এক শুক্রবার থেকে আরেক শুক্রবার। বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত শুক্রবার দিনটির নাম হয়ে গেছে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। কী নিয়ে অপেক্ষা করছে আরেকটি শুক্রবার?
গুগলে গিয়ে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ সার্চ দিন। ৫৮ রানের লজ্জার নামগন্ধও খুঁজে পাবেন না সেখানে। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ বলতে পাবেন আমেরিকায় থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র পরদিন।
নামের সঙ্গে ঘটনার কোনো মিল নেই। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ মানে ক্রিসমাসের হাটবাজার শুরু হওয়ার দিন!
‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে দুটি সিনেমারও খোঁজ মিলবে। হলিউডেরটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪০ সালে। ২০০৪ সালে বলিউডেরটি। দ্বিতীয়টিতে নামকরণের সার্থকতাও খুঁজে পাওয়া যায়।
মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ নিয়ে ওই সিনেমা।
৫৮ রানও তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক ‘বিস্ফোরণ’ই। এক শুক্রবারে মুম্বাইয়ের ওই বোমা হামলা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আরেক শুক্রবারে মিরপুরে ওই ৫৮ নাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্নের ভিতকে।
৫৮-এর শুধু সেটুকুই করার ক্ষমতা ছিল।
সেটি এর চেয়েও অনেক বড় হয়ে উঠেছে ৫৮-পরবর্তী নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহে। সমর্থকদের মাত্রাছাড়া আবেগের অগ্রহণযোগ্য প্রকাশ ঢিল হয়ে আছড়ে পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম বাসে। যেটি চলে গেছে আইসিসির দরবার পর্যন্ত। মনের কথা অকপট বলে ফেলা সাকিব আল হাসানের কলাম নিয়ে শুরু হয়ে গেছে তুমুল বিতর্ক। বাংলাদেশ দলের নাম যদি ‘টাইগার’ হয়, ঘরে-বাইরের চাপ মিলিয়ে সাকিবের দল এখন ‘কর্নারড টাইগার্স’।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের প্রিভিউয়ে এসব পুরোনো প্যাচালকে অপ্রাসঙ্গিক ভেবে বিরক্ত হতে পারেন। তবে এই ম্যাচটা দেখতে বসার আগে এক শুক্রবার থেকে আরেক শুক্রবারের ঘটনাপ্রবাহ মনে রাখাটা জরুরি। নইলে এই ম্যাচের আসল তাৎপর্যটাই হারিয়ে ফেলবেন। এ শুধু ব্যাট আর বলের লড়াইয়ের চিরাচরিত আরেকটি ক্রিকেট ম্যাচ নয়। এখানে আরও অনেক কিছু অদৃশ্য হয়ে উড়ে বেড়াবে মাঠে।
বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমেও কি নয়!
বিশ্বকাপ ইতিহাসে ‘কর্নারড টাইগার্স’ শব্দযুগলের আলাদা তাৎপর্য আছে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তান যখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ইমরান খান টস করতে নামলেন বাঘের মাথার ছাপ মারা একটা টি-শার্ট পরে। ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেল ঘটনা কী জানতে চাইলেন। ইমরান বললেন, ‘আমি আমার দলকে বলেছি কর্নারড টাইগার্সের মতো খেলতে। ’ এরপর যা হয়েছিল, সেটি ক্রিকেটীয় রূপকথা।
এই ম্যাচের আগে সাকিব আল হাসানও কি এমন কিছু বলেছেন তাঁর দলকে?
জানার উপায় নেই। সাকিব আল হাসান তাঁর ক্যারিয়ারে অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে প্রতিটি কথা এখন মেপে বলছেন। ক্রিকেটে ফুল আর কাঁটা পাশাপাশিই থাকে। তবে সাকিব আল হাসান এত দিন শুধু ফুলের হাসিই দেখেছেন। কাঁটার আঘাতে হূদয়ে রক্তক্ষরণ এই প্রথম।
ক্রিকেটারদের হাতে ব্যাট নামের আশ্চর্য এক জাদুদণ্ড থাকে, বল নামের আশ্চর্য এক জাদুগোলক। যেটির ছোঁয়ায় কাঁটা হয়ে যায় ফুল। সাকিবও তা পারবেন কি না—এই প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে বিশ্বের এক নম্বর ওয়ানডে অলরাউন্ডারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
অশান্তির আগুনে পুড়তে পুড়তেও কি সাকিবের মনে একটু সুখানুভূতি হচ্ছে গত বিশ্বকাপের কথা ভেবে! ইংল্যান্ড যে বারবাডোজের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে তাঁর মনে। ওই আগুনে উইকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শুধুই সাকিব।
বাংলাদেশের ১৪৩ রানে তাঁর ছিল অপরাজিত ৫৭। পার্থক্য হলো, সেদিন প্রতিপক্ষ ছিল শুধুই ইংলিশ বোলাররা। আজ অ্যান্ডারসন-সোয়ানরা নামেই প্রতিপক্ষ। আসল প্রতিপক্ষ অন্তহীন চাপ।
কাল ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে ব্যতিক্রমী একটা দৃশ্যের দেখা মিলল।
বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনূস ও বাংলাদেশ দলের কোচ জেমি সিডন্স সংবাদ সম্মেলনকক্ষে দাঁড়িয়ে সাকিবের প্রতিটি কথা কান পেতে শুনলেন। যে ভয়ে, সে রকম কিছু অবশ্য হলো না। সাংবাদিকেরা তেমন আক্রমণাত্মক কোনো প্রশ্ন করলেন না। একটু স্বভাববিরুদ্ধরকম সাবধানী মনে হলো সাকিবকেও।
তার মধ্যেও একটা কথা আলাদা হয়ে রইল।
আগুনের লেলিহান শিখার মতো এই যে বিতর্ক ঘিরে ধরেছে তাঁকে, এই পরিস্থিতিতে দলকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করছেন? সাকিব একটু হেসে বললেন, ‘এতে কাজটা আরও সহজ হয়ে গেছে। সব চাপ এখন আমার ওপর আসছে, বাকি সবাই তাই রিলাক্সড হয়ে গেছে। ’
বলে কী এই ছেলে! নিজের কলামে অমন চাঁছাছোলা মন্তব্য তা হলে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় করে বসা নয়! জেনেশুনেই নীলকণ্ঠ হয়েছেন সাকিব! সব বিষ নিজে পান করে চাপটা সরিয়ে দিয়েছেন বাকিদের ওপর থেকে! সত্যিই যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান অনেক দূরই যাবেন।
কিন্তু আপাতত সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন যে অন্য—বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে কতদূর যাবে? ৫৮-বিপর্যয় বিশ্বকাপ-স্বপ্নের রংটা ফিকে করে দিয়েছে অনেকটাই। তবে ঘটনা হলো, বিশ্বকাপ শুরুর আগে যে সমীকরণ ছিল, সেটি কিন্তু অপরিবর্তিতই আছে।
কী ছিল সেই সমীকরণ? আয়ারল্যান্ড-হল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয় পেতে হবে, সঙ্গে বড় চার দলের অন্তত একটির বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত জয়। দুটি হলে আরও ভালো। আয়ারল্যান্ড জেতা হয়েছে। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাকি তিনটি ম্যাচের দুটি জিততে পারলেও ক্ষীণ একটা আশা থাকবে।
নেট রানরেটের এমনই বেহাল অবস্থার কারণে সেটি এতই ক্ষীণ যে, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসও ম্যাচটাকে বাংলাদেশের জন্য ‘মাস্ট উইন’ বলে দিলেন।
গত জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের কথা বলতে অসম সাহসী হতে হতো। ব্রিস্টলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি বাঘের কাছে ইংলিশ সিংহের পরাভব মানার পর থেকে মানসিক সেই বাধা আর নেই। বরং ৫৮-এর ছায়াতলে দাঁড়িয়েও দলের অনেকে বলতে পারছেন, ইংল্যান্ডে ইংল্যান্ডকে হারাতে পারলে নিজেদের দেশে কেন পারব না?
৫৮ এমনই এক দগদগে ক্ষত যে, যুক্তি বলে, বাংলাদেশ পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কবেই বা যুক্তি মেনে চলেছে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।