আমি যুদ্বে পরাজিত এক ব্যর্থ সৈনিক
কয়েক বছর আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকের স্লোগান ছিলো, ‘ফেসবুক কানেক্টস ইউ উইথ দি পিপল অ্যারাউন্ড ইউ’, বাংলায় বলা যায়, আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দেয় ফেসবুক। আর বর্তমানে এ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জায়ান্ট-এর সাইনআপ স্লেগান হলো, ইটস ফ্রি, অ্যান্ড অলওয়েজ উইল বি’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, এটা ফ্রি এবং সবসময়ই তাই থাকবে।
বিশ্বের ৫০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারীর যোগাযোগ রক্ষার সাইট ফেসবুক আদতে দুটি শ্লোগানকেই ভুল প্রমাণিত করলো মিশরে। প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের সরকারের আশপাশে যারা নির্যাতিত ছিলেন, ফেসবুকের সাহায্য নিয়ে সেই কায়রোর যুবক-তরুণরা যোগাযোগ করেছেন, একত্রিত হয়েছেন এবং ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন হোসনি মোবারক।
দে মাইর
হোসনি মোবারকের দিক থেকে ফেসবুক একেবারেই ফ্রি ছিলো না। ফেসবুকের একটি গ্রুপের কারণেই সম্ভবত তাকে জীবনের সবচেয়ে বড় মূল্যটি পরিশোধ করতে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে ৩০ বছরের ক্ষমতা। অপরদিকে মিশরের গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য ফেসবুক হয়ে উঠেছে বদ্ধ পরিবেশে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ ও মুক্তির হাতিয়ার। এটি আর যাই হোক, কোনো বিচারেই ‘ফ্রি’ নয়।
কী করে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন? কীভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জায়ান্ট ফেসবুক হয়ে উঠলো বিপ্লবের প্ল্যাটফর্ম? সে উত্তরটিই আমরা খোঁজার চেষ্টা করবো এই ফিচারে।
আগের ঘটনা
অপঘাতে মৃত্যুবরণ করা এক অভাগা যুবকের নাম খালিদ মোহামেদ সায়ীদ। ২৮ বছর বয়সী এ যুবকের ‘অপরাধ’ তিনি ছোট্ট একটি ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল মিশরের দুজন পুলিশ সদস্য মাদক সেবন করছেন। এর ফলে গুপ্ত বাহিনীর রাঙা চোখ গিয়ে পড়ে সায়ীদের ওপর।
তারা সায়ীদকে প্রকাশ্যে একটি সাইবার ক্যাফের সামনে পিটিয়ে হত্যা করে। দিনটি ছিলো ৬ জুন ২০১০।
সায়ীদের হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে দিনের বেলায়। অনেক লোক এই ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী। অথচ এই ঘটনার কোনো প্রতিবাদ হয়নি, বা কেউ প্রতিবার করার সাহস পাননি।
মিশরে প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী মত প্রকাশের প্রাথমিক শাস্তি ছিলো পুলিশের হাতে বেধড়ক পিটুনি, এরপর মামলা এবং তারও পর বেয়াদব নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ শাস্তি ছিলো স্রেফ ‘নেই’ হয়ে যাওয়া। সরকারি বাহিনীর হাতে গুপ্তহত্যা অহরহ ঘটেছে মিশরে।
কীভাবে হলো
হতভাগ্য তরুণ খালিদ সায়ীদের নাম নিয়ে অজানা এক ব্যক্তি একটি মেমরিয়াল পেজ খুলেছিলেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন এক মিশরীয় তরুণ হিসেবেই, যিনি পরিবর্তনের পক্ষে। ‘উই আর অল খালিদ সায়ীদ’ নামের ওই ফেসবুক পেজে স্মরণ করা হয়েছিলো খালিদ সায়ীদকে।
জানানো হয়েছিল কী চলছে মিশরে। এরপর ওই পেজ এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া খালিদ সায়ীদের দুটি ছবিকে আশ্রয় করে জমে উঠতে থাকে ক্রোধ, উঠতে থাকে ন্যায্য কিছু প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি রিপোর্টে বলে, ‘ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া সায়ীদের বিকৃত লাশের ছবি দেখে বোঝা যায় তার মাথার খুলি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, ভাঙ্গা হয়েছে চোয়ারের হাড় এবং উপর্যুপরি শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তার ওপর। ’
ফেসবুকের এই পেজটি থেকে নিয়মিত বিভিন্ন কনটেন্ট, বিতর্ক এবং নতুন আপডেট প্রকাশ হতে থাকে। সায়ীদ হত্যা কেসের বিভিন্ন আপডেটও সেখানে প্রকাশিত হয়।
ফেসবুকের পাতা থেকেই এই নীরবে আন্দোলন চলছিলো। তারা একসময় কালো পোশাক পরে রাস্তায় নামেন। ফেসবুকের এই ব্যবহারকারীরা নীরব আন্দোলন শুরু করেন। হাতে হাত ধরে তারা সায়ীদের প্রতি সমর্থন জানান। আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে জমা হয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।
দাবি ওঠে ২৯ বছর ধরে চলা জরুরী আইন তুলে নেবার। নীরব আন্দোলনের এই পন্থাটি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়।
ফেসবুকের এই ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে সায়ীদ হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করা হলে গ্রেপ্তার করা হয় বিক্ষোভকারীদের। এতে বিক্ষোভ আরো দানা বেঁধে ওঠে।
এরপর মিশরের মোবারক সরকারের নজর গিয়ে পড়ে ‘যতো নষ্টের গোড়া’ ইন্টারনেট মিডিয়ার ওপর।
ব্লক করে দেয়া হয়েছিলো মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার। এরপর ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ২৭ জানুয়ারি গ্রিনউইচ মান সময় রাত ১১টায় পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাই বন্ধ করে দেয়া হয় ৮ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে। হোসনি মোবারক সম্ভবত জানতেন না, ঠিক ওই দিনটিই ছিলো খালিদ সায়ীদের জন্মদিন। সে দিনটিতেই তিনি ক্ষমতার কফিনে পেরেক ঠুকতে শুরু করলেন।
এরপর, কেবল ইন্টারনেট ব্যবস্থাই নয় মোবাইল ফোন সেবা পেতেও জনগণকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
আর এইসব চাপের মুখে ক্রমশ দলবদ্ধ, জোটবদ্ধ হয়েছে দেশটির কিশোর-তরুণ-যুবক শ্রেণী। জনগণ ও আন্তার্জাতিক চাপের মুখে সরকার ইন্টারনেট খুলে দিলেও আন্দোলন তখন গতি পেয়েছে।
আর এর পরপরই আন্দেলন তার স্থান বদলে ফেলে। প্রকাশ্য প্রতিবাদের পথ না থাকায় যে আন্দোলন ছিলো মোবাইলের বাটন আর কম্পিউটারের কিবোর্ডনির্ভর, সেটি নেমে আসে রাজপথে, তাহরির স্কোয়ারে।
আন্দোলন রাজপথে চললেও খালিদ সায়ীদের পেজটি তার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছিলো ফেসবুকে।
সেখানে সদস্য সংখ্যা তখন ২লাখ ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ পেজটির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ফলোয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। আর খালিদ সায়ীদের পরিণতি এড়াতে পেজে নিজের বিষয়ে আর কোনো তথ্যই রাখেননি। ফেসবুকে পেজে তার পরিচিতি ছিলো অ্যাডমিন হিসেবেই।
সংবাদমাধ্যমে পেজ অ্যাডমিন জানিয়েছেন, তার পরিচয় মিশরের বাইরের কয়েকজন ছাড়া আর কেউই জানেন না।
তার কথায়, ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তবে বিদেশে আমার কয়েকজন বন্ধুকে পাসওয়ার্ড জানানো আছে। ফলে, আমাকে মেরে ফেললেও ফেসবুকের এই বিপ্লব চলতেই থাকবে। ’
এই অজানা তরুণের খোলা ফেসবুক পেজটির নাম ‘উই আর অল খালিদ সায়ীদ’। নিজের সম্পর্কে তিনি যে গুটিকয়েক তথ্য জানিয়েছেন তার একটি হলো, এই পেজটির কাজ নিয়মিত সামলে তিনি দিনে মাত্রই ৩ ঘন্টা ঘুমানোর সুযোগ পেতেন।
এর পর কী?
আজ থেকে এক বছর আগে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতেন না, ফেসবুকের সামান্য একটি পেজ থেকে সরকার উৎখাত করার মতো সফল আন্দোলন চালানো সম্ভব।
কিন্তু এটি যে সম্ভব তা গোটা বিশ্বের কাছে আজ পরিষ্কার। এটাও পরিষ্কার যে, জনগণকে সফল নেতৃত্ব দিতে হলে সবসময় ক্যারিশমাটিক নেতা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু নতুন করে যে প্রশ্নটি এগিয়ে এসেছে, তা হলো, ফেসবুক বা প্রযুক্তিনির্ভর সোশ্যাল গ্রুপগুলোর আর কোন কোন ক্ষমতা এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। যে ক্ষমতা এখনো আমরা দেখিনি, হয়তো বিশাল কোনো ঘটনা আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে আরেকটি নাড়া দেবে।
পালা,পালা জলদি পালা
সূএ : বিডি নিউজ ২৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।