ভালবাসি দেশকে এবং দেশের মানুষকে।
শেয়ার বাজারের অস্বাভাবিক এবং ভয়ানক দরপতনের মাধ্যমে একটিৃসংঘবদ্ধ চক্র বাজার থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই একটি নীলনকশার মাধ্যমে গতিশীল শেয়ারবাজারে মহাপতন ঘটানো হয় বলে দাবি করে বলা হয়-নীলনকশা বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী মহল থেকে শুরু করে বাজারের ব্রোকারেজ ফার্ম পর্যন্ত জড়িত ছিল। এমনকি যোগসাজশ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের দৈনিক ইত্তেফাক ২৯ জানুয়ারি।
ইতোমধ্যে সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী শেয়ার বাজারে নজীরবিহীন পতনের জন্যে ‘কিছু ভুল’ ছিল বলেও স্বীকার করেছেন।
এস ইসির প্রধান নির্বাহীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কারণ অনুসন্ধানে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ততদিনে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছে হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা এ দরপতনের ধাক্কায় যে কোথায় গিয়ে ঠেকছে তা আমরা তাদের সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় উপলব্ধি করি। যদিও মানুষের গাড়ি ও সম্পদে হামলাকে সমর্থন করা যায়না তথাপি নিজেদের স্বপ্ন চুরমার হতে দেখে হতবিহবল বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভের অগ্নিশিখাকে অসম্মান করি কিভাবে?
তদন্ত কমিটি হয়তো টার্ম অব রেফারেন্স অনুযায়ী রিপোর্ট প্রদান করবেন যেভাবে ১৯৯৬ সালেও করেছিলেন।
কিন্তু সে রিপোর্ট কি আদৌ আলোর মুখ দেখবে?
তদন্তে যদি খুব ক্ষমতাধর কারো নাম চলে আসে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে কিনা দেখার বিষয়। এ বিষয়ে অতীতের রেকর্ড যে সুখকর নয়, তাই আমরা খুব বেশি আশাবাদী হতে পারিনা। কিন্তু এতবড় কারসাজি আর যোগসাজশের মাধ্যমে যে বা যারাই দেশের সীমাহীন ক্ষতি ডেকে আনলো তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতা আইনে বিচার হওয়া উচিত। ঐসব অপশক্তি কুলাঙ্গারদের মুখোশ উন্মোচন হওয়া চাই। শেয়ার বাজারের অভিশপ্ত ধস যেতে না যেতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এমএলএম কোম্পানিগুলো বিশেষত ইউনিপেটু, ভিসারেব ও স্পিক এশিয়ায় বিনিয়োগকারী লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষে তথা যুব সমাজের হা-হুতাশ, টেনশান।
কারণ শেয়ার বাজারের অস্বাভাবিক দরপতনের অন্যতম একটি কারণ হিসাবে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী দায়ী করেন এম এল এম কোম্পানিগুলোর উত্থানকে। তদন্ত প্রতিবেদন বের হলে এ বিষয়টির বাস্তবতা উপলব্ধি করা যাবে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেয়া যায় যে, শেয়ার বাজারের মহাপতনের পেছনে এমএলএম কোম্পানি জড়িত। তবে প্রশ্ন থেকে যায় দীর্ঘ ১৮ মাসের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে ইউনিপেটু ইউসহ কয়েকটি কোম্পানি প্রকাশ্যে ব্যবসা করলো শেয়ার বাজারেও কিছু হলোনা। সরকারি কোন সংস্থা বা দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ উঠলোনা।
যেই শেয়ার বাজারে ধস নামলো অমনি এমএলএম কোম্পানির ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা। ততদিনে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। একটি জাতীয়, দৈনিকের রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ইউনিপেটুর সাধারণ ট্রেডার্সের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং ব্যাংকস্থিতি প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। সারাদেশের বেকার তরুণ, ছাত্র, নারী নির্বিশেষে দলে দলে ইউনিপেটুতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় নানা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে। প্রায় সকলেই নিয়মিত ‘ফিরতি কিস্তি’ আকারে দ্বিগুণ লাভ পেয়ে আরো দুর্বার আগ্রহে বিনোয়োগের পরিমাণ বাড়িয়েছে, সম্পৃক্ত করেছে আত্মীয় স্বজনকে।
আমি এমন দু’জন যুবককে চিনি যারা ১০/১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে পুরো দমে এমএলএম ব্যবসায়ী/এজেন্ট বনে গেছে। তরুণ যুবকদের হাতে হাতে ল্যাপটপ। প্রত্যেকে কোন না কোন পর্যায়ে এমএলএম ব্যবসার সাথে জড়িত।
হঠাৎ করে সরকারি তৎপরতা এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের কাছে চিঠি দিয়ে ইউনিপেরসঙ্গের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সব হিসাব সাময়িকভাবে ৩০ দিনের জন্য লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে।
সরকারি তথ্য বিবরণীর মাধ্যমে ইউনিপের থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সরকারের চতুর্মুখী তৎপরতা নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সচেতন মহলের প্রশ্ন এ তৎপরতা ১৮ মাস পরে কেন?
প্রকাশ্যে ওয়েব সাইট ও ঢাকার মোতালেব প্লাজায় অফিস খুলে সরকারের চোখের সামনে দিব্যি ব্যবসা করলো কোন বাধা নিষেধ আসলোনা। ১৮ মাস লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ কিংবা ঋণের টাকা বিনিয়োগ করার পর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার হস্তক্ষেপ তথাকথিত এমএলএম ব্যবসার হোতাদের চাইতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পেটেই যেন লাথি মারার শামিল হয়ে দাঁড়াবে কিনা ভেবে দেখা দরকার। সরকারি বিধি নিষেধের দোহাই দিয়ে ইতোমধ্যেই ইউনিপে’র গ্রাহকদের ‘ফিরতি কিস্তি’ দেয়া বন্ধ রয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।
চার লক্ষাধিক বিনিয়োগকারী এখন অজানা শংকায় দিনাতিপাত করছে। কেননা কোম্পানিগুলো নিষিদ্ধ করা হলে কোটি টাকার বিনিয়োগের কি হবে? এক্ষেত্রে তথাকথিত এম এল এম কোম্পানির মালিকরাই লাভবান হবে অন্যদিকে সর্বস্ব হারিয়ে দেউলিয়া হবে এদেশের লাখো তরুণ যুবক। যেভাবে শেয়ার বাজারের মহাপতনের ফলেও পথে বসেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাদের সিংহভাগ তরুণ। তাই “ধর ধর চোর ধর, প্রতারক ধর” বলে সস্তা জিগির না তুলে সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমএলএম কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে। আমাদের দেশের বেকারত্বের হার অধিক বলে যে কোন ধরনের লোভনীয় অফার আসলে তরুণ যুবকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এম এল এম কোম্পানি ইউনিপের চটকদার অফারে আকৃষ্ট হয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক-তরুণ এ পথে বিনিয়োগ করেছে এজন্য তাদের দায়ী করা যাবে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারি কোন সংস্থার পক্ষ থেকে এ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে কখনো সতর্ক করা হয়নি। বরং কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল-সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ব্যবসার সাথে জড়িত। যা বিনিয়োগকারীদের কারো কারো জন্য আস্থা ও উৎসাহের ব্যাপার হয়। সরকারের কেউ সংশ্লিষ্ট থাকুক আর না থাকুক নাগরিকদের বিনিয়োগ নিরাপদ করা সরকারের কর্তব্য।
আশার কথা যে ইতোমধ্যে এমএলএম সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১ এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ২২টি বিধিমালা সম্বলিত এ নীতিমালা অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শীঘ্রই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে সকল আশংকা ও হতাশার অবসান ঘটতে পারে। ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার জন্য সরকারি নীতিমালা ও গাইড লাইন রয়েছে এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে একদশক পেরুলেও এ ব্যবসার কোন নীতিমালা না থাকায় কোম্পানিগুলো ইচ্ছে মতো ব্যবসা করে কখনো কখনো প্রতারিত করছে সহজ সরল বিনিয়োগকারীদের। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যুবক নামের কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসেছিল এদেশের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী।
সরকারি হস্তক্ষেপে যুবক তাদের তথাকথিত ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হলেও অসংখ্য বিনিয়োগকারী তাদের আমানত ফিরে পায়নি। ফলে ‘যুবক’ এর চাইতেও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা। ইউনিপেটুর ক্ষেত্রেও যাতে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের প্রতিশ্রুত টাকা, ন্যূনপক্ষে মূলধন ফেরত পায় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুত অর্থ কিংবা মূলধন ফেরত না দিয়ে কোন এমএলএম/প্রতারকচক্র ও হোতা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে এবং অর্থ পাচার করতে না পারে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
এমন অসংখ্য বিনিয়োগকারী আছে যারা শেয়ার বাজার ও ইউনিপেটু দু’খাতেই বিনিয়োগ করেছেন। একদিকে শেয়ার বাজারের ক্ষতি অন্যদিকে যদি ইউনিপেটুর মূলধনও হারাতে হয় তবে বাংলাদেশের কোন কোন তরুণও যদি তিউনিসিয়ার সেই গ্র্যাজুয়েট মোহাম্মদ বেন-আজিজির মতো গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মাহুতির মতো পথ বেছে নেয় অথবা ভয়াবহ মাদক ও নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে, আমাদের কিছুই করার থাকবে না।
তিউনিসিয়ার সেই যুবক সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করে চাকরি না পেয়ে রাস্তার ধারে সবজি বিক্রি করতে বসেছিল। পুলিশ তাকে ফুটপাতে সবজি বিক্রি করতে বাধা দিলো লাইসেন্স না থাকার অজুহাতে ক্ষোভে অপমানে অনন্যোপায় হয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মাহুতি দিল। তার পেট্রোলের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়লো গোটা তিউনিসিয়ায়।
এমনকি প্রেসিডেন্টের প্রাসাদও পুড়ে চারখার হলো।
আমাদের সকলের বিনিয়োগ নিরাপদ হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।