আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Unit 731: জাপানের অন্ধকার দিক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
জাপান আমাদের কাছে সুন্দর দেশ, উন্নত দেশ, চেরিফুলের দেশ, ফুজি পাহাড়ের দেশ; জাপান আমাদের স্বপ্নের ডিভাইস ও বাহন তৈরি করে- ডিজিটাল ক্যানন কি সনি ভায়ো কি টয়োটা প্রিয়াস। আমরা জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ, আমরা জাপানের তিন লাইনের হাইকু কবিতার প্রশংসা করি এবং বলি যে এই সেই দেশ যেখানে একদা উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে জেন বুদ্ধ ধর্মের । অথচ জাপানের রয়েছে এক অন্ধকার দিক।

জাপান ১৯৩৫ সালে চিন আক্রমন করে জাপান লক্ষ লক্ষ চিনা নাগরিককে হত্যা করেছে ... যা ‘এশিয়ান হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই বিভৎস হত্যাকান্ড সংঘঠিত করেছিল জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী-এটি আর্মি অভ দ্য এম্পায়ার অভ গ্রেটার জাপান নামেও পরিচিত ছিল। এটি জাপানের স্থলবাহিনী এবং বাহিনীটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এবং এর অবসান ঘটেছিল ১৯৪৫ সালে। গোটা কুড়ি শতক ধরে পূর্ব চিনের এই অঞ্চলটি অস্থির ছিল আজ হয়তো চিনকে আক্রমন করা সাহস পাবে না জাপান । কিন্তু উনিশ শতকের শেষার্ধে চিত্রটি ছিল ভিন্ন ।

সে সময় চিনে কিঙ রাজবংশ (১৬৪৪-১৯১২) শাসন চলছিল। চিন ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধকে সাইনো-জাপান যুদ্ধ বলা হয়। প্রথম সাইনো-জাপান যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৮৯৪/৯৫ সালে। চিনের দূর্বল আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং চিনা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানের ফলে চিনা সমাজে অর্ন্তদ্বন্দ সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৪/৯৫ সালের যুদ্ধে জাপানের কাছে কিঙ রাজবংশ পরাজিত হয় এবং জাপানের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় চিন ।

এভাবে চিনে রাজবংশ ক্ষয়ে যাচ্ছিল আর জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব তীব্র হয়ে উঠছিল। ফলে প্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছিল। জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর বিশেষ বিভাগ রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। পরবর্তীকালে যার ফল ভয়াবহ হয়েছিল। মানচিত্র ।

জাপান ও চিনের অবস্থান। কুড়ি শতকের প্রথম থেকেই জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। সে কাঁচামাল আরোহন ও পন্য রপ্তানীর জন্য উপনিবেশ খুঁজতে থাকে। তার শ্যেনদৃষ্টি পড়ে চিনের ভূখন্ডসংলগ্ন মাঞ্চুরিয়ায়, যার অবস্থান ছিল চিনের উত্তর-পুবে। অঞ্চলটি ছিল কাঁচা মালের অপরিমেয় উৎস এবং সেখানে জাপানি পন্যের বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল।

১৯৩১ সাল। জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী মাঞ্চুরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানে একটি পুতুল সরকার গঠন করে। মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি দখলদারিত্ব ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। মাঞ্চুরিয়া। সাইনো-জাপান যুদ্ধ দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে ।

জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী চিনে অনুপ্রবেশ করে। চিনের ন্যাশনাল রেভুলুশনারি আর্মি জাপানি আগ্রাসন রুখে দাঁড়ায়। এটি ছিল চিনা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল কওমিংটাং এর সামরিক উইং। জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী শাংহাইতে প্রবল প্রতিরোধের সম্মূখীন হয়। এখানে জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বিষয়ে জাতিপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ! শাংহাই যুদ্ধে গ্যাস মাস্ক পরা জাপানি সৈন্য নানকিং ছিল তৎকালীন জাতীয়তাবাদী চিনা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী।

জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ করে নানকিং শহরে প্রবেশ করে এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক জঘন্যতম গতহত্যায় লিপ্ত হয়। যে গনহত্যায় কমপক্ষে ৩ লক্ষ বেসামরিক চিনা নিহত হয়, ধর্ষিত হয় প্রায় ৮০ হাজার নারী । এই দুঃখজনক ঘটনাটি চিনের ইতিহাসে ‘রেইপ অভ নানকিং’ নামে পরিচিত। নানকিং এই ছবিতে নানকিং যুদ্ধের বিভৎসতা ফুটে উঠেছে চিনে জাপানি আগ্রাসনের আরও একটি ভয়ঙ্কর অধ্যায় ছিল। তাহল চিনা নাগরিকদের ওপর মেডিকেল এক্সপেরিম্যান্ট করা।

জাপান রাসায়নিক এবং জীবাণু অস্ত্র নির্মানের জন্য গোপন পরিকল্পনা নিয়েছিল । গবেষনা কেন্দ্রটি Unit 731 নামে পরিচিত। যেখানে বন্দিদের শরীরে প্লেগ কি কলেরার জীবাণু ইঞ্জেক্ট করা হত । এবং মানবদেহে সেসব প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য জীবন্ত মানুষের ওপর কাঁটাছেঁড়া করা হত। এই হল জাপানের অন্ধকার দিক।

এবং বিষয়টি আজও অনালোচিত। কেবল ২য় মহাযুদ্ধে জার্মান নাজীদের বিভৎসতার কথা প্রচার করা হয় । কিন্তু জাপান নাজীদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল না। তারা চিনা জনগনের ওপর নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছিল। যে কারণে জাপানের ওপর চিনাদের ক্ষোভ আজও যায়নি।

আজও প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে চিন। যা হোক। জাপান একক ভাবেই Unit 731 পরিচালনা করেছিল । স্থানীয় চিনা ‘সাহায্যকারী’ ছিল না। মাঞ্চুরিয়ায় হারবিন শহরের মানচিত্র।

১৯৩৫ সালে চিনের উত্তর-পুবে হারবিন শহরের উপকন্ঠে Unit 731 প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল । ১৯৪৫ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত ছিল। মনে থাকার কথা- ১৯৩১ সাল। জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনী মাঞ্চুরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানে একটি পুতুল সরকার গঠন করে। ইনি জেনারেল শিরো ইশহি (১৮৯২/১৯৫৯।

তৎকালীন জাপানের শীর্ষ মাইক্রোবায়োলজিস্ট। একে জীবাণু অস্ত্রের জনক বলে গন্য করা হয়। তবে ইনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। শিরো ইশহি ১৯৩২ সালে Army Epidemic Prevention Research Laboratory- এর প্রধান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে, অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে মাঞ্চুরিয়ায় গোপনে Unit 731 গঠন করে রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের গবেষনা আরম্ভ করেন।

এই উদ্দেশ্যে চিনা বন্দি করে নিয়ে আসা হত। বন্দিদের বলা হত ‘লগ’ বা কাঠ। কিছুদিন পর পর ৫০০ সিসি করে রক্ত নেওয়া হত বন্দিদের শরীর থেকে ...রক্তশূন্য বন্দিদের ফ্যাকাশে দেখালে বিষাক্ত তরল ইঞ্জেক্ট করে মেরে ফেলা হত ...পরে কাঁটাছেঁড়া করা হত, তারপর মৃতদেহ পরে পুড়িয়ে ফেলা হত। শিরো ইশহির গবেষনার বিষয় ছিল এনথ্রাক্স, গ্ল্যান্ডারস এবং প্লেগ এবং মানবদেহে এদের প্রতিক্রিয়া। প্লেগাক্রান্ত ইঁদুরের শরীর থেকে ব্যাক্টেরিয়াম নিয়ে বন্দিদের শরীরে ইনজেক্ট করা হত।

এর ১০ থেকে ১২ দিন পর বন্দিরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস জ্বরে ভুগত...তবে বন্দিরা বেশি বাঁচত না। জীবিত অবস্থায় তাদের কাঁটাছেঁড়া করা হত। কখনও বন্দিদের শরীরে বিশাক্ত Phosgene gas ঢোকানো হত এবং প্রতিক্রিয়া দেখা হত; কখনও ঢোকানো হত ১৫ মিলিগ্রাম পটেশিয়াম সায়ানাইড। কোনও কোনও বন্দিকে ২০,০০০ভোল্টে ইলেট্রিসিটিতে পোড়ানো হত ... হতভাগ্য পুড়ে ছাই হয়ে যেত। পরীক্ষার ফলাফল লিখে রাখা হত।

ইউনিট ৭৩১ সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন । ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে Unit 731 এ মৃতের সংখ্যা ৫৮০,০০০! Unit 731 এর একটি উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র আক্রমন করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি জাপানের এই গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানত? এরই পরিনাম কি জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকি শহরে মার্কিন পরমাণু অস্ত্রের হামলা? হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুডলফ জোসেফ রুমেল বিংশ শতকের গনহত্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করেছেন। তিনিই প্রথম democide শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। শব্দটি অর্থ হল murder by government ... রুডলফ জোসেফ রুমেল -এর মতে চিনের ওপর জাপানি আগ্রাসন হল ডেমোসাইড।

তাঁর মতে ইতিহাসে যত গনহত্যা হয়েছে তার ৬ গুণ বেশি গনহত্যা সংঘটিত হয়েছে কেবলমাত্র বিংশ শতকে। তাঁর মতে এশিয়ায় জাপানি আগ্রাসনের ফলে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ৩,০০০,০০০ থেকে ১০,০০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে জাপান অবশ্য তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। তথ্যসূত্র: Click This Link Click This Link http://www.japan-guide.com/e/e2129.html Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।