মাটি দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণের চেয়ে ভয়াবহ তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ । এ ভয়াবহ বিকিরণের কবলে সারাদেশ। এটা গন্ধ, বর্ণ ও শব্দহীন এবং অদৃশ্য; কিন্তু মানব দেহ ও জীব জগতের জন্য মারাত্মক ৰতিকর। তারহীন মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাধ্যমে এই দূষণের উৎপত্তি হচ্ছে। মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের (তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ) কারণে ভয়াবহ ক্যান্সার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আবাসিক এলাকা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়। অথচ আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ টাওয়ার লোকালয়, বাড়ি এবং শিৰা প্রতিষ্ঠানের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাত্রা মনিটর করা হলেও আমাদের দেশে তা করা হচ্ছে না। শিশুদের থেকে কমপৰে ৫ ফুট দূরে মোবাইল রাখতে হবে। রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইল কমপৰে ৭ ফুট দূরে রাখতে হবে।
আবাসিক এলাকা থেকে দূরে লোকালয়ের বাইরে কমপৰে ৪০ তলা ভবন সমান উঁচুতে মোবাইলের টাওয়ার স্থাপন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাদে মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের কারণে এ বিভাগের অধিকাংশ শিৰক ক্যান্সার আতঙ্কে রয়েছেন।
এ বিভাগের এক অধ্যাপক টাওয়ার স্থাপন না করার জন্য তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক এএসএম ফায়েজ এবং প্রো-ভিসি ইউসুফ হায়দারের কাছে লিখিত আবেদন করলেও অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপৰ উক্ত শিৰকের আবেদন রৰা করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিৰকের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করেন উদয়ন স্কুলে। এই স্কুলের ছাদে কয়েকটি মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার স্থাপিত হওয়ায় অভিভাবকরা আতঙ্কে রয়েছেন।
গবেষণার তথ্য ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. গোলাম মোহাম্মদ ভুঞা তার গবেষণায় উলেস্নখ করেন, মানব দেহের শত ট্রিলিয়ন কোষ নিম্ন শক্তির তড়িৎ চৌম্বকীয় সংকেত ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রৰা করে চলে। নিরবচ্ছিন্ন বহিঃস্থ তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে অবস্থান করলে এই বিকিরণ ৰেত্র আনৱঃকোষীয় যোগাযোগ পথকে সাংঘাতিকভাবে বিকৃত করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ফলে ভুল ও বিকৃত সংকেতের কারণে কোষের ভেতরে অস্বাভাবিক কর্মকান্ড শুরম্ন হয় এবং কোষ পর্দা শক্ত হয়ে যায়।
কোন পুষ্টি কোষের ভিতরে ঢুকতে পারে না এবং বিষাক্ত দ্রব্য বের হতে পারে না এবং কোষটি বিষাক্ত হয়ে যায়। তখন জেনেটিক পরিবর্তন, অল্প বয়সে বৃদ্ধ হওয়া, স্মরণশক্তি লোপ, অবসন্নতা, লিউকেমিয়া ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়।
এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘মোবাইল ফোন ব্যবহারের পূর্বে ১৯৭০ সালে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে অটিজমে (মানসিক প্রতিবন্ধী) আক্রানেৱর সংখ্যা পাওয়া যেত একজন। ’ ২০০৩ সালে এ হার হয়েছে ১৬৬ জন শিশুর মধ্যে একজন। বর্তমানে গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার এই ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে, তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের আঘাতে শিশুদের দেহ কোষ ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ফলে জেনেটিক ড্যামেজ সংঘটিত হচ্ছে যা অটিজম থেকেও বেশি মারাত্মক। বিকিরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
আর এই দূষণে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে মোবাইল কোম্পানিগুলোর নির্মিত স্বল্প উচ্চ বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার এন্টেনা। তিনি বলেন, ১৫ কোটি মানুষের এই দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের অর্থনীতি অনুযায়ী যা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে টাওয়ার এন্টেনা বসানোর সংখ্যাও অধিক। বিকিরণের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন মহল এখনও অজ্ঞাত রয়েছেন বলে মনে হয়। এ কারণে যেখানে সেখানে টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
যেমন উদয়ন স্কুলের উত্তর বস্নকের ছাদটি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির এন্টেনা দিয়ে পূর্ণ। প্রত্যেকটি এন্টেনা দিয়ে উচ্চ ৰমতার বিকিরণ প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়াচ্ছে। আর সম্মিলিত তড়িৎ ৰেত্রের মধ্যে কয়েক হাজার শিশু প্রতিদিন ৬/৭ ঘণ্টা অতিবাহিত করছে। ফলে এই শিশুরা ২০ বছর পরে বিকিরণের প্রভাবে লিউকেমিয়া, ব্রেন ক্যান্সার, স্মৃতিশক্তি হারানোসহ মারাত্মক রোগে আক্রানৱ হতে পারে এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে। ঢাবির কার্জন হলের নতুন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাদে কর্তৃপৰের অনুমতিক্রমে একটি মোবাইল কোম্পানির বেইজস্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।
এর নিচে ও আশপাশে বিকিরণের ৰেত্রে শত শত ছাত্র-ছাত্রী ও শিৰক-শিৰিকা প্রতিনিয়ত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ অনুমতি দেয়ার আগে উক্ত এলাকার শিৰকদের মতামত জানতেও চাননি। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা উলেস্নখ করে টাওয়ারটি বন্ধের জন্য আবেদন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ অভিযোগটি পাত্তা দেননি। বরং বিল্ডিংয়ের ছাদের অন্য প্রানেৱ আরেকটি এন্টেনা স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা আরও বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য যারা শক্তিশালী তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে বেশিৰণ অবস্থান করছেন তারাই বেশি ব্রেন ক্যান্সার, লিউকেমিয়া ও লিমফোম্মিয়ায় অনেক বেশি আক্রানৱ হচ্ছেন।
বিশেষ করে লাইনম্যান, টেলিফোন লাইনম্যান, ইলেকট্রিক রেলওয়ে অপারেটর, ইলেকট্রিসিয়ান, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। লস-অ্যানজেলস-এর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’ এর গবেষক সুসান প্রিসটন মারটিন এবং তাদের সহকর্মীদের দ্বারা শুধু ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কারের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য পেশার লোকদের তুলনায় এই পেশায় নিয়োজিত লোকদের ব্রেনে এসটোসিটোমা নামের মালিগনেন্ট টিউমার দশগুণ বেশি। ১৯৭৯ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ ইপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত ড. নেনসি ভিওরথিমের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, আমেরিকার ডেনবার ও কলোরেডো এলাকায় উচ্চ তড়িৎ প্রবাহ লাইনের নিকটে অবস্থিত বাড়িসমূহে অবস্থানকারী শিশুদের মধ্যে লিউকেমিয়া ও ব্রেন ক্যান্সারের মাত্রা নিম্ন তড়িৎ প্রবাহ লাইনের পাশের বাড়িতে অবস্থানরত শিশুদের চেয়ে দুই গুণের বেশি। অন্যদিকে ৩৪৪ জন ক্যান্সার আক্রানৱ শিশুর সাথে প্রায় সমবয়সী কিন্তু তড়িৎ লাইনের নিকটে বসবাস করছে না এমন ৩৪৪ জন শিশুর তুলনা করে দেখেন যে, পরবর্তী শিশুদের কোন রকম ক্যান্সার সৃষ্টি হয় নাই। স্টকহোমের কারোলিনসা ইনস্টিটিউট-এর ড. মারিয়া ফেসিটিং এবং তার সহকর্মীগণ ১৯৯০ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে দেখতে পান, যেসব বাড়িতে চৌম্বক ৰেত্রের পরিমাণ তিন মিলিগাউসের বেশি তাদের লিউকোমিয়া হওয়ার ঝুঁকি চার গুণেরও বেশি।
এছাড়া ব্রিটিশ জার্নাল অফ মেডিসিন, স্কানডেনেভিয়ান জার্নাল অফ মেডিসিন এবং বায়ো ইলেকট্রোমেগনেটিকস জার্নালেও এরকম আরও অনেক গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাবির অধ্যাপকের অভিমত ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সুব্রত কুমার আদিতা ইত্তেফাককে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় মোবাইলের টাওয়ার স্থাপন করা উচিত নয়। মোবাইলের টাওয়ারের রেডিয়েশনের প্রভাবে দেহের অনেক ৰতি হতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মোবাইলের টাওয়ার আবাসিক এলাকায় স্থাপন করা হয় না। ’
বুয়েটের অধ্যাপকের অভিমত ঃ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)র ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার ইত্তেফাককে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় মোবাইলের টাওয়ার বসানো মোটেও ঠিক না।
একটানা দীর্ঘৰণ মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন গ্রহণ করলে স্কিন ক্যান্সারসহ ভয়াবহ রোগের আশংকা থাকে। রেডিয়েশন গ্রহণের ফলে ঝিম ঝিম ভাব, ভয়, কাজের ব্যাঘাত ঘটে। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে রেডিয়েশনের মাত্রা নিয়মিত মনিটর করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মনিটর করার কোন যন্ত্রপাতি নেই। এ কারণে করা হচ্ছে না।
মনিটর করার জন্য বুয়েট একটা যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী মাসে এটি ক্রয় করা হতে পারে।
এ ব্যাপারে একাধিক মোবাইল কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা রেডিয়েশন সম্পর্কে কোন মনৱব্য করতে রাজি হননি। তবে তারা বলেছেন সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।
বিটিআরসির বক্তব্য ঃ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের যোগাযোগের অন্যতম হাতিয়ার মোবাইল ও টেলিফোন সেক্টর অনেক বিসৱৃত ও আধুনিকায়ন হয়েছে।
বিশাল এই সেক্টরটি মনিটর করার পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। তবে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সেক্টরটির উন্নয়নে গুরম্নত্ব দিচ্ছে। বিটিআরসির কমিশনার মলিস্নক সুধীর চন্দ ইত্তেফাককে জানান, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে প্রথম টেলিযোগাযোগ নীতিমালা প্রণয়ন করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ এর আওতায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) গঠিত হয়। এই কমিশন গঠনের পর দেশে টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যাপক প্রসার ও পরিবর্তন সাধিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ এই ভূমিকার কারণে দেড় লাখ টাকার ফোন মানুষ এখন হাজার টাকায় পাচ্ছে। গত এপ্রিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৫ কোটিরও অধিক। এছাড়া আইএসপি, ইন্টারনেট সার্ভিস ওয়াইমেক্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ইতিপূর্বে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা শূন্যের কোটায় থাকলেও বর্তমানে তা শতকরা ৬ ভাগে উন্নীত হয়েছে। মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী প্রচুর গবেষণা হচ্ছে।
আনৱর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে বিটিআরসি মোবাইল টাওয়ার বসানোর অনুমতি দিচ্ছে। তবে একথাও ঠিক যে এগুলো যথাযথভাবে মনিটর করার মতো প্রযুক্তি ও জনবল আমাদের নেই।
(দৈনিক ইত্তেফাক)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।