ভালবাসতে ধৈর্য্য লাগে, অ-নে-ক!
স্টকহোমস, সুইডেন :
নোয়াখালীর মাহমুদ , ২৬ বছরের যুবক। ২০০৩ এ দেশ ছাড়ে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে। টানা ৪ বছর ওয়েলস-এ থেকে, ১ বছর সাইপ্রাসে কাটিয়ে, আজ প্রায় আড়াই বছর সুইডেনে। একা। মা-বাবার প্রথম সন্তান, দুই ভাই বোনের বড় ভাই।
আত্মীয়-স্বজনের কেউ নেই প্রবাসে। সুইডেন এসে এক বাঙ্গালীর বাসায় উঠে, পরিচিত কেউ না, আত্মীয় না - শুধু বাঙ্গালী, এই সুত্রে উঠা। পরে পার্ট-টাইম চাকরিও একই বাঙ্গালীর রেস্টুরেন্টে। কাজ-ক্লাশের পরে মাঝে মাঝে মালিকের ১০ বছরের ছেলে ইরতিজার সাথে ভিডিও গেইম বা বাস্কেটবল খেলা। কখনও সমবয়সীদের সাথে ছুটির রাতে কার্ড খেলা।
হঠাৎ যখন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তখন চাচী (ইরতিজার মা) ভাল-মন্দ রাঁধেন,যদিও মায়ের রান্নার মত হয় না । তবু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মাহমুদ। গতানুগতিক জীবন। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় বাবার সাথে। মা-র সাথে তেমন হয় না।
সপ্তাহে এক-দুই বার, যদিও মা'র জন্য টানটা বেশি, কিন্তু কথা বললেই, হয়ত মা-কে কোন নতুন দুশ্চিন্তা দিয়ে দিবে নিজের অজান্তেই। সব মা-ই বুঝে সন্তানের মন,তবু ওর মনে হয় মা যেন ওকে একটু বেশী বুঝেন, কখনই কিছু লুকাতে পারে না, তাই তেমন কথা বলা হয়ে উঠে না মা'র সাথে। একটু অন্তর্মুখী, তাই ভালোবাসা-আবেগ প্রকাশ করা হয়ে উঠে না অত সহজে, আপনপজনদের কাছেও না।
সময়ের সাথে চাকরি বদলায়, বদলায় আশেপাশের মানুষ। নতুন বাসায় উঠে, চাচীর সারপ্রাইজ কোন নাশতা থাকে না।
নিজেই রান্না করে খেতে হয়। রান্নায় অদক্ষ নয় কিংবা আলস্যও নেই, তবে যাদের সাথে, তারা তৈরী খাবার খেতে দেরী না করলেও, অন্যবেলা নিজেরা ভালমন্দ কিছু রান্নার চেষ্টা করতেও অনেক দেরী করিয়ে দেন। একবার ,দুইবার, বারবার এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি হতে দেখে এখন আর বাসায় রান্না করেনা মাহমুদ খুব বিপদে না পরলে। কাপ নুডলস, স্যান্ডউইচ খেয়ে দিন কাটায়, মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে রেস্টুরেন্টে ফ্রাইড রাইস দিয়ে চালিয়ে নেয়।
দেশে মা কাঁদেন ছেলের স্বাস্থ্যহানির ছবি দেখে।
ছেলে নির্বিকার থাকে,থাকতে হয়। ডুবে যেতে হয় পড়া শেষ করার, নিজেকে প্রতিষ্টিত করার চেষ্টায়। বাবার কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা কমানোর আপ্রান চেষ্টা। ছোট ভাই বোনদের, কখনও প্রিয় খালা-চাচাদের শখের আবদার মেটানোর প্রচেষ্টা !
এরই মাঝে যোগ হয়েছে নতুন চিন্তা, প্রিয় মানুষ-টাকে বিয়ে করার প্রস্তুতি।
ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড :
আহমেদ, হবিগঞ্জের ছেলে।
প্রায় ৫ বছর প্রবাসে। অনেক ছাত্রের স্বপ্নের "স্টুডেন্ট ভিসা" নিয়ে বিদেশে পড়তে আসা আরো এক বাঙ্গালী। নিঃসন্তান মামা-মামীদের বাসায় আছে প্রথম থেকেই। খাবারের অভাব না হলেও, আন্তরিকতার অভাবে ক্ষুধা থাকলেও খাওয়ার রুচি হয় না, মা-বাবা আর ছোট ২ বোনের আহলাদের এই একমাত্র ছেলে/ভাই-টির। ২৯ বছরের এই যুবক, এখনও মনের দিকে ১০ বছরের এক কিশোরের মতই সরল আর কোমল।
বরাবরই মা নেওটা ছিল,তবু এখন মা'র বয়েসী মামীকে তেমন ভাল লাগে না। অবশ্য ওরই বা দোষ কি? মামী মানুষটাই জানি কেমন, কখনো মা হতে পারেন নি বলেই হয়তো 'মা'-ভাবটা নেই। অনার্স শেষ হয়েছে ২ বছর, তবু চাকরি মিলছে না মনমত। নিজের পড়াশোনার খরচ, বাবার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, এক বোনকে বিয়ে দিতে, ছোট বোনের ডাক্তারী পড়ার খরচ যোগান দিতে, এই কয়েক বছরে অনেক ঋণ করতে হয়েছে নানাজনের কাছ থেকে। বিন্দু বিন্দু করে করা এসব ঋণ এখন পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার সাথে যোগ হয়েছে, ভিসার মেয়াদ ফুরানোর দুশ্চিন্তা। স্থানীয় কোন ব্রিটিশ সিটিজেন বাঙ্গালীকে বিয়ে করলে হয়ত সমস্যার সহজ সমাধান হত, কিন্তু কথার লোক আহমেদ। কখনো না দেখে ভালোবেসেছে আমেরিকা প্রবাসী আরেক বাঙ্গালীকে। স্বপ্ন দেখেছে দুজন একসাথে। এখন নিজের স্বার্থকে বড় করে, মেয়েটাকে একা করে দেওয়ার মত অমানবিক কাজ করতে চায় না আহমেদ।
প্রতিদিন সকালে, দুপুরে, বিকেলে, কাজের আগে, মাঝে কিংবা পরে কথা বলে দেশে রেখে আসা মা-বাবা ছোট বোনের সাথে, এখানে বসেই খোঁজ নেয় বোন কখন কলেজ গেল, কখন এল। মা-বাবা ওষুধ খেলেন কিনা। কয়েক ঘন্টা দূরে বিবাহিত বোনেরও খবর নেয় দিনে অসংখ্যবার। আর দিন শেষে যখন সবাই ঘুমে তখন রাত জেগে অপেক্ষা করে, ৫ ঘন্টা পিছনে অন্য এক মহাদেশে থাকা মনের মানুষটির। পরিবারে নানা ঝামেলা এড়িয়ে যদি একবার আসে অনলাইন! মাঝে মাঝে এই অপেক্ষা ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটায়, সব সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়ায়, ভুলে থাকার বদলে।
ফলাফল অকারন ঝগড়া। সময় গড়ায়, মনের গতি বদলায়। স্বপ্ন সত্যির আশায় শুরু হয় দুঃস্বপ্নে ঘেরা আরো একটা দিনের। হিসেবের খাতা থেকে কমে যায় আরো একটা দিন।
নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা :
ক্লাশ টেনে বাবাকে হারায় নাঈম।
২ বোনের এক ভাই, মা-বাবার ২য় সন্তান। তবে বাবা মারা যাওয়ায় হঠাৎ করেই দায়িত্বজ্ঞান চলে এল । বড় বোন থেকে ৫-৬ বছরের ছোট হয়েও, বড় ভাইয়ের মত ভাবতে হয় ওকে। আমেরিকার ডিভি ভিসা পেয়ে আসে ৭ বছর আগে। চাচার বাসায় উঠে।
বেসমেন্টের একটা রুম ভাড়া নেয়। ক্লাশ, কাজ, ছুটির দিনে প্রিয় শখ ক্রিকেট খেলা র মাঝে মাঝে চাচার বাসায় আমন্ত্রিত আত্মীয়দের সাথে কিছু সন্ধ্যা। মা-বোনকে ২-৩ পর পর ফোন করা। সিলেট শহরে বেড়ে ওঠা, বিয়ানীবাজারের নাঈমের অসুবিধা হয়নি নিউ ইয়র্ক শহর ভর্তি নিজ এলাকার লোকদের সাথে খাপ খাওয়াতে। চোখে পড়ার মত তেমন কোন অসুবিধা হয়নি কখনো, তবে মা'র মত ভালোবাসা বা স্বাধীনতা দিতে পারেন নি চাচী।
কিছুদিন হল বাসা বদলেছে, স্বাবলম্বী হবার বাহানায়। ক্লাশ কাজ শেষে নিজে রেঁধে খেতে হয় প্রতিদিন, যদিও রয়ে গেছে মা'র হাতের রান্না কিংবা একমাত্র ছোট্ট বোনটাকে আহ্লাদ করার সুযোগের অভাব তবু নাঈমের ভালো লাগে এই স্বাধীন জীবন।
অনেক সময়ই অভিযোগ করি আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে। পায়ে জুতো নেই বলে চেঁচামেচি করি, ভুলে যাই তাদের কথা যাদের পা-ই নেই। মা বাবার সাথে সবসময় থেকেও ভাবি অনেক অসুখি আছি।
আসলে কত সুখে আছি তা তখনই জানা যায়, যখন এই সুখের ছায়া জীবন থেকে সরে যায়। যেভাবে আছি, সুখেই আছি, ভালো আছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।