অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সময় এখনই। “ভাতের কষ্ট খুব বড় কষ্ট। যুদ্ধের সময় যখন ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলাম- ভাতের চিন্তাটাই ছিল দিন রাত্রীর একমাত্র চিন্তা। শরনার্থী শিবিরে ভাতের ফ্যান পাওয়া যেত বহু কষ্টে। ভাত পেতাম না।
বহু কষ্টে মাঝে মাঝে বিস্কুট পেতাম দু একটা। খুব অবাক ব্যাপার কি জানিস? ভাত খেতে ইচ্ছে হলে ত্রিপুরায় জঙ্গলের অনেক ভেতরে চলে যেতাম। সেখানে বিশাল এক ট্রেনিং সেন্টার খুলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য। হরিণা ক্যাম্প। মনু থানার আন্ডারে ছিল সেটা।
জঙ্গলের ভেতরে যে এত বড় একটা ক্যাম্প আছে- বাহির থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। আমাদের ছোট চাচা সেখানে ট্রেনিং করাতো। কমান্ডার ছিল। শরনার্থী শিবির থেকে অবশ্য জায়গাটা বহু দূরে। কিন্তু খিদা বড় কঠিন জিনিস।
মাইলের পর মেইল রাস্তাও এতটুকু হয়ে আসতো খিদের জ্বালায়। সেখানে গভীর রাতে গেলে ভাত পাওয়া যেত। ঘর বাড়ী ছেড়ে আসা সেই সব মুক্তিযোদ্ধারা ভাত দিত আমাদের মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের। নিজেরা খেতে পারতো না। কদিন আগেই বাবা, মা, ভাই-বোনকে হারিয়ে এসেছে তারা।
কারো হয়ত ছেলে মারা গেছে পাকিস্তানীদের হাতে, কারো বোনকে তুলে নিয়ে গেছে ক্যাম্পে, কারো বাবার চোখ উপরে নিয়েছে, মেরে ফেলেছে ছড়ার ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি মেরে। খুব গভীর রাতে যখন সেই ক্যাম্পে পা টিপে টিপে যেতাম ভাতের জন্য- বিস্মিত হয়ে দেখতাম পুরুষেরাও কাঁদতে জানে, বীরেরা গভীর রাতে কাঁদে। যে সেই কান্নার আওয়াজ পায়নি কানে- সে কোনোদিন বুঝতে পারবে না আমাদের মুক্তিযুদ্ধারা কে ছিল আসলে? আমি নিজের চোখে দেখেছি ক্যাম্পের মূল অংশ থেকে একটু দূরে জঙ্গলের ভেতর দিকে গিয়ে মাটির ওপর শুয়ে কেঁদে আসতো তারা। মাটির ওপর ঘাস খামচে ধরে তুলে ফেলতে থাকতো চাপা কান্নার চোটে। কিন্তু কাউকে টের পেতে দিতে চাইতো না সজন হারিয়ে, ঘর বাড়ী হারিয়ে তাদের শিশুর মত কান্নাটুকু কেউ দেখতে পাক।
কিন্তু আমি যখন গভীর রাতে সেখানে হাঁটতাম- অবাক হয়ে শুনেছি রাতের সুনসান নীরবতার মাঝে একে একে অনেক বীরের কান্নার সুর শোনা যেতে থাকে। আমি যখন ভাতের জন্য যেতাম- নিজেদের পেট ভরা আছে বলে আমাকে তাদের ভাগের ভাত দিয়ে দিত। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে কত রাত ভাত খায়নি- কেউ জানে না। যারা নিস্তব্ধ সেই রাতে হেঁটে বেরিয়েছে ত্রিপুরার ভেতরের সেই ক্যাম্পে- তারা হয়ত একটু হলেও বুঝতে পারবে যে সেই কান্নায় কি ছিল যে প্রতি রাতে ভাতের জন্য ঘুরতে গিয়ে তাদের চাপা কান্নায় নিজের চোখে পানি চলে আসতো। ময়লা শার্টের হাতায় সেই পানি মুছতে মুছতে তাদের দেয়া ভাত খেতাম।
আমাদের জাতিটাকে আমরা প্রায়ই অনেক ছোট করে দেখি বাহিরের পৃথিবীর অন্যান্যদের থেকে। কিন্তু কেউ কি আর জানে এই দেশের মানুষগুলো কতটা মমতা ধারণ করেছে তাদের এক বুকে? কেউ জানে না। লাশের হিসেবই জানে সবাই। জয় পরাজয়ের হিসেবই জানে। গভীর রাতের নিঃশব্দতা খান খান করে ভেঙে দেয়া কোনো বীরের কান্নার আওয়াজ পায়নি আমাদের এখনকার কেউ।
যদি পেত- জনম জনম এই দেশের মাটিকে বুকের সাথে জাপ্টে রাখার চেষ্টা করতো।
আজ সেই রক্ত,ত্যাগ, কষ্ট, মা-বোনের সম্ভ্রম সব বৃথা যাবে? আমরা কি এই ৪০ বছর পরেও স্বাধীনতা বিরোধী পশুগুলোর হাতে বার বার ধর্ষীত হয়ে যাব? আর তারাও ধর্মের দোহাই দিয়ে বার বার বেঁচে যাবে? আর আমারি দেশের কিছু বাঙালির ঘর,বাড়ি পুড়িয়ে উল্লাস করবে? আর কত দিন সহ্য করবো? আর নয়। চলুন সপথ করি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নামবো। প্রজন্ম আন্দোলন এর সাথে মিলে বাংলা থেকে তাড়াবো সব ময়লা।
এবারের যুদ্ধ হবে আমাদের আসাম্প্রদায়িক বাংলায় ধর্মের নামে অনাচার করা জামাত-শিবির তাড়ানোর যুদ্ধ।
আর কোন পাপীর নিঃশ্বাসে দূষিত হতে দেবো না বাংলার বাতাসকে।
জয় বাংলা।
(কিছুটা সংগৃহীত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।