সভ্যতার সন্ধানে অলি গলি খুঁজে বেড়াই। মাঝে মাঝে কিছু সত্যিকারের সভ্য মানুষের দেখা মিলে, আর সভ্য মানুষের বেশে থাকা বেশিরভাগ মানুষই জানেনা, তারা কিভাবে সভ্য।
একই গাঁয়ের এক প্রবাসীর ছেলে কাশেম আর এক কৃষকের ছেলের হারুর মধ্যে ছেলেবেলা থেকেই ছিল বেজায় বন্ধুত্ব। একসাথে গাঁয়ের পাঠশালা তারা পড়তে যায়, একসাথে ঘুরে বেড়ায়, দুষ্টুমিগুলোও একসাথে করে। পাঠশালার পড়া শেষে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ডাঙ্গুলি খেলতে বেরিয়ে পড়ে।
ডাঙ্গুলি খেলা শেষে মাঝি বাড়ির পেছনের বাগানের গাছ থেকে পেয়ারা পেরে খাবার সময়ও এদের বন্ধুত্বের কমতি নেই। হারু রাতে কাশেমের বাড়িতে বসে একসাথে পড়তে বসে। দুজনেই বেশ মনোযোগী ছাত্র, দুজনেই পাঠশালায় বেশ ভাল করছে।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কাশেম আর হারুর হাইস্কুলে ভর্তি হবার সময় হল। তাদের পাঠশালার আরো অনেক বন্ধুর মতই দারিদ্রের কারনে কিংবা পরিবারের আগ্রহের কমতির কারনে হারুর আর হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া হলনা।
কাশেম এর বাবা বিদেশে থাকেন, তিনি কাশেমের পড়াশুনার ব্যাপারের প্রচন্ড আগ্রহী। কাশেমের তাই হারুকে ছাড়াই হাইস্কুলে ভর্তি হতে হল। গাঁয়ের আরো দুয়েকজন ভর্তি হয়েছে, তাদের সাথে একসাথে নিয়মিত কাশেম দুই গাঁ পায়ে হেটে স্কুলে যায়। আর অপরদিকে হারুন তার বাবার সাথে ক্ষেতে কাজে সাহায্য করে, হাঁটে গিয়ে নিজেদের ক্ষেতের ধান-চাল, সবজি নিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু তবুও হারুর সাথে কাশেমের বন্ধুত্ব একেবারেই কমেনি।
কাশেমের মাও কাশেমকে হারুর সাথে মিশতে বারন করে না।
কাশেম মাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশ ভাল ফলাফল করেছে। এবার তার কলেজে ভর্তি হবার সময় এসেছে। আশপাশের কয়েক গ্রামে কোথাও কলেজ নাই। উপজেলায় একটা কলেজ থাকলেও জেলা শহরের কলেজটা অপেক্ষাকৃত ভালমানের।
তাই কাশেমকে সেখানে ভর্তি করে দেয়া হল। প্রথম প্রথম বাড়ি থেকে গিয়েই কলেজে ক্লাশ করত কাশেম। যাতায়াত ব্যবস্থা খুব উন্নত না হওয়ায় কলেজ থেকে ফিরতে সারাটা দিনই পেরিয়ে যেত। তারপরও বিকেলে নদীর পাড়ে গাঁয়ের পুরোনো বন্ধু বিশেষ করে হারুর সাথে আড্ডা দেয়া তার খুব একটা বাদ যেতনা। কলেজে এখন তার অনেক বন্ধু কিন্তু তাদের চাইতে গাঁয়ের অর্ধশিক্ষিত বন্ধুদেরকেই তার বেশি পছন্দ।
কলেজে পড়াশুনার চাপ একটু বাড়তেই কাশেমকে শহরে একটা বাসা ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হল। সে সপ্তাহে একদিন কি দুদিন বাড়িতে আসে, সবার সাথে দেখা করে, আড্ডা দেয়।
উচ্চ মাধ্যমিকেও কাশেমের ফলাফল যথেষ্ট ভাল হয়েছে। তার খুব ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তার আগ্রহ এবং বিদেশ ফেরত বাবার উৎসাহের ফলে সে ঢাকায় গিয়ে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল।
কাশেম ঢাকায় একটা মেসে এসে উঠল। সে যে মেসে থাকে সেখানে সবাইই ভাল ছাত্র। তারা মানুষ হিসেবেও অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান এবং সেই সাথে তারা অনেক মিশুকও। তাছাড়াও তার ক্যাম্পাসেও অনেক ভাল ভাল বন্ধুর সাথে পরিচয় হল। কিন্তু আবার কিছুদিন চলে ফিরে তাদের উপর কাশেম আস্তে আস্তে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ল।
তাদের আচরনে গেঁয়ো কাশেমের প্রতি বিদ্রুপ মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পড়ত, আর মেসে বা ক্যাম্পাসে সামান্য কিছুতেই তাদের সামান্য ভৎর্সনা ধীরে ধীরে তাদের অনেকের কাছ থেকেই কাশেমকে অনেকটা দুরে সরিয়ে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ই কাশেমের বাবা কাশেমকে একটা নোটবুক কম্পিউটার কিনে দিয়েছে। সেই কম্পিউটারে মডেম লাগিয়ে ইতিমধ্যে ইন্টারনেটকেও বিচরন করতে শুরু করেছে সে। ইন্টারনেটে তার সবচে আকর্ষনীয় ওয়েব সাইট হল ফেসবুক। নিয়মিত ফেসবুকে বন্ধু বানানো, তাদের সাথে মজার মজার কথা বলা, স্ট্যাটাস শেয়ার করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
ফেসবুকের বন্ধুদের কে তার বাস্তবের বন্ধুদের চাইতেও বেশি জ্ঞানী মনে হতে লাগল। কত গুরুত্বপুর্ণ কথাই না তারা শেয়ার করে, আর তার প্রত্যেক কথায় বন্ধুরা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ে লাইকস দেয়, কমেন্ট করে, যা বাস্তবের বন্ধুরা করেনা। ধীরে ধীরে কাশেম নিজেকে গুটিয়ে ফেসবুক নির্ভর বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক কায়েমে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ছুটিতে কাশেম বাড়িতে এল। হারু তার সাথে দেখা করতে এল, কিন্তু কাশেমের এতে বেশি ভ্রুক্ষেপ নেই।
সামান্য কথা বার্তা শেষেই বিদায় নিল হারু। তবে, বিকেলে নদীর পাড়ের আড্ডার দাওয়াত দিতে ভুলল না। কাশেম কেন যেন এখন আর আগের মত গাঁয়ের এ বন্ধুদের সাথে সময় দিতে আগ্রহী নয়। এখন তার নতুন ভূবন, ফেসবুক। নোটবুকটা খুলে ফেসবুক খুলে বসল।
সে গাঁয়ে এসেছে এ কথাটি সে তার ফেসবুক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করল। দুপুর গড়াতেই তার স্ট্যাটাসে অনেক লাইকস পড়েছে, অনেকে শুভকামনা জানিয়েছে, আবার অনেকে নিজেদের গ্রাম নিয়ে নষ্টালজিক মন্তব্য করেছে। ব্যাপারটা কাশেমের খুবই ভাল লাগল। বিকেলে হাজির হল পুরোনো সেই বন্ধুদের আড্ডায়। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে, গ্রামের বন্ধুরা কাশেমের কাছ থেকে শহর সম্বন্ধে জানতে চাইল, এটা ওটা মন্তব্য করল।
কাশেম তাদের উত্তর প্রথমে বেশ আগ্রহ করে দিতে থাকলেও শেষে প্রশ্নের প্রাবল্য আর উত্তর শুনে তাদের মন্তব্যের সারল্য তার মনে এ গেঁয়ো বন্ধুদের প্রতি তিরস্কার ও বিদ্রুপাত্নক অনুভুতি তৈরী করল, নিজেকে বেশ বড় বড় ভাবতে ইচ্ছে হল। পরের উত্তর গুলোতে তার গলার স্বরে সেই ভাব প্রকাশ পেল, এবং দুয়েকজনের সরল মন্তব্য শুনে ছোটখাট ধমক দিতেও সে কার্পন্য করতে পারলনা। এদিকে হারু, যে কাশেমের সবচে ভাল বন্ধু কোন প্রশ্নও করলনা, খুব বেশি আগ্রহও দেখালনা, মন্তব্যতো করলইনা, সে শুধু শুনেই গেল। আড্ডার বিষয় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকল, এ পাড়ার ব্রীজের ফাটল ধরা কিংবা ও পাড়ার মানুষের অসুখ বিসুখ নিয়ে আলোচনাগুলো কাশেমকে ছুতে পারলনা। দৃষ্টি যখন কাশেমকে ছাড়িয়ে অন্য দিকে তখন তার আর থাকতে ইচ্ছে হলনা, আড্ডার মাঝেই সে উঠে পড়ল, বন্ধুদের কাছ থেকে খানিকটা বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে হাটা দিল।
বাড়ি গিয়েই ঝাপিয়ে পড়ল ফেসবুকে।
পরের দুদিন বারবার করে হারু বলে গেলেও কাশেম তার সাথে হাটের মেলা দেখতে কিংবা আড্ডা দিতে গেলনা। বরং ফেসবুকে একটু বাড়তি করে সময় দিতে লাগল। কাশেমের মা ছেলের এ বিচিত্র স্বভাব দেখে অবাক হলেন। আজ রাতে কাশেম ফেসবুকে আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
রাতে ঘুমানোর কথাও যেন ভুলে গেল। শেষ রাতে যখন দিনের আলো ফুটি ফুটি করছে, তখন ভেতর বাড়ি থেকে চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনে ফেসবুক তন্দ্রা ছুটে গেল। শব্দ আসছে তার বাবার ঘর থেকে। ভেতরে তার মা, বোন আর দাদি সমসস্বরে চিৎকার করে কাঁদছেন। গিয়ে দেখে তার বাবা জানি কেমন করছে।
তিনি মুখ দিয়ে কোন শব্দ করছে না, কিন্তু জোরে জোরে নি:শ্বাস নিচ্ছেননা এবং প্রচন্ড ঘামছেন। মনে হয় স্ট্রোক করেছেন কিংবা আরো ভয়ানক কিছু। কাশেমের মাথায় আসছেনা সে কি করবে। কারো কাছ থেকে যে পরামর্শ নেবে তা ভেবেই পাচ্ছেনা। হঠাত চমকেই মনে পড়ল ফেসবুকের কথা, হ্যা ফেসবুকের ভাল বন্ধুরা যারা তার দিকে অনেক বেশি নজর দেয় তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করবে সে।
যেই ভাবা সেই কাজ, ফেসবুকে সে পুরো ঘটনা বর্ননা করে স্ট্যাটাস দিল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। সহসাই কোন মন্তব্য না পেলেও কোন এক বন্ধু যেন লাইকস দিয়ে গেল। কাশেম অবাক হল, এ দু:খের ঘটনায় লাইকস দিল কেন তা তার মাথায়ই এলনা। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সে হাল ছেড়ে আবার তার বাবার ঘরে ফিরে এল।
এসে দেখে সেখানে কেউ নেই। বাইরে বেরিয়ে দেখল, হারু তারা বাবাকে ধরে ভ্যানে বিছানা পেতে শুইয়ে দিচ্ছে। কাশেম গিয়ে তাকে সাহায্য করল। হারুর গায়ের পান্জাবী আর মাথা টুপি দেখে ধারনা করল, সে নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ পড়ে এদিক দিয়ে ফিরে যাবার সময় বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে। তারপর ভ্যানও যোগাড় করে এনেছে।
হারু নিজেই ভ্যানটা খুব যত্ন করে টেনে এগোতে থাকল, ভ্যানে কাশেমের মাও এসে বসেছেন, আর কাশেম পেছন থেকে ভ্যান ঠেলে সঙ্গে এগোতে থাকল। প্রায় আধঘন্টার মধ্যেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌছে গেল তারা। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে এম্বুলেন্সে করে জেলা শহরের বড় হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে দিল সেখানকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শহরের হাসপাতালে সারাদিনের চিকিৎসা শেষে রাতের দিকে মোটামুটি রোগীর অবস্থা নিয়ন্ত্রনে এল। রাতে হারুও হাসপাতালে রয়ে গেল।
পরদিন সকালে কিছু জরুরি জিনিস-পত্র আর টাকা পয়সা নিতে হারুকে হাসপাতালে রেখে বাড়ি ফিরল কাশেম। সবকিছু গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হবার সময় মনে পড়ল ফেসবুকের কথা, নোটবুক কম্পিউটারটা খুলে ফেসবুক প্রোফাইলটা একটু চেক করে দেখল। কাশেম তার শেষ স্ট্যাটাসের উপর দেখতে পেল প্রায় চল্লিশটার মত লাইকস পড়েছে, আর অনেকেই তাদের বাবা আর অসুখ সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, ভাল লাগা আর মন্দ লাগা নিয়ে মন্তব্য করেছে, কিছু পরামর্শও এসেছে। কিন্তু কষ্টের সময়ে এই লাইকস আর সময়-অনুপযোগী মন্তব্য ও কাজে না লাগা পরামর্শ দেখে এই প্রথম কাশেমের ফেসবুককে নেহায়েত সময় নষ্ট করার বেদরকারী জিনিস মনে হতে লাগল। ফেসবুকএ নিজের একাউন্টটা বাতিল করে নোটবুকটা গুছিয়ে রেখে দিল।
আর মনে মনে শপথ করল মন্তব্য আর লাইকসের বন্ধু নয়, প্রয়োজনের সময়ের বন্ধুদেরই কেবল সে বন্ধু হবে।
কলরব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।