আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'বামফ্রন্ট সরকার: মানুষই শেষ কথা’ প্রকাশিত হলো



কলকাতা বইমেলায় ‘গণশক্তি’-র নতুন বই বামফ্রন্ট সরকার: মানুষই শেষ কথা (বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে নির্বাচিত প্রবন্ধ ও দলিলের সংকলন) মুখবন্ধঃ বিমান বসু কলকাতা: ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ ভারতের গণ-আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তী জননেতা জ্যোতি বসু বলতেন, ‘‘মানুষ, একমাত্র মানুষই ইতিহাস রচনা করেন। এটা ঠিকই যে মানুষ কখনো কখনো ভুলও করেন। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়ই অবশ্যম্ভাবী। ’’ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার গত ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায়ে নির্বাচিত হয়ে বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমবাংলার সচেতন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, অগ্রণী চেতনার মানুষেরই এই ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব প্রাপ্য।

আর এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি কাজের অভিমুখই গরিব, নিম্নবিত্ত, সাধারণ মানুষের স্বার্থে। পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট ও বামফ্রন্ট সরকারের কাছে মানুষই শেষ কথা। এরাজ্যের মানুষও সেটা জানেন। সেজন্যই মানুষ বারেবারে সমর্থন জানিয়েছেন এই সরকারকে। পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার আগে থেকে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে যে ধারাবাহিক গণ-সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্যাপক জনভিত্তি লাভ করে, সেই গণ-আন্দোলনের ধারা বয়েই এরাজ্যে প্রথমে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং পরে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়।

বহু মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম আত্মত্যা গের মধ্যে দিয়ে এই সরকার গঠিত হয়েছে এবং এতদিন ধরে সরকার পরিচালনা ও এর জনমুখী কর্মসূচী রূপায়ণ করতে গিয়েও অসংখ্য বামফ্রন্টকর্মীকে শহীদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এতগুলি বছর ধরে জনমুখী কর্মসূচী রূপায়ণে এবং জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সামনে তুলে এনেছিল বামফ্রন্ট সরকারই। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং একেবারে নিচুতলায় অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ এবং বিস্তৃতি ঘটানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের সামনে মডেল হিসাবে স্বীকৃত। একথা আজ সকলেরই জানা যে এরাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে অনুকরণ করেই গোটা দেশে তা রূপায়ণের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে।

ভূমি সংস্কার, কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও এই সরকারের সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত। পাশাপাশি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, শান্তি-সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায়ের ক্ষেত্রেও দেশের সামনে এরাজ্য উদাহরণ। গত ৩৪ বছর ধরে সি পি আই (এম)-র নেতৃত্বে এরাজ্যে এতগুলি বামপন্থী দল মানুষের স্বার্থে কর্মসূচী নিয়ে সরকারে একসাথে থেকে কাজ করছে। কিভাবে এটা সম্ভবপর হলো সেটাও একটি গবেষণার বিষয়। পুঁজিবাদী সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্যে কমিউনিস্টরা সরকার গঠন করলে কী করা সম্ভব, কতখানি করা সম্ভব সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা আগে ছিল না।

সরকারে অংশ নিয়ে কাজ করতে করতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নিয়ে পথ চলতে হয়েছে। ১৯৫৭ সালে কেরালায় প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হওয়ার পরই এই প্রশ্ন তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সামনে আসে। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে সি পি আই (এম) যখন গঠিত হলো, তখন পার্টি কর্মসূচীতে এবিষয়ে উল্লেখ করা হয়। ২০০০ সালে পার্টি কর্মসূচী সময়োপযোগী করে তৈরি হয়। তাতে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই সরকারগুলি বিকল্প নীতি তুলে ধরবে ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে।

আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে মানুষের স্বার্থে এই বিকল্প কর্মসূচীর একটা সুনির্দিষ্ট নজির তুলে ধরতে পেরেছে। কেরালা এবং ত্রিপুরাতেও সি পি আই (এম)-র নেতৃত্বে পরিচালিত বাম সরকারগুলি এই বিকল্প দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার ও এই সরকারের কর্মকান্ড সম্বন্ধে বিভিন্ন দিক থেকে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণা-চর্চা হয়েছে। এই সরকারের কর্মধারা যাঁরা পরিচালনা করেছেন এবং করছেন তাঁরাও বিভিন্ন সময়ে এই সরকারের কর্মপদ্ধতির তাত্ত্বিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছেন নানা নিবন্ধে, বক্তৃতায়। এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার কোন্‌ গণ-সংগ্রামের প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে, গড়ে ওঠার সময় এবং পরবর্তীতে এই সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে কী কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, এই সরকার যে জনমুখী বিকল্প অভিমুখ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, এবং কীভাবে নিরন্তর ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ মোকাবিলা করে এই সরকার এগিয়ে চলেছে, সে সম্পর্কে প্রধানত সি পি আই (এম) নেতৃবৃন্দের নির্বাচিত কিছু লেখা এই বইতে সংকলিত করা হয়েছে।

পাশাপাশি এই সরকার ও তার বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দিয়েছেন, তারও কিছু এখানে সংযোজিত হয়েছে। কেরালা এবং ত্রিপুরার বাম সরকারগুলির ভূমিকা ও কাজ সম্পর্কেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা এখানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই বইয়ের পরিশিষ্টে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংযোজিত হয়েছে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময় থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত কিভাবে এই ধরনের সরকারগুলি সম্পর্কে সি পি আই (এম)-র বোঝাপড়া ক্রমবিকশিত হয়েছে, তা এই দলিলগুলি থেকে কিছুটা উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। শনিবার মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করলেন পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টের চেয়ারম‌্যান ও সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিমান বসু।

‘গণশক্তি’-র সম্পাদক নারায়ণ দত্ত শুরুতে বইটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। বইটিতে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, বি টি রণদিভে, এম বাসবপুন্নাইয়া, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, সরোজ মুখোপাধ্যাায়, নৃপেন চক্রবর্তী, অনিল বিশ্বাস, চিত্তব্রত মজুমদারের মত প্রয়াত নেতৃবৃন্দের লেখা যেমন রয়েছে, তেমনি প্রকাশ কারাত, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, ভি এস অচ্যুতানন্দন, মানিক সরকার, এম কে পান্ধেসহ বর্তমান নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন লেখাও সংকলিত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সত্যব্রত সেন, অশোক মিত্র, অমর্ত্য সেন, অমিয় বাগচী, জি কে লিটেন, প্রভাত পট্টনায়েক, জয়তী ঘোষ, প্রভাত দত্তের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকটি নিবন্ধ। এরমধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি লেখাসহ বেশ কয়েকটি নতুন নিবন্ধ এই বইতে সংযোজিত হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের গড়ে ওঠা, এই সরকারের কর্মকান্ড ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে যাঁরা জানতে চান, তাঁরা অবশ্যই এই বইটি পড়ে উপকৃত হবেন।

তবে এই বইটি কখনোই বামফ্রন্ট সরকারের পূর্ণাঙ্গ মূল্যা য়ন হতে পারে না এবং তা করার চেষ্টাও হয়নি। বিশেষ করে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দের লেখা এখানে যুক্ত না করার অপূর্ণতা এই বইতে থেকে গেছে। ভবিষ্যতে এই কাজ করতে হবে। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৭২৮। মূল্য: ৩০০টাকা।

আজ থেকেই বইমেলায় গণশক্তি-র স্টলে(৫৭৮নং) বইটি পাওয়া যাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।