আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা গানের বরেন্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন

গভীর কিছু শেখার আছে ....
আজ ১০ মার্চ, বাংলা গানের বরেন্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের এই দিনে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা গান হারিয়েছে তাঁর একজন একনিষ্ঠ সাধককে। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর ব্যক্তি ও সঙ্গীত জীবনকে এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরে তাঁর প্রতি সম্মান জানানো হলো। জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় নিলুফার ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৪৮ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়।

পাঁচ বোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ৷ বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন ও মেজো বোন ফওজিয়া খান প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিল্পী৷ সেজো বোন শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী নাজমা ইয়াসমীন হক। তিনি ধানমন্ডি রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ (ইংলিশ মিডিয়াম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক৷ ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমীন প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী৷ নিলুফার ইয়াসমিনের পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার৷ সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল৷ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতেন৷ আর নিলুফার ইয়াসমিনের মা হারমোনিয়াম বাজাতেন৷ তাঁর পিতার বাড়ি সাতক্ষীরার মুকুন্দপুর গ্রামে৷ মুকুন্দপুরের'পন্ডিত বাড়ি' বললে ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারটিকে সবাই চেনেন৷ বহু আগে থেকেই এবাড়ির লোকজন শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অগ্রগামী৷ নিলুফার ইয়াসমিনের মা মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বখশের ছাত্রী ছিলেন৷ তিনি ভালো গান গাওয়া ছাড়াও ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন৷ শৈশবকাল নিলুফার ইয়াসমিনের শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী এবং ঢাকায়। মায়ের কাছে নিলুফার ইয়াসমিনের সংগীতে হাতেখড়ি৷ বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ডপ্লেয়ার ছিল৷ পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সেসব রেকর্ডের গান বারবার বাজিয়ে শুনে শিখে ফেলতেন৷ আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলাঝরিয়া, হরিমতী, কে মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরো বিখ্যাত সব শিল্পীদের গাওয়া রেকর্ড থেকে তাঁর মা গান তুলে গাইতেন এবং তাঁর গাওয়া থেকেই নিলুফার ইয়াসমিন গান শিখে ফেলতেন৷ তাঁর মা-ই তাঁকে বলতেন যে এ-সব গানগুলির রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম৷ তখন থেকেই নজরুল সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। শিক্ষাজীবন সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তাঁর ছিলো সমান মনোযোগ৷ তিনি আদমজী কটন মিলস্ স্কুল, বাংলাবাজার গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ ও সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন৷ তিনি ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে ২য় শ্রেনীতে প্রথম হয়ে এমএ পাশ করেন৷ ক্যাপশন : নিলুফার ইয়াসমিনের একমাত্র সন্তান আগুন এবং দুই নাতি মশাল ও মিছিল বিয়ে ও সন্তান প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ পরের বছর তাঁর একমাত্র পুত্র কন্ঠশিল্পী আগুনের জন্ম হয়। সঙ্গীতের তালিম নিলুফার ইয়াসমিনের উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখা শুরু হয় ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে ১৯৬৪ সালে৷ একাধারে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন৷ তারপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন৷ এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ওমুরশিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন৷ তিনি নজরুল-সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্বরলিপিগ্রন্থ থেকে৷ স্বরলিপি অনুসরণ করেই প্রথম দিকে বেতার-টেলিভিশনে নজরুল-সংগীত গেয়েছেন৷ তিনি প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী, নজরুল-সংগীতস্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুত্ফর রহমান ও সুধীন দাশ-এর কাছে নজরুল-সংগীত শিখেছেন৷ কর্মক্ষেত্র নিলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরের মাধ্যমে শিল্পী জীবন শুরু করেন৷ পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকে আর্মত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন৷ নিলুফার ইয়াসমিন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গানসহ গানের ভুবনের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ করেছেন৷ রাগ প্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও তিনি নজরুল-সংগীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ নিলুফার ইয়াসমিন বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে কন্ঠ দিয়েছেন৷ যেমন- শুভদা, অরুণ-বরুন-কিরণমালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী , যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা , জলছবি ইত্যাদি৷ ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নজরুল সংগীত বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন৷ ক্যাপশন : নিলুফার ইয়াসমিনের পাওয়া একুশে পদক ও অন্যান্য পুরস্কারের একাংশ সন্মাননা,স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা শিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমীনের জনপ্রিয়তা শুধু দেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিদেশেও ছিল ব্যাপক।

১৯৮৪ সালে কলকাতার 'অগ্নিবীণা'-র আমন্ত্রণে ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমীর সাংস্কৃতিক দলের সংগে কলকাতা গমন করেন৷ বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লি ও কলকাতায় সংগীত পরিবেশন করেন৷ এ-ছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সংগীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন৷ 'সুজন সুখী'' চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, 'শুভদা' চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, সংগীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় "একুশে পদক'' এবং নজরুল সংগীতে তাঁর অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে "নজরুল পদক'' সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন নিলুফার ইয়াসমিন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে নজরুল সংগীতে তাঁর অবদানের কথা চিরস্বরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে৷ প্রকাশনা নিলুফার ইয়াসমিন শ্রোতার আসর প্রযোজিত ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত 'বেলা শেষের রাগিনী'-তে 'আবার ভালবাসার সাধ জাগে' শিরোনামের নজরুল-সংগীতটি রেকর্ড করেন৷ বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম থেকে 'এ কোন সোনার গাঁয়' রেকর্ডে একটি ও নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত 'পাষাণের ভাঙালে ঘুম' ও 'বাজলো কি রে ভোরের সানাই' রেকর্ড দুটিতে দু'টি নজরুল-সংগীত গেয়েছেন৷ এছাড়াও তাঁর কন্ঠে নজরুল-সংগীত, কীর্তন ও পুরনো দিনের গানের বেশ কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বেরিয়েছে৷ পুরনো দিনের গানের গীতিকাররা হলেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল ও কাজী নজরুল ইসলাম৷ বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই গুণী শিল্পীর কন্ঠে ধারণকৃত ৫টি সিডি ও ক্যাসেট প্রকাশ করেছে৷ এর মধ্যে ৩ টি নজরুল সংগীতের, ১টি পুরনো দিনের গানের এবং অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান নিয়ে ১টি সিডি৷ এছাড়া ইমপ্রেসের ব্যানারে তাঁর একটি একক অডিও এ্যালবাম ‘পথের শেষে’ প্রকাশিত হয়েছে। এই এ্যালবামে তাঁর একমাত্র পুত্র আগুন তাঁর পুরো জীবনী নিজ কন্ঠে উপস্থাপন করেছেন। নিলুফার ইয়াসমিনের জনপ্রিয় কিছু গান আগুন জ্বলেরে, জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু, তোমাকে পাবার আগে, এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি, যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী, এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার, যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না, প্রতিদিন সন্ধ্যায়, মাগো আমার যে ভাই, নীল পাখিওরে, এখনো কেন কাঁদিস ও পাখি, ফুলে মধূ থাকবেই, দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা প্রভৃতি। মৃত্যু ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিলুফার ইয়াসমিনের টিউমার ধরা পড়ে৷ অপারেশনের পর তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন সংগীত ভূবনে৷ কিন্তু ২০০৩ সালের ১০ই মার্চ বারডেম হাসপাতালে তিনি সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। # দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.