে বেলা দুইটা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয়।
তিন বাহিনীর নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় সদরদফতর, ইউনিট, ঘাঁটি, জাহাজ এবং সৈনিক/শিপস কোম্পানি মেসগুলোতে প্রীতিভোজের আয়োজন করে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর হাসপাতালগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। স্বাধীনতা দিবসে সশস্ত্র বাহিনী এলাকায় প্রেক্ষাগৃহসমূহে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র বিনামূল্যে প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯টা থেকে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ সাহানে কুরআনখানি শুরু হয়ে সকাল ১০টায় শেষ হয়।
কুরআনখানি শেষে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ ও দোয়া পরিচালনা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতী মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। মুনাজাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। বাংলাদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মুনাজাতে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করা হয়।
এদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়াও রাজধানীতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবন এবং শেরে বাংলানগরে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাযারেও দেশপ্রেমিক জনতার মিছিল ছিল ভোর থেকেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধীদল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন র্যা লি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতীয় পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি পালন করে। গতকালের রাজধানী পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতা উৎসবের নগরীতে। জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানেও যথাযোগ্য মর্যাদাসম্পন্ন আয়োজন ছিল। এদিন বিকেলে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান বিশিষ্ট নাগরিক ও কূটনীতিকদের সংবর্ধনা দেন। জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।
ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যসমূহও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে।
জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রবীণ সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য ফয়েজ আহ্মদের ২৬ মার্চের স্মৃতিচারণ ও ক্লাব সদস্য সন্তানদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মৃতিচারণ সভায় জাতীয় প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নূরুল ইসলাম খান স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
ফয়েজ আহ্মদ দীর্ঘ সময় ধরে ২৬ মার্চের কাল রাত্রে নিঃসঙ্গভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবে আটকে থাকা, পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে আহত হওয়া ও কোনভাবে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এ ধরনের স্মৃতিচারণ খুবই কার্যকর হবে বলে মন্তব্য করেন।
কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর আমাদের নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে, আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে। আমাদের সকলকে সব ধরনের সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করতে হবে।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা মোঃ আবদুর রকিব এ্যাডভোকেট বলেছেন, সরকারের ঘারে সওয়ার বামপন্থীরা তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চায়। তিনি বলেন, দেশের জনগণ আজ গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে দেশের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলায় পর্যুদন্ত। দেশের উন্নতি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে কাজ করার পরিবর্তে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অশুভ তৎপরতায় আত্মনিয়োগ করেছে।
সকাল সাড়ে ৬টায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল ৮.৩০ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে দলের পক্ষ থেকে পুমাল্য অর্পন করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন দলের মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, আ.হ.ম. জহির হোসেন হাকিম, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, একেএম শাহজাহান, বাহারুল আলম বাহারসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। মহান স্বাধীনতা ও আজকের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন দিলু।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত উর্দূভাষী সংখ্যালঘু কাউন্সিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মাস্টার আলী আহম্মেদের সভাপতিত্বে এক আলোচনায় বক্তারা বলেন অধিকার প্রতিষ্ঠার বৈষম্যের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারীরা পাক শাসক চক্রের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে নির্বিগ্নে জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে জাতীয় ঐক্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে শহীদের আত্মার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাসনাইন, সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ আফজাল ওয়ার্সী অর্থ সচিব মোহাম্মদ আজগর আলী, দপ্তর সচিব মোহম্মদ মোক্তার হোসেন প্রমুখ।
আইই এস স্কুল এন্ড কলেজ অডিটরিয়ামে অধ্যক্ষ মোঃ মনজুরুল হকের সভাপতিত্বে স্বাধীনতা দিবসের উপর এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম। শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জনাব মোঃ আলাউদ্দিন, মোঃ হান্নান পাটোয়ারী ও ফারজানা ও আব্দুর রশীদ চৌধুরী। ন্যাপ ভাসানীর উদ্যোগে পার্টির কার্যালয়ে পার্টি চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হকের সভাপতিত্বে ‘‘স্বাধীনতা সংরক্ষণ জাতির জন্য অনিবার্য’’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন ন্যাপের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন মুন্না, সহ-সভাপতি এম এম আক্তারুজ্জামান, আবদুল হাই সরকার, তাজুল ইসলাম মাষ্টার, মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার হাসরত খান ভাসানী।
মহান স্বাধীনতার ঘোষক বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে জিয়া সমাজ কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে পুস্তবক অর্পন দোয়া ও মুনাজাত করা হয়। বিশাল মিছিল সহকারে পুস্পস্তবক অর্পন করেন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বিপুল ও সাধারণ সম্পাদক এম গিয়াস উদ্দিন খোকন, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফোরকান-ই আলম, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক দিদার আহম্মদ ভূঁইয়া, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ধানমন্ডি লেক চত্ত্বরে স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা সঙ্গীত উৎসব। বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ ও শিল্পকলা একাডেমী যৌথভাবে এ উৎসবের আয়োজন করে।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন, ইসলামী শাসনতন্ত্র শ্রমিক আন্দোলন ও গণফ্রন্ট ব্যাপকভাবে কর্মসূচি পালন করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।