আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসলামী ব্যাংকিং



মুসলিম হিসেবে প্রথাগত ব্যাংকের সেবা গ্রহণের ভয়াবহতা প্রথাগত ব্যাংক ব্যবস্থায় জনসাধারণের জন্য তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে যে সেবা প্রদান করে থাকে তার সবটাই সুদ নির্ভর। এ সকল ব্যাংকসমূহ ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে থাকে। আবার ডিপোজিটরদেরকে তাদের গৃহীত সুদের একটি অংশ প্রদান করে তাদেরকেও সুদখোর বানিয়ে নিজের সমগোত্রীয় করে নেয়। তারা যে সকল ডিপোজিটরদেরকে সুদ দেয় না তাদেরকেও সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ফেলে। কেননা, এ সকল ডিপোজিটরগণ সুদ না পেলেও তাদের টাকা খাটিয়ে উক্ত টাকার উপর সুদ গ্রহণ করে নিজেরা খায়।

যেমন ঃ চলতি হিসাবের স্থিতির উপর, পে-অর্ডারকারীর জমাকৃত টাকার উপর এবং এল সি খোলার জন্য মার্জিন হিসাবে সংরক্ষিত টাকার উপর গ্রাহককে সুদ দেয়া হয় না বটে কিন্তু ব্যাংকসমূহ উক্ত অর্থ ঋণ হিসাবে বিতরণ করে সুদ অর্জন করে নিজেদের আয় আরও সহজেই বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। সুতরাং যে সকল ব্যক্তিই এ সকল প্রথাগত ব্যাংকের সাথে ব্যাংকিং করে তারাই সুদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কেননা, তারা হয়ত সুদের দাতা বা গ্রহীতা অথবা সুদের কারবারের সহযোগী। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলেই সুদের অভিশাপের সাথে সম্পৃক্ত। নিজেদেরকে এ সকল ব্যাংকের সাথে কর্মচারী, ঋণ গ্রহীতা, ডিপোজিটর বা সেবা গ্রহণকারী যে কোনভাবেই সম্পৃক্ত করা কতবেশী ভয়াবহ তা সকলেরই অবগত থাকা উচিত।

এ ভয়াবহতার মাত্রা আঁচ করার জন্য আমাদেরকে সুদ কি? এ সুদ সম্পর্কে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাবধান বাণী ও নিজেদের জীবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে হবে। সুদ কি ? মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে হাকীমে রিবা শব্দটি দ্বারা যে জিনিস নির্দেশ করেছেন তাই সুদ বা ওহঃবৎবংঃ . রিবা শব্দটির অর্থ হলো অতিরিক্ত, বেশী, বৃদ্ধি, বিকাশ। তবে এর দ্বারা এমন একটি অতিরিক্ত অংশকে বুঝায় যার প্রাপক এর জন্য কোন বিনিময় প্রদান করে না। এ অতিরিক্ত অংশটুকু নগদ অর্থ হতে পারে আবার সমজাতীয় অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। যেমন ঃ কোন এক ব্যক্তি অপর কাউকে একশত টাকা ধার দিল এ শর্তে যে গ্রহীতা নির্ধারিত সময় পরে একশত দশ টাকা পরিশোধ করবে।

এখানে প্রাপ্ত একশত টাকার বিনিময় হল প্রদত্ত একশত টাকা। আর অতিরিক্ত দশ টাকার কোন বিনিময় নেই। একইভাবে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে একটি নির্ধারিত মেয়াদে এক মন চাল ধার দিল এ শর্তে যে প্রতি মাস অতিক্রান্ত হওয়ার জন্য এক কেজি করে অতিরিক্ত চালসহ ফেরত দিবে। এখানে এক মন চালের বিনিময় হলো এক মন চাল। আর অতিরিক্ত অংশের কোন বিনিময় নেই।

সুতরাং তা সুদ। সুদের পরিচিতি সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে নিম্নোক্ত বিবরণ পাওয়া যায় ঃ ১. সমজাতীয় দ্রব্য কম-বেশী করা হলেও সুদের আবির্ভাব ঘটে। যেমন ঃ আবূ সাঈদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন ঃ আমরা বিভিন্ন রকমের খেজুর পেতাম। অর্থাৎ ভাল-মন্দ মিশ্রিত খেজুর। আর সেগুলো আমরা (ভাল) এক সা খেজুরের বিনিময়ে দুই সা করে বিক্রি করতাম।

কিন্তু নবী করিম সা. বলেছেন ঃ এক সা (খেজুরের) পরিবর্তে দুই সা (খেজুর) এবং দু দিরহামের পরিবর্তে এক দিরহাম (বিক্রি করা) চলবে না। Ñবুখারী ২. ক্রয়কৃত কোন পণ্য সামগ্রী নিজের হস্তগত হওয়ার আগেই বিক্রয় করে যে মুনাফা ধার্জ করা হয় তা সুদেরই নামান্তর। যেমন ঃ রাসূল সা. বলেছেনঃ ইব্ন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য পুরোপুরি নিজের অধিকারে আসার আগেই বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। (তাউস বলেন) আমি ইব্ন আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, এরূপ হবে কেন? (অধিকারে আসার আগে বেচা যাবে না কেন?) উত্তরে তিনি বলেন, তা না হলে তো পণ্যের অনুপস্থিতিতে দিরহামের বিনিময়ে দিরহাম বিক্রি করা হবে। Ñ সহীহ্ বুখারী ইব্ন আব্বাস রা. বলেন ঃ আমি এর সাদৃশ্য প্রত্যেক জিনিসের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য মনে করি।

৩. বাকীতে সমজাতীয় কোন বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় করা হলে অতিরিক্ত অংশ সুদ হিসাবে গণ্য হবে। যেমন ঃ উমর ইবনুল খাত্তাব রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন; রাসূল সা. বলেছেন ঃ নগদ বিনিময় না হলে সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি, গমের বিনিময়ে গম বিক্রি, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর বিক্রি এবং যবের বিনিময়ে যব বিক্রি করা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। ৪. জাহিলিয়াতের যুগে সর্বাধিক প্রচলিত সুদ ছিল দু’ধরনের। প্রথমতঃ কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে নগদে অর্থ লগ্নি করত এ শর্তে যে, ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময় পরে অতিরিক্ত অর্থসহ মূলধন ফেরৎ দিবে। ঐ সময়ের মধ্যে সমুদয় অর্থ ফেরৎ দানে ব্যর্থ হলে মূলধনের সাথে উক্ত অতিরিক্ত যোগ করে মোট ঋণ হিসাব করে পুনরায় তার উপর সুদ ধার্য করা হত।

এভাবে সময়ের বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ধিত হারে সুদ গ্রহণ করা হত। দ্বিতীয়তঃ পণ্যের বিক্রেতা নির্দিষ্ট মেয়াদে কোন পণ্য নগদ মূল্য অপেক্ষা বেশী মূল্যে বাকীতে বিক্রয় করত। উক্ত নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে বর্ধিত মেয়াদের জন্য অতিরিক্ত মুনাফা যোগ করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিত। এভাবে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে সুদ হিসাবে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হত। সুতরাং কোন বস্তু সমজাতীয় বস্তুর সাথে বাকীতে বিনিময় করে কোন অতিরিক্ত গ্রহণ করলে, নগদ অর্থ ঋণ হিসাবে প্রদান করে কোন অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করলে, কোন পণ্য বাকীতে বিক্রয় করে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে এর বর্ধিত মূল্য গ্রহণ করলে, কাউকে কোন নগদ অর্থ বা কোন ভোগ্য পণ্য ঋণ হিসাবে প্রদান করে ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে কোন স্থায়ী সম্পদ ঐ সময়ের জন্য বন্ধক বা নিজের দখলে রেখে উক্ত স্থায়ী সম্পদ হতে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করলে, এ সকল গৃহীত বিনিময়হীন বস্তু সামগ্রীই হল সুদ।

সুদ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাকের বাণী ১. যারা সুদ খায়, তাদের অবস্থা হয় সেই ব্যক্তির মত যাকে শয়তান আপন স্পর্শ দ্বারা পাগল ও সুস্থ জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। তাদের এইরূপ অবস্থা হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে ঃ ব্যবসা তো সুদের মতই জিনিস। অথচ আল্লাহ্ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির নিকট তার রব এর তরফ হতে এই উপদেশ পৌঁছবে এবং ভবিষ্যতে এই সুদখোরী হতে বিরত থাকবে সে পূর্বে যা কিছু খেয়েছে, তা তো খেয়েছে Ñ সেই ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্রই উপর সোপর্দ। আর যারা এই নির্দেশ পাওয়ার পরও এর পুনরাবৃত্তি করবে, তারা নিশ্চিতরূপে জাহান্নামী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।

Ñ আল-বাকারা ঃ ২৭৫ ২. হে ঈমানদারগণ! এই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া ত্যাগ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর; আশা করা যায় যে, তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। সেই আগুন হতে আত্মরক্ষা কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। -আল ইমরান ঃ ১৩০-১৩১ ৩. যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না। -র্আ রূম ঃ ৩৯ ৪. হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ লোকদের নিকট পাওনা রয়েছে তা ছেড়ে দাও, যদি বাস্তবিকই তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। কিন্তু তোমরা যদি এরূপ না কর, তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে।

-আল বাকারা ঃ ২৭৮-২৭৯ সুদ সম্পর্কে রাসূল সা. এর হাদীস ঃ ১. জাবির বিন আবদুল্লাহ্ রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্র সম্পাদনকারী, সাক্ষী সকলের উপর অভিশাপ (লানত) দিয়েছেন এবং বলেছেন তারা সকলে সমান অপরাধী। Ñসহীহ্ আল মুসলিম। ২. আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন ঃ সুদের সত্তর ভাগের ক্ষুদ্রতম ভাগ এই পরিমাণ যে, কোন ব্যক্তি স্বীয় মাতার সাথে যেনা করে। Ñ ইব্ন মাজাহ্ , বায়হাকী, হাকেম। ৩. সামুরা ইব্ন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবী সা. বলেছেন ঃ আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম, তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল।

আমরা চলতে চলতে একটি রক্ত নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, আর নদীর তীরে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর। এরপর নদীর মাঝে দাঁড়ানো ব্যক্তি তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুখণ্ডল লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য করল। এভাবে যখনই সে উঠে আসার চেষ্টা করছে তখনই তীরের লোকটি তার মুখ লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারছে, যার ফলে সে (পূর্বস্থানে) ফিরে যাচ্ছে এবং পূর্ববৎ অবস্থান গ্রহণ করছে। নবী সা. বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম এ লোকটি কে (কি কারণে তার এ শাস্তি হচ্ছে বা তার এ অবস্থা কেন? ) তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বললো ঃ নদীর মধ্যে দাঁড়ানো যে লোকটিকে দেখলেন, সে এক সুদখোর।

- বুখারী সুদের ভয়াবহতা ইতিমধ্যে আমরা সুদের সাথে পরিচিত হলাম এবং উক্ত সুদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী এবং রাসূল সা. এর হাদীস অবগত হলাম। মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী, রাসূল আকরাম সা. এর হাদীস এবং বর্তমান অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে এর এমন একটি ভয়াবহ চিত্র খুঁজে পাই যে, সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর জীবনের ন্যূনতম স্বার্থকতা বলতেও কিছু থাকে না। তাদের চিত্তাকর্ষক রঙ্গিন জীবনের অন্তরালে লুকিয়ে আছে চোরাবালির ন্যায় এক দুর্ধর্ষ মরণ ফাঁদ। যে ফাঁদে আটকে মানুষ কেবল মৃত্যুর মাধ্যমে ধ্বংসই হয়ে যায় না বরং অনন্ত কালের জন্য চরম দশায় নিপতিত হয়ে ধুকে ধুকে জ্বলতে থাকবে অথচ সে নিজে বা তার যন্ত্রণা কিছুমাত্র নিঃশেষ হবে না। সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জীবনের তিনটি পর্যায়ে সুদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে।

সুদ মানুষের তিনটি বিষয়ের উপর চরম আঘাত হানে। প্রথমতঃ মানুষের ঈমানদারীতায়, দ্বিতীয়তঃ পরকালীন মুক্তির বিষয়ে, তৃতীয়তঃ মানুষের ইহকালীন অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। অর্থাৎ সুদের কারণে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অন্যতম মৌলিক পরিচয় ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হতে বঞ্চিত হয়, পরকালীন জীবনে মেহেরবান আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত জান্নাত লাভের পরিবর্তে জাহান্নামে নিপতিত হওয়াকে নিশ্চিত করে এবং যে দুনিয়ার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভের মাধ্যমে সুখ-সমৃদ্ধি লাভের স্বপ্ন দেখে সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে পরিশেষে দুনিয়ার সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা সুখ-শান্তি হতেও বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ তার সব কূলই হয় অপসৃত। কুরআন, সুন্নাহ্ ও সমকালীন অর্থনৈতিক গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সুদ সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে Ñ একজন ঈমানদার তার মৌলিক পরিচয় হারায় কোন ব্যক্তি যখন সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে অর্থাৎ সুদ গ্রহণ করে, সুদ দেয় বা সুদের লেনদেনের সহযোগী হয়ে পড়ে তখন সে আর প্রকৃত ঈমানদার থাকে না।

সে হয় বেঈমান, অবিশ্বাসী বা কপট বিশ্বাসী। আমরা নিজের হাত দ্বারা চোখ টিপে ধরে দেখা থেকে চোখকে বঞ্চিত করতে পারি, নিজের কানে আঙ্গুল দিয়ে সাময়িক বধিরতা গ্রহণ করে শ্রবন থেকে বিরত থাকতে পারি, শয়তানী যুক্তিকে গ্রহণ করে বিবেককে করে দিতে পারি পরাভূত। কিন্তু যে মহান আল্লাহ্ পাক নির্ধারণ করবেন কে ঈমানদার আর কে বেঈমান তাঁর কাছে এর কোন কিছু দ্বারাই নিজের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। কেননা ইসলাম ঈমানদারের যে সংজ্ঞা দেয় কোন ব্যক্তি সুদ সংশ্লিষ্ট হলে সে আর উক্ত সংজ্ঞায় পড়ে না। ঈমানদার বলতে কি বুঝায়, তা জেনে নিয়ে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত পরিচয়ধারী কি না বিশ্লেষণ করলেই সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঈমানদার হওয়া সম্পর্কে যথার্থ অবস্থা প্রতিভাত হবে।

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস। ইসলামী পরিভাষায় শুধুমাত্র বিশ্বাস করাকেই ঈমান হিসেবে গণ্য করা হয় না। তিনটি অবস্থার সহাবস্থানের নাম হলো ঈমান। এ তিনটি অবস্থা হলো প্রথমতঃ কোন একটি বিষয় দৃঢ়তার সাথে অন্তরে বিশ্বাস করা, দ্বিতীয়তঃ দ্ব্যর্থহীনভাবে উক্ত বিষয়ে মৌলিক ঘোষণা বা স্বীকৃতি দেয়া এবং তৃতীয়তঃ বাস্তব কার্যাদীর মাধ্যমে নিজের বিশ্বাসের বাহ্যিক পরিস্ফুটন ঘটানো। এখন প্রশ্ন হলো কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হবে? এবং এ বিশ্বাস স্থাপনের মর্মার্থ কি এবং এর বাস্তব দাবী কি? পবিত্র কালামে হাকীমে মহান আল্লাহ্ পাক বলেন ঃ “তোমরা পূর্বদিকে মুখ করলে, না পশ্চিমদিকে মুখ করলে এতে সত্যিকার অর্থে কোনই কল্যাণ নিহিত নেই।

আসল নেকীর ব্যাপার হচ্ছে, একজন মানুষ আল্লাহ্্র উপর ঈমান আনবে, পরকালের উপর ঈমান আনবে, ঈমান আনবে আল্লাহ্্র ফিরিশতাদের উপর, আল্লাহ্্র কিতাবের উপর, নবী-রাসূলদের উপর। Ñসূরা বাকারা ঃ আয়াত ১৭৭ পবিত্র কালামে হাকীমের উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ্্ তাআ’লা পাঁচটি বিষয়ের উপর ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। এ পাঁচটি বিষয় হলোÑ (১) মহান আল্লাহ্্ পাকের উপর ঈমান। (২) পরকালের উপর ঈমান। (৩) আল্লাহ্্র ফিরিশতাদের উপর ঈমান।

(৪) আসমানী কিতাবসমূহের উপর ঈমান। (৫) নবী-রাসূল বা রিসালাতের উপর ঈমান আনতে হবে। এখন আমাদেরকে এ সকল বিষয়ের উপর ঈমান আনার অর্থ কি? ঈমান আনার কারণে আমাদেরকে কোন বিশ্বাস অন্তরে লালন করতে হবে এবং কি ধরনের ঘোষণা দিতে হবে ও কি কি বাস্তব কাজ সম্পাদন করতে হবে তা বুঝে নিতে হবে। সুদ সংশ্লিষ্ট কোন মানুষের এ সকল বিষয়ের উপর ঈমান থাকে কিনা তা বিবেচনা করতে হবে। আল্লাহ্্র উপর ঈমান মহান আল্লাহ্্ পাকের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ্্ সম্পর্কে কতিপয় বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করতে হবে এবং সেই সকল বিশ্বাসের মৌখিক স্বীকৃতি দিতে হবে ও নিজের বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রূপদানের মাধ্যমে বাস্তব সাক্ষী হয়ে দাঁড়াতে হবে।

মহান আল্লাহ্্পাক মানব জাতির কাছে পবিত্র কালামে পাকের মাধ্যমে নিজের পরিচয় পেশ করেছেন। একজন মানুষকে মুসলিম হতে হলে মহান আল্লাহ্্ পাকের সেই পরিচয় অনুসারেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, সেই পরিচয়ের মৌখিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং নিজের কার্যকলাপের মাধ্যমে আল্লাহ্কে সেই মর্যাদাই দিতে হবে। তবেই আল্লাহ্্র উপর তার পূর্ণ ঈমানের পরিচয় পাওয়া যাবে। সুতরাং নিজের ঈমানের পরিচয় পাওয়ার জন্য প্রথমে আল্লাহ্্ পাকের পরিচয় জানতে হবে এবং এ সম্পর্কে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের অবস্থা পর্যালোচনা করে ঈমানের অবস্থার পরিমাপ করতে হবে। আল্লাহ্ পাকের গুণবাচক নামসমূহের পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহ্্র পরিচয় জানা যায়।

যেমন ঃ রব পবিত্র কালামে হাকীমে সর্বপ্রথমই আল্লাহ্ পাকের এ গুণবাচক নামটি উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষে রব শব্দের যে অর্থসমূহকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলে স্থান দেয়া হয়েছে তা হলোÑ১.মালিক ও মুনিব ২. মুরব্বি, প্রতিপালক, পর্যবেক্ষক ও সংরক্ষনকারী ৩. শাসক, আইনদাতা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। আল্লাহ্্ তাআ’লা এ সবদিক দিয়েই সমগ্র সৃষ্টিলোকের রব্ব। ১ কোন মানুষ যদি সুদ সংশ্লিল্ট হয় তবে সে মানুষের নির্দেশ মেনে নিল ফলে সে আল্লাহ্্র পরিবর্তে সেই মানুষটি বা মানুষগুলোকেই নির্দেশদাতা হিসেবে গ্রহণ করল। ফলে তারা খোদাদ্রোহী হওয়া স্বাভাবিক।

সুতরাং আল্লাহ্্র কাছে তাদের ঈমান আনার দাবী গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে কপট বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। খালিক খালিক শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা। এখানে এমন এক সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানো হয়েছে যিনি কোন কিছুর অস্তিত্ব ছাড়াই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষসহ জগতের সকল প্রাণীকূল সৃষ্টি করেছেন এবং মহাবিশ্বের সবকিছুই তাঁর একক সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহ্্র উপর ঈমান আনার পর ঈমানদার ব্যক্তিটিকে বিশ্বাস করতে হবে মহান আল্লাহ্ পাক মানুষসহ সমগ্র জগতের স্রষ্টা, তিনি অতীতে সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলেন, বর্তমানেও শক্তিমান এবং অনন্তর ভবিষ্যতেও তাঁর একই শক্তি পূর্ণমাত্রায় অটুট থাকবে।

সুতরাং মহান আল্লাহ্ই সর্বশক্তিমান। কোন মানুষ যদি প্রকৃতই আল্লাহ্্র এ বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশ্বাসী হয় তবে অবশ্যই সেই মানুষটির বাহ্যিক আচরনেও তা পরিলক্ষিত হবে। কোন মানুষ যদি আল্লাহ্কে এ জগতের স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করে এবং এও বিশ্বাস করে যে তিনি কুরআনে বর্ণিত জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করে পুনরায় সেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে সক্ষম তবে অবশ্যই কোন মানুষের পক্ষেই আল্লাহ্্র নাফরমানী করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যারা মহান আল্লাহ্্র নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করতে মোটেও চিন্তিত হয় না, তাদের মনে নিশ্চয় আল্লাহ্্র সৃষ্টি ক্ষমতার বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে বুঝতে হবে। তারা হয়ত মনে করে এ জীবন এক নিছক সৃষ্টি, মৃত্যুর পর যেহেতু দেহ পচে গলে মাটির সাথে নিঃশেষ হয়ে যাবে তা আর নতুন করে জীবিত হওয়া সম্ভব নয়।

আর তাদের এ ধরনের বিশ্বাসের কারণেই মূলতঃ তারা পরকালের ব্যাপারে উদাসীন। আর ট্রেডিশন হিসেবেই আল্লাহ্্র উপর আস্থা থাকার ঘোষণা দেয়। মূলতঃ তারা আল্লাহ্্র সৃষ্টি করার ক্ষমতার উপর ঈমান রাখে না। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই তাদের মুসলিম হওয়ার দাবী যুক্তিসঙ্গত নয়। যেহেতু সুদ আল্লাহর মৌলিক নিষেধাজ্ঞাসমূহের একটি সেহেতু কেউ সুদ সংশ্লিষ্ট হলে আল্লাহর উপর তার ঈমান আছে বলে প্রতিয়মান হয় না।

রাজ্জাক রাজ্জাক শব্দটির বাংলা অর্থ হলো রিজিকদাতা। যে ব্যক্তিটি ঈমান লাভ করেছে সে আল্লাহ্কে রিজিকদাতা হিসেবেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে। উক্ত ব্যক্তির চলনে ও বলনে তার এ বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হবে। মহান আল্লাহ্ পাক সামষ্টিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবেও আমাদেরকে এককভাবে রিজিক দিয়ে থাকেন। সুতরাং প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত রিজিকদাতাও একমাত্র আল্লাহ্।

কোন মানুষ যখনই এ বিষয়ে ঈমান আনবে যে, তার রিজিকের ব্যবস্থা করার সামর্থ পৃথিবীর কোন শক্তিরই নেই; সে আল্লাহ্ পাকের আনুগত্যের ব্যাপারে এই অজুহাতে শিথীলতা প্রদর্শন করবে না যে, তার রিজিকের জন্য অপর কোন মানুষের উপর সে নির্ভরশীল। সে রিজিকের জন্য আল্লাহ্র অবাধ্য কোন শক্তির সহযোগী হতে পারবে না। এমনকি এ বিশ্বাসও তার মনে থাকবে না যে, আল্লাহ্্র বিধান লঙ্ঘনকারী কোন কর্তৃপক্ষ তার রিজিক বৃদ্ধিতে সামান্যতম অবদান রাখতে পারে বা কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত রিজিক বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির স্বার্থে সে কখনওই আল্লাহ্র আনুগত্যের ব্যাপারে আপোষ করবে না। আর যখনই সে এ বিষয়ে আপোষ করল মনে করতে হবে তার ঈমানের দূর্বলতাই সে আপোষের প্রেরণার মূল উৎস।

অতএব সুদ সংশ্লিষ্ট মানুষের আচরণে প্রমাণ করে সে আল্লাহ্কে রাজ্জাক বা রিজিকদাতা হিসেবে মানতে নারাজ। সামি’উ এবং বাসির আল্লাহ্ পাকের এ দুটি নামের প্রথমটির অর্থ সর্বশ্রোতা এবং দ্বিতীয়টির অর্থ সর্বদ্রষ্টা বা সূক্ষ্মদর্শী, সবজান্তা ইত্যাদি। আল্লাহ্ পাকের এ দুটি নাম দ্বারা প্রকাশ পায় মহান আল্লাহ্ পাক জগতের সকল স্থানের ক্ষুদ্র-বৃহৎ, প্রকাশ্য এবং গোপনীয় সবকিছু শোনেন এবং দেখেন। এমনকি মানুষের মনের গহীন কোনের চিন্তা ও পরিকল্পনাও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। যারা এ বিষয়টি বিশ্বাস করে আল্লাহ্পাকের শক্তি ও কঠোরতা সম্পর্কেও অবগত আছেন।

স্বাভাবিক কারণেই আল্লাহ্ পাকের সামনে তাদের দ্বারা আল্লাহ্ নিষিদ্ধ কোন কাজ সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। যদি তারা আল্লাহ্ নিষিদ্ধ সুদের মত কোন কাজে জড়িত থাকেন তবে বুঝতে হবে আল্লাহ্্র সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে সংশয় রয়েছে তাদের ঈমানের দাবী কেবলই মৌখিক ও আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ। বাস্তবতঃ তারা যথাযথ ঈমানদার নয়। ক্কাহ্হার, মুনতাকিম, দার এখানে আল্লাহ্ পাকের তিনটি নাম উল্লেখিত হয়েছে যার প্রথমটির অর্থ হলো প্রভাবশালী, শক্তিশালী, দমনকারী ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং তৃতীয়টির অর্থ হলো অত্যন্ত ক্লেশদাতা, আযাবদাতা।

এখানে আল্লাহ্ পাকের এ তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ্ পাক তাঁর অবাধ্যদের বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং তিনি প্রতিশোধ গ্রহণে নিশ্চিত সক্ষম ও শক্তিমান। সুতরাং যারা আল্লাহ্ পাকের অবাধ্যতায় লিপ্ত আল্লাহ্ পাক তাদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর তিনি তাদেরকে অত্যন্ত ক্লেশ বা আযাব দিবেন। এ আযাব পৃথিবীর কোন আযাবের সাথেই তুলনাযোগ্য নয়। কেননা দুনিয়ার আযাব সর্ব্বোচ্চ মৃত্যু পর্যন্ত।

তারপর দুনিয়ার আর কোন শাস্তিই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। অপরদিকে পরকালের আযাব অনন্ত, অসীম এবং তার কঠোরতাও অকল্পনীয়। অতএব যারা আল্লাহ্্র আইন লঙ্ঘন করে, সুদ সংশ্লিষ্ট হয় তারা এবং তাদের সমর্থনকারী ও সহযোগীরা আল্লাহ্্র শাস্তিতে পতিত হবে। এ অবস্থায় কোন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে মানুষের শাস্তির ভয়ে বা রিজিকের ভয়ে তাদের আনুগত্য করে আল্লাহ্্র আযাবে পতিত হওয়াকে গ্রহণ করে নেবে না। প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহ্্র সীমাহীন শাস্তি হতে মুক্তি লাভ করে জান্নাত লাভের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হবে।

অতএব যারা এ পৃথিবীতে প্রাচুর্য লাভের জন্য আল্লাহ্্র আইনের পরিবর্তে সুদী অর্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিবে তারা মূলতঃ আল্লাহ্্র শাস্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার মতই ধৃষ্টতা দেখায়। তারা প্রকৃত ঈমানদার নয়। পরকালের উপর ঈমান একজন মানুষকে আল্লাহ্ পাকের উপর ঈমান আনার সাথে সাথে পরকালের উপর ঈমান আনতে হবে। পরকালই হলো মানুষের জীবনের সকল কর্মের কেন্দ্রবিন্দু। পরকালের উপর বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মুসলমানদের জীবনধারা আবর্তিত।

পরকালের জীবনই অনন্ত, সীমাহীন জীবন। মহান আল্লাহ্ পাক পরকালের প্রতি বিশ্বাসের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বলেন Ñ “এবং যারা পরকালকে বিশ্বাস করবে না, তাদের জন্য রয়েছে পরকালের ভয়াবহ শাস্তি। ” Ñ সূরা বনী ইসরাঈল ঃ আয়াত ১০ মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে হাকীমে মানুষকে পরকালের সাথে বহু আয়াতের মাধ্যমে পরিচিত করে তুলেছেন। যেমন ঃ “তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক শ্লাঘা ও ধনে জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার উপমা বৃষ্টি, যা দিয়ে উৎপন্ন শস্যসম্ভার কৃষকদের চমৎকৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়।

ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহ্্র ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়। ” Ñ সূরা হাদীদ ঃ আয়াত ২০ অপর আয়াতে বলা হয়েছে Ñ “শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন।

অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার পালনকর্তার নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা স্থাপন করা হবে, পয়গম্বরগণ ও সাক্ষীগণকে আনা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে Ñ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। প্রত্যেকে যা করেছে তার পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেয়া হবে।

তারা যখন সেখানে পৌঁছবে, তখন তার দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বর আসেনি যারা তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতো এবং সতর্ক করতো এ দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে ? তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু কাফিরদের প্রতি শাস্তির হুকুম বাস্তবায়িত হয়েছে। বলা হবে তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্য। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল। যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌঁছাবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম।

তোমরা সুখে থাক। অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর । তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্্র, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী করেছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। আমলকারীদের পুরস্কার কতই না চমৎকার।

” Ñ সূরা যুমার ঃ আয়াত ৬৮ -৭৪ পবিত্র কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত আয়াতসমূহ হতে আখিরাতের যে চিত্র পাওয়া যায় তা হলো, আল্লাহ্্র নির্ধারিত কোন একটি বিশেষ সময়ে আল্লাহ্্র আদেশে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। যার ফলে এ পৃথিবীর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর পুনরায় আল্লাহ্্র নির্দেশে আরো একটি ফুঁক দেয়া হলে সকল মানুষই পুনরুজ্জীবিত হবে এবং সমবেত হবে। তখন আল্লাহ্পাক তাদের কৃতকর্মের বিচার করবেন এবং বিচারের সময় সকল সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করে পূর্ণ ন্যায় বিচার করা হবে । পৃথিবীতে যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে অর্থাৎ যারা ঈমান আনেনি অথবা ঈমান আনার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও মুনাফেকী করেছে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেখানে তারা চিরদিন থেকে সীমাহীন দূর্ভোগ আস্বাদন করবে এবং যারা ঈমানদার এ দুনিয়াতে আল্লাহ্্র হুকুম-আহকাম যথাযথভাবে পালন করেছে, শিরক থেকে, খোদাদ্রোহীতা থেকে বিরত ছিল তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে এবং আল্লাহ্্র সীমাহীন নিয়ামত ভোগ করবে এবং মহাসম্মানিত হবে।

সুতরাং যারা প্রকৃতই ঈমান এনেছে তারা পরকালের বিষয়ে আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাদেরকে যা কিছু অবগত করেছেন তার সবকিছুই আন্তরিকতার সাথে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবেন। স্বাভাবিক কারণেই তারা জাহান্নামের ভয়ে ভীত থাকবেন, ফলে তারা ইসলাম নিষিদ্ধ সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা লঙ্গন করবেন না এবং মহান আল্লাহ্ পাকের প্রতিশ্র“ত নিয়ামত জান্নাতের প্রত্যাশায় শত কষ্ট স্বীকার করে হলেও সুদ বর্জন করবে। পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় আল্লাহ্্র বিধি-বিধান অমান্য করে সুদ সংশ্লিষ্ট হয় তারা অবশ্যই পরকালকে অস্বীকার করে। যেমন ঃ মহান আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেনÑ “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে (অস্বীকার করে) ? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। ” Ñ সূরা মাউন ঃ আয়াত ১-৩ উপরোক্ত আয়াত হতে আমরা বুঝতে পারি, যারা পরকালকে অস্বীকার করে বা মিথ্যা মনে করে কেবল তারাই আল্লাহ্্র বিধি-বিধান লঙ্ঘন করতে পারে।

সুতরাং আল্লাহ্ পাকের বাণী অনুসারে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যারা আল্লাহ্্র অসন্তুষ্টির কারণ ঘটতে পারে এরূপ কাজ করে বা আল্লাহ্্র নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে তারা ঈমান আনার ঘোষণা দিলেও মূলতঃ পরকালের বিষয়ে ঈমান আনেনি। বিষয়টি একটি বাস্তব উদাহরনের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়। “কেউ তার এমন একটি ঘর বা হলরুম পাহারা দেয়ার জন্য ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য একজন দারোয়ান নিয়োগ করল যেখানে উন্নত ও লোভনীয় খাদ্য-সামগ্রী, স্বর্ণ, মণি-মুক্তা ও সহজে বহনযোগ্য বহু মূল্যবান রতœ রয়েছে। দারোয়ানকে এ শর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যে, তাকে একটি নির্দিষ্ট সময় বা একমাস পর্যন্ত এ রুমটি পাহারা দিতে হবে। এ সময়ে তাকে প্রত্যহ মাত্র দুবার খাদ্য ও পানীয় দেয়া হবে।

সে উক্ত রুমে রক্ষিত কোন খাদ্য ও সম্পদ স্পর্শ করতে পারবে না। যদি চুক্তি লঙ্ঘন করে বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত এ সকল দ্রব্যের কোনটি ভোগ করে বা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে তবে হাত ও পা কেটে দেয়া হবে। অপরদিকে সে যদি সফলতার সাথে তার পাহারাকার্য উক্ত নির্দিষ্ট মেয়াদে পূর্ণ করতে পারে তবে তাকে উক্ত খাদ্যসামগ্রী ও সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দেয়া হবে। আর তাকে আরও জানিয়ে দেয়া হলো তার গতিবিধি রেকর্ড করে রাখার জন্য একটি স্বয়ংক্রীয় ক্যামেরা সেখানে স্থাপন করা আছে যা সে কোনভাবেই ফাঁকি দিতে সক্ষম নয়। ” বর্ণিত অবস্থায় উক্ত দারোয়ানের ভূমিকা কি হবে তা তার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করবে।

সে যদি বিশ্বাস করে প্রকৃতপক্ষেই তার প্রতিটি মুহূর্তের অবস্থা রেকর্ড হচ্ছে এবং তার নিয়োগকর্তা তা সরাসরি যন্ত্রের সাহায্যে দেখছে এবং কোন কিছুই স্পর্শ না করলে তাকে মেয়াদান্তে অর্ধেক দিয়ে দেয়া হবে তবে সে অবশ্যই শত খাদ্য কষ্টে থাকা সত্ত্বেও কোন কিছুই স্পর্শ করবে না। কিন্তু সে যদি মনে করে নিয়োগকর্তার দেয়া তথ্য মোটেও সঠিক নয়, ক্যামেরা নামের কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই, মেয়াদান্তে তাকে কিছুই দেয়া হবে না এবং নিয়োগকর্তা কিছুই আঁচ করতে পারবে না, কেবলমাত্র তাকে দিয়ে ঠিকঠাক মতো পাহারা দেয়ানোর জন্যই মিথ্যা প্রতিশ্র“তি দিয়েছে তবে সে অর্ধভুক্ত না থেকে খাদ্য কিছুটা হলেও ভক্ষণ করতে পারে এবং যথাসম্ভব মণি-মুক্তা আত্মসাৎ করতে পারে। অতএব যদি সে এ ধরনের আত্মসাৎমূলক কাজ করে তবে মনে করতে হবে সে তার নিয়োগকর্তার প্রতিশ্র“তি বিশ্বাস করেনি। আর তাই বলা যায় যারা আল্লাহ্্র বিধি-বিধান বাস্তবে অনুসরণ করছে না অর্থাৎ সুদ সংশ্লিষ্ট হচ্ছে তাদের ঈমানের মধ্যেই ত্র“টি রয়েছে। এখন আমরা সুদখোর, সুদদাতা ও এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে কুরআনের ঘোষনা জানব।

সূরা বাকারার ২৭৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ পাক বলেন ঃ “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ লোকদের নিকট পাওনা রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি বাস্তবিকই তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। যদি এরূপ না কর তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে। ” এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর ঈমানদার বান্দাদেরকে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন বাস্তবিকই যদি তারা ঈমানদার হয়ে থাকে তবে যেন সুদ ছেড়ে দেয়। সুতরাং আল্লাহর এ নির্দেশানুসারে যদি কেউ সুদ ছেড়ে না দেয় তবে সে প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার নয়। এ আয়াতে আরও বলা হয়েছে, যে সুদ ছেড়ে দেবে না তার সাথে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে।

অপরাপর আয়াতে সুদখোরদের ব্যাপারে আরও ভয়াবহ সতর্ক বাণী রয়েছে। তাদেরকে নিশ্চিত জাহান্নামের অধিবাসী হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছে, যে জাহান্নামে রয়েছে অকল্পনীয় উত্তাপময় আগুন, বিষধর সাপ, খাদ্য হিসেবে রয়েছে কণ্টকযুক্ত যাক্কুম গাছ, ফুটন্ত পানি, রক্ত ও ক্ষত নিঃসৃত পুঁজ। দুনিয়াতেও সুদের কুফলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। সুতরাং এত কিছু জানার পরও যারা সুদ খায় ও দেয় তারা নিজেদেরকে ঈমানদার মনে করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। আর ঈমানহীন কোন মানুষ মুসলমান হতে পারে না, তাদেরকে বলা হয় মুনাফিক।

কেননা, মানুষ তার নিকট ভবিষ্যতেও বিশাল ক্ষতির বিনিময়ে বর্তমানে সামান্য সুখ বা সুবিধা গ্রহণে রাজি হয় না। যেমন ঃ কোথাও মারাত্মক বিষ মিশ্রিত সুদর্শন ও লোভনীয় খাবার সজ্জিত করা আছে। একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি তা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল আর এমন সময় অপর ব্যক্তি তাকে জানিয়ে দিল এ খাবারে মারাত্মক বিষ মিশ্রিত রয়েছে। আস্বাদন করামাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। এ অবস্থায় যদি ঐ ব্যক্তি সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্বাস করে তবে ক্ষুধা সহ্য করে সে খাবার ত্যাগ করবে।

আর তার খাবার গ্রহণের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঐ সংবাদের কারণে তা গ্রহণ না করার দ্বারাই প্রমাণ হয় যে, সে উক্ত সংবাদ বিশ্বাস করেছে। অপরদিকে সে যদি উক্ত খাবার গ্রহণ করে তবে তাতেই প্রমাণিত হবে সে সংবাদদাতার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.