আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিকিরণের আতঙ্কে টোকিও ছাড়ার ধুম

তক
ফের বিস্ফোরণ পরমাণু চুল্লিতে। গত চার দিনে এই নিয়ে তৃতীয়। জাপানের বাতাসে ক্রমশ ছড়াচ্ছে তেজস্ক্রিয়তার বিষ। শনিবার ফুকুশিমা দাইচির এক নম্বর চুল্লিতে বিস্ফোরণ হওয়ার পর থেকেই আশঙ্কা ছড়াচ্ছিল। সোমবার সকালে তৃতীয় এবং আজ, মঙ্গলবার সকালে ফুকুশিমা দাইচির দু’নম্বর পরমাণু চুল্লিতে বিস্ফোরণের পরে আতঙ্ক আর নিয়ন্ত্রণে রইল না।

এই অবস্থায় সকলের নজরই এখন বাতাসের দিকে। কোন দিকে, কতটা গতিতে সে বইবে, তার উপরে অনেকখানিই নির্ভর করছে তেজস্ক্রিয়তার বিষ কোথায়, কী ভাবে ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডবলিউএমও) জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় কণা বাতাসে ভর করে জাপান-সহ এশীয় দেশগুলির দিক থেকে আপাতত প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে সরে গিয়েছে। তবে আবহাওয়া যে কোনও সময় বদলাতে পারে। তাই তাঁরা উপগ্রহের মাধ্যমে বাতাসের অভিমুখের দিকে নজর রাখছেন।

স্বজনের খোঁজ। সুনামি-ভূকম্পে বেঁচে যাওয়াদের তালিকায়। মঙ্গলবার। — রয়টার্স কিন্তু শুধু তেজস্ক্রিয়তাই তো নয়, ভূমিকম্প-পরবর্তী একের পর এক কম্পন, আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠা, পরমাণু কেন্দ্রের জ্বালানি রাখার জলাধারে আগুন— একের পর এক ঘটনায় ক্রমশ দিশেহারা হয়ে পড়ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। জাপান থেকে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিদেশিরা।

সন্তান কোলে জাপানি মা-বাবারা দাইচি থেকে টোকিও হয়ে আরও, আরও দূরে সরে যেতে মরিয়া। তেজস্ক্রিয়তার বিষ কতটা ভয়ঙ্কর, জাপানের থেকে বেশি তো আর কোনও দেশ জানে না! ফুকুশিমা দাইচির দু’নম্বর চুল্লিটি নিয়ে গত কাল থেকেই ভাঁজ পড়তে শুরু করেছিল বিশেষজ্ঞদের কপালে। কারণ ‘কুলিং প্ল্যান্ট’ খারাপ হয়ে যাওয়ায় এক এবং তিন নম্বর চুল্লির মতো এটিও গরম হয়ে যাচ্ছিল। ঠাণ্ডা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আজ সকালে হাল ছেড়ে দেন এ কাজে নিযুক্ত কর্মীরা। সকালেই বিস্ফোরণ ঘটে দু’নম্বর চুল্লিতে।

ফলে গত দু’দিন ধরে ছড়াতে থাকা তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ আজ এই ঘটনার পরে এক লাফে বেড়ে যায় অনেকখানি। এক এবং তিন নম্বর চুল্লির জ্বালানি রড আংশিক গলে যাওয়া (বিজ্ঞানের পরিভাষায় মেল্ট ডাউন) নিয়ে এমনিতেই চিন্তায় ছিলেন বিজ্ঞানীরা। আজকের পরে তাঁদের চিন্তা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দু’নম্বর চুল্লির জ্বালানি রড নিয়ে। এই চুল্লিটির ধাতব পাত্রটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফলে চুল্লিটির পূর্ণাঙ্গ মেল্ট ডাউন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরমাণু কেন্দ্রের মধ্যেকার চার নম্বর চুল্লিটির অবস্থাও ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। সেটিকে ঠাণ্ডা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিপদের শেষ এখানেই নয়। আজ সকালে আগুন লাগে ফুকুশিমা দাইচি পরমাণু কেন্দ্রের ভিতরে একটি জলাধারে।

সেখানে ব্যবহৃত জ্বালানি রাখা হত। আগুন কিছু ক্ষণের মধ্যে নিভিয়ে ফেলা গেলেও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ওই আগুনের ফলে বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু কতটা বেড়েছে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ? সারা দিন ধরে এই আতঙ্কই তাড়া করেছে জাপানবাসীকে। ফুকুশিমা থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে রাজধানী টোকিও। ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয়তা হাওয়ায় ভেসে টোকিওর বাতাসেও মিশতে চলেছে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।

হাওয়ার গতিবেগ, অভিমুখ-সহ একাধিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করেই তাঁদের এই অনুমান। পরিমাণে অল্প হলেও মানুষের দেহে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীমহলের একাংশ। ফলে টোকিওতেও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ মাপতে গিয়ে জাপান সরকার ইতিমধ্যেই দেখেছে, রাজধানী টোকিও-র দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা। টোকিওর উপকণ্ঠে সাইতামা-য় তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি।

ফুকুশিমার দক্ষিণে ইবারাকি প্রদেশে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ১০০ গুণ বেশি! আবার টোকিও-র দক্ষিণে কানাগাওয়া প্রদেশে এই পরিমাণ ৯ গুণ বেশি। টোকিওর বিপদ আরও বাড়িয়েছে ভূমিকম্প পরবর্তী পরপর কম্পন। আজই সন্ধ্যা নাগাদ পরপর দু’বার কেঁপে ওঠে টোকিও-সহ কয়েকটি এলাকা। রিখটার স্কেলে এর পরিমাণ ৬! প্রবল ভূমিকম্পের পরে এমনিতেই নড়বড়ে হয়ে রয়েছে জাপানের বাড়িঘর, সেতু, রাস্তা। আজকের কম্পনে তাদের কয়েকটি ভেঙে পড়েছে বলে জানা গিয়েছে।

অবশ্য প্রাণহানির কোনও খবর নেই। গত কাল কিরিশিমা পর্বতমালার শিনমোয়েদাকে আগ্নেয়গিরিটি আচমকাই জেগে উঠলেও এখনও পর্যন্ত বড় কোনও বিপদ ঘটায়নি। অবশ্য আতঙ্কে ওই এলাকা থেকে বহু লোক ইতিমধ্যেই অন্যত্র পালাতে শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে ঘোর বিপদে জাপান। অসহায় গোটা দেশ।

আজ প্রধানমন্ত্রী নাওতো কানের কথাতেও ফুটে উঠেছে সেই আর্তি। টিভিতে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে কান চার নম্বর চুল্লির বিপদের কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা যথেষ্ট বেশি। ” ফুকুশিমা দাইচির ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী লোকেদের আগেই সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল জাপান সরকার। আজ ওই পরমাণু কেন্দ্রের ৩০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাসকারী সকলকেই বাড়ির বাইরে যেতে মানা করেছেন কান। এই অবস্থায় জাপান ছাড়ার হিড়িক পড়েছে বিদেশিদের মধ্যে।

ইতিমধ্যেই রাজধানী টোকিও থেকে তাদের দূতাবাস ওসাকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অষ্ট্রিয়া। অন্য কয়েকটি দেশও টোকিও থেকে পাততাড়ি গোটানোর কথা ভাবছে। ভারত-সহ একাধিক দেশ তাদের কর্মীদের জাপান থেকে সরিয়ে আনার কথা ভাবছে। একাধিক বেসরকারি সংস্থাও সেই পথেই এগোচ্ছে। চিন ইতিমধ্যেই তাদের টোকিওগামী বিমান পরিষেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

টোকিও-র বিমানবন্দরগুলিতে থিকথিক করছে ভিড়। যে কোনও মূল্যে পরিবার নিয়ে জাপান ছাড়তে মরিয়া বিদেশিদের একটা বড় অংশ। আমেরিকার যে সপ্তম নৌবহর জাপান সমুদ্রে পাহারার কাজে ছিল, তেজস্ক্রিয়তার বিপদ বুঝে তারাও দূরে সরে গিয়েছে। মাপা হচ্ছে শিশুর দেহে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ। — এ পি একই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন জাপানবাসীও।

বাড়ির বাইরে বেরোলে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হতে পারেন, এই আশঙ্কায় অনেকেই ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য রসদ কিনতে তো বাইরে আসতেই হবে। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একেবারে বেশ কয়েক দিনের রসদ কেনার হিড়িক পড়েছে লোকের মধ্যে। আর তার অবধারিত ফল হিসেবে বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। আঁচ পড়তে শুরু করেছে জাপানের অর্থনীতিতেও।

গত কালের পর আজও ব্যাপক ধস নেমেছে জাপানি শেয়ার বাজারে। এর আঁচ পড়ছে এশিয়ার অন্য দেশগুলির শেয়ার বাজারেও। ভারতেও আজ জাপানের প্রভাবে শেয়ার বাজারে সূচক পড়েছে। পরমাণু-বিপদ আঁচ করে সতর্ক হতে শুরু করেছে জার্মানি-ফ্রান্স-সহ বহু দেশ। জার্মানি ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তাদের দেশের সাতটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগামী তিন মাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।