আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টোবাগো- স্বর্গের রাজধানী

প্রবাসী

টোবাগো ক্যারিবিয়ান সাগরের ছোট দ্বীপ টোবাগো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপ রাস্ট্র “ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো । ত্রিনিদাদ আর ছোট বোন বা সিস্টার আইল্যান্ড টোবাগো দ্বীপ এই দুইয়ে মিলিয়ে ছোট এই দেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেই রমরমা দিন আজ আর নেই তবুও ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই ক্রিকেট । ব্রায়ান লারার দেশ ত্রিনিদাদ।

লম্বা এবং কালো খেলোয়াড়দের দিয়ে আফ্রিকার দেশ মনে হোলেও ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আমাদের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে এই দেশ। কলাম্বাস তার আমেরিকা অভিযানে এই দ্বীপ দেশের পাশ দিয়ে গেছিলেন দক্ষিন আমেরিকাতে। নোঙ্গর ফেলেছিলেন এই ছোট্ট দ্বীপে, পা রেখেছিলেন কিছু দিনের জন্য। তখন এই দেশ ছিল জংলি অসভ্যদের দেশ।

“ক্যারিব, আমের-ইন্ডিয়ান, আরাওয়াক” নামের অধিবাসিদের দেশ। আজও এই দেশ এবং দক্ষিন আমেরিকার মধ্যকার জলপ্রনালীর নাম কলাম্বাস চ্যানেল। রবিনসন ক্রুশো জাহাজডুবীর পর এই ড্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। ক্রিকেট ছাড়া আর কোথাও আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ খুজে পাওয়া যাবে না। কারনটা বুঝতে হলে একটু ইতিহাসের সাহায্য লাগবেই।

এই এলাকার ম্যাপে তাকালে চোখ পড়বে আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের কিছু নিচে থেকে দক্ষিন আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক গুলো দ্বীপ কয়েক হাজার মাইল জুড়ে। উত্তরে আমেরিকা, দক্ষিনে দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশ, পশ্চিমে ক্যারিবিয়ান সাগর আর পুবে আটলান্টিক মহাসাগর এই হল সংক্ষেপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর সীমানা। অধিকাংশ দ্বীপ গুলো ছিল বৃটিশদের দখলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বৃটিশ সাম্রাজ্য ভেংগে পড়ল। ১৯৫৮ সালে এই দ্বীপগুলোকে স্বাধীনতা দিয়ে বৃটিশ চলে গেলে গঠিত হল বৃটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপ পুঞ্জ বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

২/৩ বছর আগেও এ দেশের বিমান সংস্থার নাম ছিল "বৃটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এয়ার ওয়ে"। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ভালই চলল তারপর থেকে একে একে দ্বীপগুলো স্বাধীন হতে শুরু করল। একে একে জন্ম নিল অনেক গুলো স্বাধীন দেশ। কিন্তু টিকে রইলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। এদের মধ্যে সব গুলোই দ্বীপ এক মাত্র গায়ানা ছাড়া যেটা কিনা দক্ষিন আমেরিকার মুল ভুখন্ডে।

এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচে দক্ষিনের দেশ হল ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো। ছোট দেশ, মাত্র ৫,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। লোক সংখ্যা ১৩ লক্ষ। মাতৃভাষা ইংরেজী। গতবারের ক্রিকেট বিশ্ব কাপ আয়োজক ছিল এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর এই ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অফ স্পেনেই আমরা হারিয়েছিলাম ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতকে গতবারের বিশ্বকাপে।

কর্মসুত্রে কিছুদিনের জন্য ছিলাম ত্রিনিদাদে আর সেই সুবাদেই কাছের দ্বীপ টোবাগো ভ্রমন। এই দেশের জন গোষ্ঠীর শতকরা ৫০ ভাগ আফ্রিকান আর বাকি ৫০ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভুত। বৃটিশরা আফ্রিকা থেকে এনেছিল কালদের আর ভারত থেকে ভারতিয়দের কফি, কোকো আখ চাষের জন্য। সেই ১৮৪৫ সালে প্রথম এসেছিল ভারতিয়রা । যে দিন নোঙ্গর ফেলেছিল সেই ভারতীয়দের বয়ে আনা জাহাজ তা আজো পালিত হয় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে।

ধর্মএর বিচারে ৭০%ভাগ খৃস্টিয়ান, ২০ ভাগ হিন্দু ৬ ভাগে মুসলমান আর বাকি অনান্য ধর্মালম্বি। খৃস্টান প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের দেশের ঈদের মত হল এ দেশের বড়দিনের উৎসব। টানা কয়েক দিনের ছুটি। আর ছুটি থাকার কারনেই বিড়ম্বনাও বেশী , যাওয়া আসার টিকিট, থাকার যায়গা মানে হোটেল বা রেস্ট হাউজ় সব কিছুরই টানাটানি। প্রায় ১মাসে আগে পরিকল্পনা করে ফেরীর টিকেট কেটে রাখতে হয়েছিল।

দুই দ্বীপের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হল এই ফেরী । উড়োজাহাজ আছে, ভাড়াও তুলনামুলক ভাবে কমই কিন্তু ফেরীতে যাওয়ার কারন ছিল গাড়ী নিয়ে যাওয়া সাথে করে যাতে টোবাগোতে ঘুরতে কোন অসুবিধা না হয়। মুড়ির টিন বাস জানি সেই ছোট বেলা থেকেই, কিন্তু বিমান ও যে মুড়ির টিন বিমান হয় তা টের পেয়েছিলাম এই বিমানে চড়ে। নাম টোবাগো এক্সপ্রেস। ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের ফ্লাইট।

সিটে ছারপোকা ছিল কিনা বুঝতে পারি নি তবে ছেড়াখোড়া, ময়লা এ গুলো ছিল। দেশ বিদেশ ঘুরতে আমার বরাবরই উৎসাহ বেশী। তা সেবার বড়দিনের আগের দিন অর্থাৎ ২৪ শে ডিসেম্বর টোবাগো যাত্রা। সকালে ফেরী ছাড়ে পোর্ট অফ স্পেন থেকে আবার ফিরে আসে বিকেলে। আমাদের বাসা “সাংরে গ্রান্ডি’তে, স্প্যানিস নাম।

ইংরেজি এদের প্রধান ভাষা হোলেও দক্ষিন আমেরিকার অনান্য দেশের মত এই দেশেও স্প্যানিশ ভাষার প্রচলন আছে। পোর্ট অফ স্পেন থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের ঘর। ফেরি ছাড়বে সাড়ে ছয়টায়। বাসা থেকে রওয়ানা দিতে হল ভোর ৪ টায়,ঘুম থেকে উঠতে হল রাত ৩ টায় অর্থাৎ সে রাতের ঘুমটাই মাটি। আগে ভাগে যাওয়ার কারন হল ফেরীতে গাড়ী তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়তি সময়ের দরকার ছিল।

যাই হোক ৫ টার আগেই পৌছলাম পোর্ট অফ স্পেন ফেরী টার্মিনাল এ। চমৎকার দ্রুত গতির ফেরী। ত্রিনিদাদ থেকে টোবাগোর সরল রেখায় দুরত্ব ২২ মাইল হলেও ফেরীর রাস্তা অনেক পথ ঘুরে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপ গুলোর মধ্য দিয়ে ত্রিনিদাদের উপকুল বেয়ে ক্যারিবিয়ান সাগরের জলপথ পাড়ি দিয়ে আড়াই ঘন্টা পর পৌছলাম স্কারবোরো তে। টোবাগোর রাজধানী স্কারবোরো।

প্রথমেই নজর কাড়লো বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা ঢাউস আকৃতির ক্রুইজ শিপ। এসেছে মায়ামি থেকে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোতে ক্রুইজ অতি জনপ্রিয়। আমেরিকা বা কানাডার কোন বন্দর থেকে ছেড়ে ৫ দিন সাত দিন বা এক মাসের সমুদ্র দেখা এক রোমাঞ্চকর ভ্রমন ও বটে । আকার আয়তনে খুব ছোট দ্বীপ টোবাগো।

১০০০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশী আয়তনের এই দেশের লোক সংখ্যা মাত্র ৫০, ০০০, টোবাগো নাম হয়েছে টোবাকো বা তামাক থেকে । এই দ্বীপের আকৃতি কিছুটা তামাকের পাইপের মত, সেই থেকে এই নাম। পুরো দ্বীপ্ হল টিলা এবং বনভুমি। ফেরীথেকে নামতেই বিশাল বড় সাইনবোর্ড ইংরাজি তে লেখা “ ওয়েলকাম টু টোব্যাগো্, দি ক্যাপিটাল অফ দি প্যারাডাইস” –স্বর্গের রাজধানী? বলে কি? ভুল যে বলে নি তা বুঝেছিলাম দু এক দিনের মধ্যেই। অতপর আস্তানার সন্ধানে ।

ফেরীঘাট থেকে প্রায় ২/৩ কিলোমিটার দূরে ছোট রেস্ট হাউস। কিন্তু বেশ নিরিবিলি। গাড়ী থেকে মালপত্র নামিয়ে হাত্ মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই ট্যুর গাইড এবং ম্যাপের খোজে । বড়দিনের আগের দিন হওয়াতে দোকান পাট সব বন্ধ, ট্যুর গাইডরাও বড়দিনের জন্য ব্যাস্ত।

সুতরাং উচুনিচু পাহাড়ী পথ দিয়ে রওয়ানা দিলাম হোটেল থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দুরের বিমান বন্দরের দিকে। ক্রাউন পয়েন্ট বিমান বন্দর। ওখানে নিশ্চয়ই কিছু ট্যুর গাইড পাওয়া যাবে, কিন্তু না, কোন গাইড বা ট্যুরিস্ট সংস্থার খোজ পাওয়া গেল না। টোবাগো বিমান বন্দরের একটা বৈশিষ্ট হল রানওয়ে একেবারে সমুদ্রের কিনারে। একবার যখন বৃটিশ এয়ার ওয়েজের বিমান টোবাগোতে নামছে, ভয় হচ্চিলো এই বুঝি পড়লাম সমদ্রের পানি তে? বিমান বন্দরের কাছে এক দোকানে মিলল টোবাগোর ম্যাপ।

স্কারবোরোতে ফিরে চললাম। পথে পড়ল স্কারবোরো শপিং মল। ক্রিসমাস সেলের লোভে ঢুকে পড়লাম মলে। বেশ সস্তাতেই কিনে ফেললাম ৩/৪ টা শার্ট। এ সমস্ত দেশে বড়দিনে দাম কমে অথচ আমাদের দেশে রমজান এলেই সব কিছুর দাম বাড়তে থাকে।

এর পর থেকে ম্যাপের সাহায্য নিয়ে চলতে শুরু করলাম। বিকেলে গেলাম পিজন পয়েন্ট এ। নাম এমন হল কেন কে জানে ? একটাও কবুতর নেই তবে দারুন সুন্দর বীচ এটা। বীচে বসে সুর্যাস্ত দেখলাম। দ্বীপে বীচের সংখ্যা অগুনতি।

দ্বীপের পুর্বে আটলান্টিক আর পশ্চিমে ক্যারিবিয়ান সাগর। ক্যারিবিয়ান সাগরের বীচ গুলো কিছুটা শান্ত হলেও আটলান্টিকের বীচ গুলোতে উচু উচু ঢেউ। আমাদের কক্সবাজারের সাথে এ দিক কার বীচের পার্থক্য হল আকারে সব গুলি ছোট, আধ কিলোমিটার বা এক কিলোমিটার লম্বা, বালি গুলো মোটা মোটা এবং বাদামি, সাদা নয় । বীচের প্রসস্থতাও কম রাস্তা থেকে,২০/৩০ ফুট মত হবে। তবে পানি অসম্ভব পরিস্কার, ঘোলাটে নয়।

আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখবো। অসুবিধা যা হল তা বড়দিনের কারনে। সবকিছু বন্ধ। পরদিন সকালে একটু সকাল সকাল ই রওয়ানা দিলাম। বড় দিনের কারনে রাস্তাঘাট ফাকা।

উচুনীচু পাহাড়ী রাস্তা কিন্ত মসৃন। আঁকাবাঁকা হওয়ার কারনে গাড়ী চালাতে হয় সতর্কতার সাথে। প্রথমে গেলাম ফোর্ট জর্জ এ। পাহাড়ের উপরের পুরোন দিনের এই দুর্গ এখন চমৎকার যাদুঘর। চূড়া থেকে ডাইনে বায়ে অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।

এই সমস্ত পাহাড়ের চুড়াতে কামান নিয়ে বসে শত্রুর অপেক্ষায় আর শত্রু জাহাজ আসছে দ্বীপের দখল নিতে - মনে মনে ফিরে গেলাম কয়েকশ' বছরের পুরনো দিনে। পাহাড়ের উপর রাখা সে দিনের কামান বন্দুক অস্ত্রশস্ত্র। যাদুঘর দেখা হয় নি। অনেক বার মালিকানা বদল হয়েছে এই দ্বীপের। কখনও ডাচ, কখনো ফরাসী, এবং সব শেষে ইংরেজরা এই দ্বীপ দখলে রাখে।

অনেক যুদ্ধ হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে উপসাগরে খুজে পাওয়া পিতলের কামান এখন রাখা আছে ফেরী ঘাটের কাছের ছোট্ট পার্কে। দক্ষিন পশ্চিম হতে উত্তর পুর্ব হল দ্বীপের দুই প্রান্ত লম্বালম্বিভাবে আনুমানিক ৫০ কিলোমিটার। আর প্রস্থ হাবে সর্বোচ্চ২৫ কিলোমিটার মত। স্কারবোরো এবং অধিকাংশ মানুষের বাস এই দক্ষিন পশ্চিম কোনায়।

সমদ্রের কিনার ঘেষে আছে আরো কিছু ছোট ছোট শহর কিন্তু অধিকাংশ জায়গা ঘন বন পাহাড়ী এবং জন মানব হীন । স্কারবোরো থেকে সমুদ্রের ধার দিয়ে চমৎকার রাস্তা চলে গেছে উত্তর পুব কোনা পর্যন্ত একই রাস্তা বৃত্তাকারে পরিধি ঘুরে আবার শেষ হয়েছে স্কারবোরোতে এসে। অচেনা অপরিচিত যায়গা মনের ভিতর ভয় কিছু তো হচ্ছিলই। দ্বীপে কোন চাষবাস নেই, নেই কোন শিল্প কল কারখানা, এক মাত্র পর্যটন ই এদের মূল উপার্জন তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রশ্নাতীত। গাড়ী চলছে কখনো পাহড়ের উপরে আবার কখনো নেমে গেছে একেবারে সমদ্রের কিনারে।

চমৎকার সে দৃশ্য। পথে পড়লো ছোট একটা জলপ্রপাত। নাম “আরগিল ওয়াটার ফল” পাহাড়ী বনের মধ্য দিয়ে প্রায় মাইল খানেক হেটে যেতে হল । সেই উচু পাহাড়ের গা বেয়ে পানি নামছে ছোট লেক এ আর একটা খালের মধ্য দিয়ে ২/৩ মাইল দূরে সমদ্রে গিয়ে মিশছে। স্বচ্ছ পানিতে ভরা এই লেকে প্রচুর মাছ।

আমাদের দেশের বেলে মাছের মত এক রকম মাছই বেশী। ফিরে চললাম ওয়াটারফল দেখার পর। পথে পড়লো ছোট শহর ‘রক্সবোরো। রক্সবোরো পেরিয়ে চললাম উত্তর পুর্বের শেষ জনবসতি এবং দ্বীপের শেষ প্রান্তে। জায়গাটার না চার্লোটসভিল।

রক্সবোরো থেকে ১৫/২০ কিলোমিটার জনমানবহীন পাহাড়ীপথে চড়াই উতরাই পেরিয়ে যখন চার্লোটসভিল পৌছলাম সুর্য্য তখন মাথার উপর। পাহাড়ের উপর থেকে নিচে চোখে পড়ে ছোট উপসাগর। নাম পাইরেট বে । জলদস্যুরা এখানে এসে তাদের জাহাজের নোঙ্গর ফেলত কিনা কে জানে। বীচে স্নানে রত বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাদা কালো , বেশ কয়েক শ' মানুষ।

অপেক্ষাকৃত শান্ত সমুদ্র এখানে। ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকা ঘাটে বাঁধা। পেটে ততক্ষনে জানান দিচ্ছে দুপুরের খাবার সময় । এখানে কোন হো্টেল নেই । ফিরে এলাম রক্সবোরোতে।

দোকান পাট সব বন্ধ। অগত্যা গাড়ীতে খারার যা ছিল তাই দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এবার যাত্রা রক্সবোরো থেকে রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে । মাইল খানেক পর থেকে কোন বাড়ীঘর নেই। এত নির্জন জায়গা আগে কখন ও চোখে পড়ে নি।

মাঝে মাঝে পাখির ডাক বা অন্য কোন শব্দ ভেসে আসে দূর থেকে। কোন মানুষ ত নেই-ই জীব জন্তু আছে কিনা তাও জানি না। তবে মনে একটা ভরসা ছিলো যে এই দ্বীপ এ কোন হিংস্র জন্তু নেই আগেই জেনেছিলাম। গা ছমছম করা বন জঙ্গল। সেই উচু নীচু পাহাড়ী পথ।

এখানে যদি কেও খুন করে ফেলে রেখে যায় কতদিনে যে কেউ এসে তা দেখবে চিন্তা করাও মুশকিল। এক্ মাত্র ভরসা মোবাইল ফোনের নেট ওয়ার্ক কাজ করছে। এই সময় একটা টেলিফোন পেয়েছিলাম দেশ থেকে। এক আত্মীয় দেশ থেকে তার রোগ সম্পর্কে জানতে চাইছে। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছে আর ওদিকে টেলিফোন? কোন রকমে হা হু জবাব দিয়ে টেলিফোন শেষ করলাম।

কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি জানি না। নেই কোন দিক নির্দেশনা। ম্যাপ বলছে ২০/২৫ কিলোমিটারের রিজার্ভ ফরেস্ট পেরিয়ে দ্বীপের অন্য দিকের সমুদ্র। এর পর কোন যায়গা?মানুষজন পাবো তো, লোকালয় কতদুরে?কিছুই জানি না। গাড়ীচলছে ত চলছেই জনবসতির চিহ্ন মাত্র নেই।

কতক্ষন ঠিক বলতে পারব না এ ভাবে চলার পর একটা গাড়ী আসতে দেখলাম। সাদা একজন মহিলা একা বেশ বড় এক গাড়িতে এই বন জঙ্গলের মাঝে। সাই করে বেরিয়ে গেলেন পাশ দিয়ে। সেই উচুনীচু আকাবাকা পাহাড়ি পথ । একবার ত প্রায় দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে সামলে নিলাম।

ভাগ্য ভাল জায়গাটার পাশে খালি সমতল যা্যগা ছিল। আরো কিছুক্ষন গাড়ী চলার পর দেখলাম গরু ছাগল চরছে বুকে সাহস এলো, আশে পাশে নিশ্চয় লোকালয়। না আবার সেই পাহাড়ী পথ আবার নির্জন। কিছুদুর চলার পর একটা সাইন বোর্ড চোখে পড়লো । তাতে লেখা “ ব্লাডি বে” নির্দেশনা অনুযায়ী এক সময় পৌছলাম সমুদ্রে এবং তার ও একটু পর ব্লাডি বে তে।

নাম কেন এমন হল? এখানে কি অনেক রক্তপাত হয়েছে? বীচের পাশে দু একটা বাড়িঘর। এ দিকে সুর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, জানান দিচ্ছে দিন শেষ হয়ে আসছে। ঘড়িতে ততক্ষনে বিকাল চারটা। কিছু মানুষজনের দেখা মিলল । কিভাবে ফিরব হোটেল এ জিজ্ঞেস করে জানলাম উলটো পথে চলে এসেছি।

আবার ফেরা। সেই যেখানে গরু ছাগলের দেখা মিলেছিল ওখানে। এবার ডাইনের পরিবর্তে বামের রাস্তা দিয়ে চললাম। এ রাস্তাও সমদ্রের ধার বেয়ে সেই উচু নীচু আকাবাকা পাহাড়ি পথ। গাড়ী চলছে আর ভাবছি সন্ধ্যা নামার আগে ফিরতে পারবো তো? নাকি এই বন জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটাতে হবে? ভাবছি আর ভয় বেশী করে পেয়ে বসছে।

আস্তে আস্তে এক সময় বাড়ী ঘর দোর চোখে পড়তে লাগলো। এতক্ষনে ধড়ে প্রান এলো। গাড়ী থামিয়ে পথের পাশের দোকান থেকে কোকাকোলা খেলাম। স্কারবোরো কতদুরে জিজ্ঞেষ করে জানলাম আর মাত্র পাচঁ মিনিটের পথ। একটু পরেই পৌছলাম স্কারবোরো তে।

বড়দিনের কারনে ফাকা কিন্তু ফেরীঘাটে আজ আরো বড় একটা ক্রুইজ শিপ। ফিরে চললাম হোটেল এ। সন্ধ্যা নামার তখনো কিছু বাকি। মন চাইলো না বেড়াতে এসে হোটেল এ সময় কাটাতে। আজো আবার সেই পীজন পয়েন্ট।

বীচে বসে সুর্যাস্ত দেখা। সারাদিনের ক্লান্তি ঘাড়ে চেপে সন্ধ্যার কিছু পরে হোটেল। সারাদিনে খাওয়াও হয় নি। খিদেয় পেট চো চো করছে। হোটেলে রাধাঁর ব্যাবস্থা ছিল।

সুতরাং ঝটপট রান্না সেরে খাওয়া দাওয়া সেরে টানা ঘুম। টোবাগো তে শেষ দিন। বড় দিনের পরের দিন। দু একটা দোকান পাট খুলছে। আজ আমাদের গন্তব্য নাইলন পুল।

পীজন পয়েন্টের পাশেই ওটা। সমদ্রের বীচের ২/৩ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ট্যুরিস্ট স্পট। টিকেট কেটে গাড়ী নিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা, সাজানো, গোছানো। দোকান বার সবকিছুই আছে ভিতরে।

ভীড় নেই। বীচে অসংখ্য নৌকা । এ গুলোকে বলে গ্লাস বোট। নৌকার নীচের দিক গ্লাস বা কাঁচ দিয়ে তৈরী। একটা নৌকাতে ১৫/২০ জনের ঘোরার ব্যাবস্থা।

নৌকা ঘাটে পৌছে অনেক ক্ষন অপেক্ষা করতে হল। এক সময় নৌকা ছাড়লো। সাগরের পানি কেটে বেশ জোরেই ছুটলো নৌকা। এই ঘোরাফেরা করাটাকেই বলে স্নরকেলিং। প্রায় ২৫/৩০ মিনিট চলার পর নৌকার গতি কমিয়ে আমাদের সবাইকে নৌকার মেঝের কাচ দিয়ে নীচে দেখার অনুরোধ করলেন চালক।

পানির গভীরতা ৮/১০ ফুট, একদম স্বচ্ছ পানি, সমদ্রের তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। একে একে চোখে পড়তে লাগলো বিভিন্ন আকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রঙের কোরাল বা প্রবাল, লাল, সবুজ, হলুদ নীল নানান রঙ্গের। মনে হচ্ছিল সমুদ্রের মেঝেতে কার্পেট পাতা। শুধু রঙ আর রঙ। কোরালের ফাকে ফাকে বিভিন্ন আকার ও ধরনের মাছ।

অপুর্ব দৃশ্য। জীবনে ভোলার নয়। ঘন্টা খানেক কাটলো কোরালের রাজ্যে। আরো একটু দূরে গিয়ে নৌকা থামলে নেমে পড়লাম সমদ্রে। তীর থেকে কিলোমিটার মত হবে তবে গভীরতা কোমর পর্যন্ত।

স্নান করলাম মনের সুখে। আমাদের সাথে ঐ নৌকাতেই ছিলেন এক ভারতীয় দম্পতি এবং এক চীনা পরিবার। সবাই মিলে আনন্দ ফুর্তিতে সমুদ্র স্নান শেষে বিকেলে ফিরলাম হোটেল এ। খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম সেরে বিকেলে বাজারে গেলাম টোবাগোর স্যুভেনিরের খোজেঁ। দু একটা দোকান যা খুলে ছিল সেখানেই কিনলাম সা্ধ্যের মধে টোবাগোর কিছু স্মৃতিচিহ্ন।

পরদিন সকালে আবার ফেরী। সপ্নের মত কেটে গেল টোবাগোর দিন গুলো। ফেরার পথে যা দাগ কেটেছিলো তা হল এক ঝাক ডলফিন। ফেরী তখন মাঝ সাগরে। প্রায় ৫/৭ মিনিট ধরে ফেরীর সাথে সাথে চলল ,লাফিয়ে ঝাপিয়ে সঙ্গ দিলো আমাদের ডলফিনেরা।

আবার ফিরে এলাম সেই পোর্ট অফ স্পেন ফেরীঘাটে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।