এলোমেলো ভাবনা ভাবায় আমায় সব সময়।
অনেক দিন পর আজ কবিতা আবৃত্তি করতে যাচ্ছে নিরু, অনেকদিনের অনভ্যাসে একটু জড়তা আর সংকোচ- শ্যামাটাকে একবার শোনাতে পারলে হতো; কিন্তু মহারাণীর তো এখন আর ওর জন্যে সময় নেই, সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে আর আপনমনেই কবিতাটা আউড়ে যাচ্ছে। ডিপার্টমেন্টের সামনের খোলা জায়গাটাতেই এবার ওরা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানটা আয়োজন করেছে। সামনের রাস্তায় আলপনা, নানান রঙ্গে সাজানো স্টেজ, মাইক্রোফোন টেস্টিং, তবলার টুং টাং, সবুজ গাছ, খোলা আকাশ- সবকিছুর সাথে মিশে গিয়ে ও মনে মনে আবৃত্তি করে যাচ্ছে-
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
পোষাক- আশাক আর সাজ-সজ্জার প্রতি উদাসীন ছোট-খাট দেখতে নিরু আজ শাড়ী পরেছে, বড় বড় চোখে কাজল দিলেও ঢাকা পড়েছে তা ভারী চশমার আড়ালে, ছোট ছোট করে কাটা এলোমেলো চুলে ফুল জড়ানো হয় নি শুধু গোল মুখে লাল গোল টিপটি সব শূণ্যতা পূরণ করে দিয়েছে। বরাবরই জিন্স আর ফতোয়ায় দেখা ওকে আজ সবাই যেন একটু ভিন্ন চোখে দেখছে- সেই পাগলাটে হৈ-হুল্লোড় করা মেয়েটার আজ যেন অন্য চেহারা।
হঠাৎ করেই পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল শ্যামা, অবশেষে মহারাণী এলেন সাথে ওর চাশমিশ বন্ধুটি যার জন্যে ইদানীং আর নিরুর কথা মনে থাকে না ওর আর লম্বা ঢ্যাঙ্গা গীটার কাঁধে এক ছেলে। 'বাহ! ফুলন দেবীর আজ দেখি অন্য চেহারা! কিন্তু শাড়ীতে তো তোকে খুবই কিউট লাগছে রে!'- নিরু চুপ; শ্যামা পরিচয় করিয়ে দিল আদনানের সাথে- জিন্স-টিশার্ট পরা দাঁড়ি-গোঁফ না কামানো জঙ্গল মুখের ছেলেটা যেন এটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিল- 'এই তোমার বন্ধু? বিশিষ্ট শিল্পী এবং আবৃত্তিকার? এ তো দেখি পিচ্চি একটা মেয়ে!' ছোটখাট দেখতে নিরুকে অনেকে পিচ্চি বললেও এরকম অপরিচিত একটা ছেলে দুম করে প্রথম পরিচয়েই ওকে পিচ্চি বলায় ও খুব ক্ষেপে গেল; দাঁত কিড়মিড় করে বলল- 'আমি পিচ্চি না!' অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আদনান- 'তাই? তা, ছোট্ট মেয়ে, কী কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছে?' অনেক কষ্টে রাগ চেপে বলল- 'শুধু তোমার জন্যে' 'ও, নির্মলেন্দু গুণ?' বলেই ভরাট গলায় আবৃত্তি শুরু করে দিল-
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য।
শুধু তোমার জন্য
শেষ লাইনটা বলার সময় অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়েছিল আদনান। নিরু তখন মুগ্ধ, রাগ ভুলে গেছে; আর সেই সময় ছেলেটি ফস করে বলে উঠল- ' কিন্তু ছোট্ট মেয়ে, এটা তো ছেলেদের কবিতা, তুমি আবৃত্তি করবে কেন?' 'কবিতার আবার ছেলে-মেয়ে কি?' বলে রেগে উঠে স্টেজের দিকে চলে গিয়েছিল নিরু।
সে-ই প্রথম দেখা, নানান ব্যস্ততায় ভুলেই গিয়েছিল তাকে নিরু। কয়েক মাস পরে হুট করেই কোন এক ঝামেলায় একদিন ক্লাস স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ভার্সিটির বাসেই ফিরছিল; কার্জন হলের কাছ থেকে উঠল আদনান, সেই লম্বা চুল আর মুখ-ভর্তি দাঁড়ির জঙ্গল। ওর পাশে ধুপ করে বসে বলে উঠল-
- তারপর ছোট্ট মেয়ে, ওই দিন তোমার আবৃত্তি আর গান কিন্তু খুব ভালো হয়েছিল।
- থ্যাঙ্কস! কিন্তু আমি ছোট নই!
আবারো সেই হাসি, আচ্ছা! ছোট্ট মেয়ে শুনলে খুব রাগ হয়? দেন ইউ আর মাই লিটিল এঞ্জেল! নিরু অবাক হয়ে কী বলবে বুঝে উঠার আগেই আদনানের স্বভাব-সুলভ অনর্গল কথা শুরু হয়ে যায়, কিছুক্ষণের মাঝেই সহজ হয়ে ওঠে নিরু।
- আমার এই রকম শহুরে যান্ত্রিক জীবন একটুও ভালো লাগে না, নিরু।
- ভালো না লাগলেই বা কী করার আছে!
- একদিন আমি দূরে কোথাও চলে যাবো, আবারো ঘর ছাড়ব!
অনেক প্রশ্ন নিয়ে অবাক চোখে নিরু তাকাতেই - আই হ্যাভ টু গো নাউ, মাই সুইট লিটিল এঞ্জেল! উউপ্স, ইংরেজী বোঝ না? আচ্ছা বাংলায় বলি- মিষ্টি ছোট্ট পরী, আজ এ পর্যন্তই, আবার দেখা হবে! বলেই আদনান নেমে পড়ল বাস থেকে।
****
নিরুকে আদনান সেদিন যেন এক মহাসমুদ্রের মাঝে ফেলে চলে গেল। মাঝে একদিন শ্যামার সাথে দেখা, আদনানকে নিয়ে ওর মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও কী যেন এক সংকোচে জিজ্ঞেস করতে পারছিল না।
শ্যামাই বলল
- আদনান তোর কথা জানতে চাইছিল, তোর মোবাইল নম্বর চাইল।
- কী বললি তুই?
- ছেলেটা ক্ষ্যাপাটে অনেক, সুন্দর গান গায় কিন্তু কী যে বোহেমিয়ান ভূত চাপে ওর মাথায়! জানিস তুই? ও কিন্তু আমাদের সিনিয়ার ছিল, গৌতম বুদ্ধের মতো হিমালয় না কি ডাক দিয়েছিল তাকে, সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল নেপাল, বদ্ধ পাগল একটা। আন্টি আর আঙ্কেলের তখন যে কী অবস্থা! ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কী না করেছেন ওরা!
আদনানের সেদিনের কথার মানে বুঝতে পারল যেন নিরু। 'আবার চাইলে নম্বর দিস' বলে চলে এসেছিল সেদিন।
****
নিরুকে আদনান ফোন করেছিল তবে বেশ কিছুদিন পর।
সেদিনের পর থেকে নিরু একা হলেই আদনানের কথা মনে পড়ে ওর, অবাক হয়ে ভাবে- এভাবে কাউকে পরিচয়ের দ্বিতীয় দিনেই 'লিটিল এঞ্জেল' সম্বোধন করতে পারে কেউ! ভার্সিটি থেকে বাসে ফেরার সময় প্রায়ই ভাবত, এই বুঝি গীটার কাঁধে পাগল ছেলেটা উঠে আসবে কার্জন হলের মোড় থেকে, আর ভাবত আদনানের গান তো শোনা হলো না কোন দিন।
সেদিন সন্ধ্যার আকাশটা ওর মন খারাপ বলেই বোধ হয় ভার ভার হয়ে ছিল, যেন ওর চোখের পানিকে আড়াল করার জন্যেই বৃষ্টি ঝরছিল, স্টেরিও তে ওর প্রিয় গান বাজছিল-
আজ তোমার জোছনা হারায় আলো
প্রজাপতির ডানায় বিষাদ করে ভর
যখন তখন,
আমি তোমার জন্য এনে দেবো
অঝোর শ্রাবন,
আকাশছোঁয়া জলজোছনা
পরী,তুমি ভাসবে মেঘের ভাঁজে.....
আদনান ফোন করল, ও রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে
- হাই লিটিল এঞ্জেল! ভুলে যাও নি আশা করি।
নিরুর মনে হলো ওর ভিতরে হৃদয়ের অলিন্দের দ্বারগুলো কাঁপতে শুরু করল এলোপাথাড়ি। ভাবল ভাগ্যিস আদনান সামনে নেই, নইলে ওর ভিতরকার কম্পন ও কিছুতেই লুকোতে পারত না। নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলল নিরু
-ভুলব কেন? কি খবর বলো? এতদিন পর খোঁজ করলে?
কপট রাগের ভান করল নিরু।
- তুমি তো একটা ফোন করতে পারতে শ্যামার কাছ থেকে আমার সেল নম্বর নিয়ে?
আচ্ছা বাদ দাও, পরশু আমাদের ডিপার্টমেন্টে নবীন বরণ, অবশ্যই আসবে তুমি।
- বিশেষ কোন আকর্ষণ?
- হুমম! আমি গান গাইছি, গানটা তোমাকে নিয়ে লেখা। এসো কিন্তু।
নিরুকে স্তব্ধ করে দিয়ে ফোন কেটে দিল আদনান।
****
যথাসময়েই অনুষ্ঠানে গিয়েছিল নিরু, সাদা সালোয়ার কামিজে ওকে খুব জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছিল, শ্যামা তো বলেই উঠল- তোকে তো আজ পরীর মতো লাগছে।
নিরুর স্তব্ধতা এখনো কাটে নি, শ্যামা আর পোলিনের সাথে ও চুপ চাপ বসেছিল অডিয়েন্সের সারিতে। অনুষ্ঠানের কিছুতেই মন দিতে পারছিল না, তারপর এল আদনানের গান। গীটার বাজিয়ে টুংটাং গান ধরল-
ছোট্ট পরী,তোমার ডানায়
প্রজাপতির রংটা মানায়
ছোট্ট পরী,তোমার দুচোখ,
দেয় চিনিয়ে স্বপ্নলোক।
-----------------
নিরুর ভিতরটা ভয়ঙ্করভাবে কাঁপতে শুরু করল, ওর মনে হচ্ছিল শ্যামাদের কাছ থেকে ও কীভাবে লুকিয়ে রাখবে নিজের অনুভূতি!
-----------------
ছোট্ট পরী,বৃষ্টি হলে,
সিক্ত শহর শূদ্ধ জলে,
শূদ্ধতাতে যাও ভিযে যাও,
পঙ্কিলতা বিদায় জানাও।
-----------------
রূপকথারং স্বপ্নডানায়,
ছোট্ট পরী,তোমায় মানায়।
অনুষ্ঠান শেষে ওরা সবাই এক সাথে খেতে যায় ঠাঁটারীবাজার স্টারে। রিকশায় একে একে সবাই ওঠার পর বাকী থাকে কেবল নিরু আর আদনান। আদনানই কথা শুরু করল-
- বি-উটি-ফুল!
নিরুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে প্রশ্ন করল-
- গান কেমন লাগল, ছোট্ট পরী?
আবারো কাঁপন। ছোট্ট করে বলল-
- ভালো।
- শুধু ভালো?
অনেক কষ্টে সামলে আদনানের চোখের দিকে তাকাল নিরু- এসবের মানে কি আদনান?
- মানে কিছু না! গানটা তোমাকে নিয়ে লেখা, তোমাকে ভেবে লেখা! তাই তোমার কাছে কেমন লাগল তা ইম্পোর্টেন্ট আমার কাছে! শুধু ভালো শুনে একটু মন খারাপ হলো।
নিরু ভাবছিল ওর মতো একটা সাধারণ মেয়েকে নিয়ে কেউ কি গান লিখতে পারে!
- নিরু, এসবের কি মানে জানি না! শুধু এটা জানি, তোমাকে নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে! এটাকে যদি ভালোবাসা বলে, দেন আই লাভ ইউ! আমার বোহেমিয়ান জীবনের সঙগী হবে তুমি, লিটিল এঞ্জেল?
নিরু চুপ করে থাকে। শুধু 'লিটিল এঞ্জেল' শোনার জন্যেই হয় তো ও আদনানকে ছাড়তে পারবে না কোনদিন, এমন করে ওকে কেউ তো কখনো ডাকে নি!
*****
গানের লিরিকের জন্যে কৃতজ্ঞতা হাসান মাহবুব কে, তার 'ছোট্ট পরী' থেকে তারই অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহার করেছি।
অদৃশ্য সত্ত্বার বাক্যালাপের লেখা 'নিরু ও সেই পাগল ছেলেটা' র ভাবানুবাদ স্বদেশ হাসনাইনের লেখায় পড়েই আমারো নিজের মতো করে লেখার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হয় নি- প্রথম অংশটুকুতে বড় বেশী হাসনাইন ভাইয়ার লেখার ছায়া আর পরের অংশটুকউ গল্পের মূল ভাব থেকে সরে নিজের রাস্তায় হেঁটেছে। শুধু ওই লেখাটা মাথা থেকে যাচ্ছিল না বলেই নিজের কিছু লিখতে পারছিলাম না- আর তাই তড়িঘড়ি করে মাথা থেকে নামিয়ে ফেলা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।