যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
রাজধানীর সড়ক বলেই কী রাজপথ ?
ঢাকার গোড়াপত্তনকালে ঢাকায় কেমন রাস্তা বানানো হয়েছিল সে তথ্য খুব একটা বেশি পাওয়া যায়না, তবে আজ থেকে প্রায় চার’শ বছর আগে যে শহরের রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছিল সে শহরের রাস্তা ঘাটের হাল এই একবিংশ শতকে এসেও সেই চার’শ বছরের পুরোনো দশাতেই কেন থেকে যাবে সেই প্রশ্ন এই ঢাকাতে অবান্তর। বলা বাহুল্য পুরোনো ঢাকার সেই সময়কার রাস্তা ঘাটের পাশে বর্তমান আধুনিককালের রাস্তাঘাটের চেহারা তুলনায় আনলে বিস্মিত হতে হয়! একটা অদ্ভুত তথ্য হচ্ছে সামান্য বৃষ্টি হলেই যেখানে আধুনিক ঢাকার রাস্তা ঘাট জলে থৈ থৈ করে, রীতিমত নৌকা চালানোর মত অবস্থা হয়ে যায়, সেখানে এখনো পুরোনো ঢাকায় সেই আদ্দিকালে বানানো রাস্তায় জল জমেনা! তাহলে কি ধরে নিতে হবে, চার’শ বছরের পুরোনো প্রযুক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি! ব্যাপারটা সেরকমই!
সে আমলে রাস্তাঘাট বানানোর সময় এখনকার মত প্রতিটি ঘাটে ঘাটে ঠিকাদারকে উৎকোচ দিতে হতোনা। কাজ পাওয়া বা সেই কাজ শেষ করার পর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাড়িতে টাকার বান্ডিল পাঠাতে হতো না, আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবেরাও বান্ডিল পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফাইনাল বিলে স্বাক্ষর করত না। আধুনিকায়ন এই শহরের ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়র উভয়কেই ‘আধুনিক’ করেছে! পরিশীলিত করেছে! এরা এখন 'ঠিকঠাক' করে নেয় যে কবে নাগাদ এই কাজটার নতুন ঠিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
ঢাকার যানজট নিয়ে এই দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যারা কোশেশ করে গলদঘর্ম হয়নি! বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে পুলিশের বড়োকর্তা পর্যন্ত যানজট নিরসনে আলাদীনের চেরাগ ঘসে ফর্মুলা বের করার কসরত করে যাচ্ছে এন্তার।
আমরা মাঝে মাঝেই কাগজে সেসবের বিস্তারিত বয়ান দেখি, আর নিশ্চিত হই- আরো এক প্রস্থ কামানোর ধান্ধা হলো বটে! এই সব বড়োকর্তারা এমন সব ফর্মুলা দেন যা বাস্তবায়নের আগেই বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়! বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এইসব ‘মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের চিন্তা করা হয় ঢাকার এইসব চন্দ্রপৃষ্ঠের মত এবড়োথেবড়ো ভাঙ্গাচোরা প্রায় ডাস্টবীন বা গোভাগাড়ের মত দেখতে রাস্তাকে অপরিবর্তিত রেখেই! কী সব মহাপরিকল্পনার বহর দেখুন-
যানজট কমাতে এখন দরকার সেকেন্ডারি সড়ক! শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে উঁচু টং ঘর নির্মাণ করে সেখান থেকে চারটি রাস্তার গাড়ির সংখ্যা দেখে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে লাল ও সবুজ বাতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতি রাস্তায় একটি ঘড়ি বসানোর মাধ্যমে ওই রাস্তার সবুজ বা লাল বাতির সময়ও জানিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে জ্বালানি খরচ কমবে এবং বায়ুদূষণের পরিমাণও রোধ করা সম্ভব! ড. শামসুল হক অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট পরিচালক, এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউট’ এবার আরো কিছু মহাপ্ল্যানদিয়েছেন -" আমরা ইচ্ছা করলে আমাদের উদ্ভাবন ব্যবহার করে যানজট অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে উঁচু করে টং ঘর নির্মাণ করে সেখান থেকে চারটি রাস্তার গাড়ির সংখ্যা দেখতে পারি। ওপর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে লাল ও সবুজ বাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
যে রাস্তায় যতটুকু গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া দরকার, তা তাৎক্ষণিকভাবে ওখান থেকেই করতে পারি। প্রতি রাস্তায় একটি ঘড়ি বসানোর মাধ্যমে ওই রাস্তার সবুজ বা লাল বাতির সময়ও জানিয়ে দিতে পারি। এতে জ্বালানি খরচ কমবে এবং বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে। ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে এ ব্যবস্থা চালু আছে, যার জন্য কন্ট্রোল রুমের প্রয়োজন নেই। লোকসংখ্যা কমিয়ে যে খরচ বাঁচবে তা দিয়ে আমরা এ কাজ করতে পারি, যা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে টেকসই পদ্ধতি।
"
এমন শত শত মাথাভারি আর মাথাঘোরানো মহাচিন্তা প্রায়শঃই আমাদের দেখতে হয়। গিলতে হয়। কিছুদিনের ভেতরই যখন এই রকম এক একটি পকিল্পনা বাস্তবায়ন হয় সাথে সাথে যানজট আর এক প্রস্থ বেড়ে যায়। তখন আর এই সব মহাপরিকল্পককে খুঁজে পাওয়া যায়না।
আমরা একটা সহজ হিসাব বুঝি।
রাস্তা মসৃণ থাকলে গাড়িগুলো সাবলীলভাবে চলাচল করতে পারে। এটা বোঝার জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞকে ডাকতে হয়না। কিন্তু ঢাকার রাস্তাগুলো কী মসৃণ? এই মসৃণ শব্দটা ব্যবহার ঠিক হলোনা। বলতে হবে ‘ঢাকার রাস্তাগুলো কি গাড়ি চলাচলের উপযোগী ?’ এককথায় এর উত্তর হচ্ছে- না।
কেউ যদি মৌচাক মোড় থেকে রামপুরাগামী রাস্তাটির দিকে কোনো উঁচু জায়গা থেকে তাকিয়ে থাকেন তিনি দেখবেন জবড়জং গোলমেলে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির যানবাহন খুব ধীর গতিতে হেলেদুলে এগুচ্ছে..... প্রথমে মনে হবে এই বাস, কার, রিকসাগুলি মনে হয় পানিতে ভেসে চলছে! এটা মনে হবে তাদের দুলিনি দেখে! এপাশ-ওপাশ দুলে যেন ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে! কারণ কি? কারণ এই মৌচাক থেকে বাড্ডা পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাকে কোনোভাবেই আর রাজপথ বলার উপায় নেই।
এই পথে এমন বিশ মিটার রাস্তা নেই যেটুকু সমান! পুরো রাস্তাটার বুকে বড়ো বড়ো ফোস্কার মত ফুলেফেঁপে উঠেছে। ফুলে ওঠার পাশেই আছে হঠাৎ গর্ত। কোনো একটি ম্যানহোল নেই যেটি রাস্তার সাথে মিশে আছে! হয় চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি উঁচু, না হয় পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি নিচু। সেখানে ঘটাং। নিচুতেও ঘটাং আবার উঁচুতেও ঘটাং।
কেন হলো? কারণ খুব সোজা। পিচের সাথে পাথর মিশিয়ে যে পরিমান তাপমাত্রায় জ্বালিয়ে ইমালশন বানাতে হয় তার কিছুই করা হয়না। কোনো মতে পিচের সাথে নুড়ি পাথর জ্বাল দিয়ে রাস্তায় ঢেলে দেয়া হয়। আর সেই কাজটি করা হয় চলন্ত রাস্তায়! ফলে কয়েক মিনিট পরেই সেই ইমালশনের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা যেয়ে ইমালশন দুই দিকে সরিয়ে দেয়। পট্টি দেয়া জায়গাটুকু আবার দগদগে ঘা হয়েই থাকে।
এ্যাসফল্ট প্লান্ট দিয়ে রাস্তায় কার্পেটিং হয়না কবে থেকে সেটা আর কারো মনে নেই।
গত দেড় দশকে এই বস্তুটিকে কেউ ঢাকার রাজপথে দেখেনি। গত দেড় দশক ধরে ঢাকার কোনো রাস্তা খুঁড়ে নতুন করে মেরামত হয়নি। ঢাকার কোনো রাস্তাই শতভাগ ব্যবহার উপযোগী নেই।
এক’শ ফুট রাস্তার প্রথম চারপাঁচ ফুট দাঁড়ানো রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, রিকসা মেরামতের দোকান, সিমেন্ট বালুর দোকান আর ডাস্টবিননে ভরা।
সেই সাথে প্রথম পাঁচ ফুটের অনেকাংশেই ভাঙ্গা ড্রেন। হঠাৎ হঠাৎ এক একটা জায়গায় গর্ত। ভাঙ্গা ম্যানহোল। অর্থাৎ কোনো ভাবেও প্রথম পাঁচ ফুট ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এর পরের দশ ফুটে আছে ঠাস দেয়া রিকসা বহর।
কেউ হাল্কা চালে দুলে দুলে চলছে, কেউ থেমে থেকে দোকানের সাইনবোর্ড দেখছে, কেউ ওইখানেই মোড় ঘুরে বিপরীত দিকে যাবার চেষ্টা করছে। এর পর বাকি থাকল মূল রাস্তার বিশ-ত্রিশ ফুট। সেটুকুরও ডিভাইডারের দিকের তিন-চার ফুট চলাচলের উপযোগী নেই। আইল্যান্ডের ভাঙ্গা অংশ, তারকাটার ছেড়া অংশ, ম্যাহোলের খোলমুখ, অথবা ম্যানহোলের হঠাৎ উঁচু হওয়া মুখ আছে।
মোদ্দা কথা ঢাকায় যদি এক হাজার কিলোমিটার রাজপথ থাকেও তার পুরোটা ব্যবহার উপযোগী নয়।
সব চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সাধারণত আমাদের দেশের বড়ো কর্তাদের সব কিছুই বেশ চকচকে ঝকঝকে থাকে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সয়ং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সামনেই একটি ম্যানহোল বিপজ্জনকভাবে গর্ত হয়ে আছে। সেই গর্তের গভীরতা কমপক্ষে চার-পাঁচ ইঞ্চি! আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, প্রধানমন্ত্রী যে গাড়িতে যাতায়াত করেন সেই গাড়িটি অত্যন্ত দামি এবং তার শক এ্যাবজর্বারও খুব সহনশীল। অথবা প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চালক বিচক্ষণ। তা না হলে ওই গাড়িটির চাকা প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বেরিয়েই সেই গর্তে পড়ার কথা।
আর তাতে করে আর কিছু হোক না হোক অন্তত ওই গর্তটা বন্ধ করার আদেশ পেতেন মহান বিভাগীয় কর্ণধারেরা।
রাস্তা। রাস্তার ব্যবহার। রাস্তার মসৃণতা। রাস্তায় বাতির ব্যবহার।
রাস্তায় যানবাহনের চলাচলের আইন। ডিভাইডারের উপযোগীতা। যত্রতত্র ডিভাইডার কেটে বাইপাস বানানো। ডিভাইডারে কাটাতারের বেড়া। রাজধানীতে বাঁশের বেড়া দিয়ে রাস্তা আলাদা করা! হাজার হাজার ম্যানহোলের একটিও রাস্তার সাথে সমান্তরাল নয়।
রাস্তার উপর আবর্জনার স্তুপ। দিনেদুপুরে খোলা ট্রাকে আবর্জনা নেয়ার সময় সারাটা পথজুড়ে আবর্জনা ছড়ানো। খোলা ট্রাকে মাটি নেয়ার সময় সারাটা পথজুড়ে মাটি ফেলতে ফেলতে যাওয়া। সেই মাটি শুকিয়ে কংক্রিটের মত শক্ত হয়ে ঘটাং! রাস্তার মাঝ বরাবর খুঁড়ে এটা ওটা করার পর আর ঠিকমত মেরামত না করা। এমন হাজার হাজার অনিয়ম আর রাম রাজত্ব বজায় রেখে দিব্যি এই মহানগরীর কর্ণধারেরা বেতন-ভাতা হালাল করে চলেছেন।
আর মাঝে মাঝে যানজট নিরসনের বায়বীয় আওয়াজে কান ভারী করছেন। সাথে সাথে কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করে চলেছেন। এমন উদ্ভট জবড়জং সেই আদ্দিকালে মেঠো পথের মত পথঘাট নিয়ে কী ভাবে এই নগরকর্তারা আধুনিকায়নের বায়বীয় স্বপ্ন দেখেন সে এক আশ্চর্যজনক বিষয় বটে।
পাদটীকাঃ ১. রাস্তার উদ্ধার করুন। ২. রাস্তাকে দখলমুক্ত করুন।
৩. রাস্তার সংখ্যা এবং আয়তন বাড়ান। ৪. রাস্তায় সেবা সংস্থাগুলোর মামদোবাজি বন্ধ করুন। ৫. মেরামত ঠিকঠাক না হলে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা করুন। ৬. ডিভাইডার থেকে অবিলম্বে কাটাতারের বেড়া এবং বাঁশের বেরিকেড সরান। ৭. ম্যানহোল রাস্তার সাথে সমান্তরাল না হলে যারা ম্যানহোল বসাচ্ছে তাদের চাকরিচ্যুত করুন।
৮. রাস্তা থেকে সকল প্রকার মেরামতি কারখানা অপসারন করুন। ৯. প্রতিদিন মেরামতি গাড়ি সেই পাকিস্তান আমলের মত রাস্তায় টহল দিক। ১০. ঢাকার রাস্তাগুলো আগে মনুষ্য চলাচলের উপযোগী করার পর তারপর অন্য উন্নয়নের কথা ভাবুন।
চলবে............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।