চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!
মজিদ খান শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনামলের সংগ্রামের গৌরব গাথাঁ ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করুন। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করুন।
আমরা ধারাবাহিকভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করব পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। আজকের লেখাটি প্রীতম-অংকুশ এর লেখা
১৪ ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
। ভালোবাসার রঙ দেখে আমরা অবাক হই। কত ধরনের হতে পারে ভালোবাসা! সন্তানের প্রতি পিতামাতার, পিতামাতার প্রতি সন্তানের, প্রেমিক-প্রেমিকার, বন্ধুত্বের, ভাই-বোনের, আত্মীয়তার, মানুষের প্রতি মানুষের …। ভালোবাসা কি? উত্তর নেই, আবার আছে। সেই উত্তর অবশ্যই বিভিন্ন! কেননা, ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যা সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা হয়তো মানবমস্তিষ্কের নেই; শুধু অনুভবের ক্ষমতা আছে, শুধু হৃদয়ে নিজের মতো করে ধারণ করার ক্ষমতা আছে! ভালোবাসা-র তাই দিবস বোধ আছ কিনা সে আলোচনায় যাবো না।
এটি একটি বিতর্কিত আলোচনা এই কারণে যে, কারো কাছে ভালোবাসা দিবসে ঘোরাই ভালোবাসা; কারোর কাছে আজীবন ঘরের কোণে আনমনে ভালোবাসাকে মনে করাটা ভালোবাসা! এই লেখাটির বিষয়বস্তু একটাই, তা হলো আমাদের স্মৃতিশক্তি-কে ফিরিয়ে আনা। ।
১৪ ফেব্রুয়ারী, স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস। । ১৯৮২ সালের ১৪ মার্চ, সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরাচার এরশাদ সরকার।
সামরিক আইন জারি করে মৌলিক অধিকারের ভূ-লুণ্ঠন এবং বিরোধী দলীয় কর্মী ধরপাকড়, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এরশাদ আমল। প্রথম থেকেই তিনি ইসলাম ধর্মকে অত্যাচারের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। সাধারণের সেন্টিমেন্ট ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সাধারণকে মোহিত করার বুদ্ধিটাও নিদারুণ প্রশংসনীয়! এরশাদের শাসনামলে ২১ ফেব্রুয়ারীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইসলাম পরিপণ্থী বলে ঘোষনা করা হয় এবং আল্পনা অংকনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তিনি! আর সামরিক নির্যাতন তো অব্যাহত …। কিন্তু সে সময়ের ছাত্রজনতা প্রথম থেকেই এই স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে নির্ভয়চিত্তে। সেই ছাত্র আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগায় তৎকালীন আমলে প্রণিত “মজিদ খান শিক্ষানীতি”।
সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচন-কে ভিত্তি ধরে প্রণিত এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়- এই শিক্ষানীতিতে। মোদ্দাকথা, শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করার হীন প্রয়াস থাকে এই শিক্ষানীতিতে! যেন, কোটিপতিরাই সমাজের একমাত্র অবলম্বন, তাদের ছাড়া কেউ শিক্ষা পাবার যোগ্য নয়। গণবিরোধী এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ফুঁসে ওঠে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী। মধুর ক্যান্টিনে সকল ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত রূপ, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ -এর উত্থান ঘটে।
একই ধারার অবৈতনিক বৈষম্যহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির দাবিতে ‘৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারী বিশাল মিছিলে শামিল হয় শত শত ছাত্র। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল ছাত্রীবৃন্দ। হাইকোর্টের গেইট এবং কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় কাঁটাতারের সামনে এসে ছাত্রীরা বসে পড়ে; নেতৃবৃন্দ কাঁটাতারের উপর দাঁড়িয়ে জানাতে থাকে বিক্ষোভ। অতর্কিত পুলিশী হামলার শিকার হয় ছাত্র জনতা। শিক্ষার্থীদের উপর গরম পানি ছিঁটিয়ে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ।
নিহত হয় জয়নাল, দিপালীসহ অনেকে। শিশু একাডেমীর অনুষ্ঠানে যোগদান দিতে গিয়ে নিহত হয় শিশু দিপালী, তাঁর লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। জয়নালের গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তবে শান্ত হয় পশুরা। ১৫ তারিখ আন্দোলন আরো ছড়িয়ে পড়লে নির্যাতনের পাল্লা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামে প্রতিবাদী কাঞ্চন নিহত হয় ১৫ তারিখ! শত শত ছাত্রকে নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়, অত্যাচার চালানো হয়।
তবু সেই মহান আন্দোলনের ফল আসে, পতন ঘটে স্বৈরাচার সরকারের।
‘৫২ এর মতো, ছাত্রসমাজের আরেকটি গণঅভ্যুত্থান- ‘৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারী, আজ আমরা তথাকথিত নতুন জেনারেশন যা ভুলতে বসেছি! ভালোবাসার মতো অনুভূতি নিয়ে ব্যবসায় নামা প্রতিষ্ঠানের চাটুকারিতায়, বিদেশী উৎসবে মত্ত হয়ে ভোগবাদী সংস্কৃতি লালনে আজ আমরা পাগলপ্রায়। জয়নাল-দিপালী-কাঞ্চনের রক্তভেজা বটতলা আজ শহীদ স্মরনে নয়, প্রেমিক-প্রেমিকার বাদাম খাওয়ার জন্য! গণমাধ্যমসহ এরশাদ পরবর্তী গণতন্ত্রের ধব্জ্যাকারী সরকারগুলো ১৪ ফেব্রুয়ারী-কে স্মরণ করার ব্যাপারে উদাসীন। যদিও তারা আশ্বাস দিয়েছিলো, ছাত্রসমাজের আকাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি তারা প্রণয়ন করবেন; শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখবেন। কেউ কথা রাখেনি …।
বরং শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা থেকে শুরু করে বঙ্গভবন, সক্কলে “আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” বলতে ভুল করে না, ভুল করে না ভালোবাসা দিবসে বাণী দিতে; শুধু ভুল হয় শহীদ ছাত্রদের স্মরণ করতে! বর্তমান ছাত্রসমাজ আজ জানেই না তাদের গৌরবময় ইতিহাস, তাদের জানতে দেয়া হচ্ছে না তাদের ইতিহাসের স্বর্নালী অধ্যায়! আফিমস্বরূপ ভালোবাসা দিবস সামনে রেখে চিরাচরিত সরকারব্যবস্থাগুলো আর তাদের গণ(!)মাধ্যম ছাত্রসমাজকে নিয়ে খেলায় মেতেছে, আর আমরা কলুর বলদের মতো ইতিহাস ভুলে পশ্চিমা মূলা নাকের সামনে রেখে শুকছি!
ভালোবাসা দিবস পালন নিয়ে কোন আপত্তি নেই, আগেই বলেছি; আপত্তি কেন জয়নাল এর আত্মত্যাগ স্মরণীয় হবে না? কেন দিপালীর রক্তভেজা পথে রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে বিদেশী সংস্কৃতিতে মত্ত হতে হবে? সাম্প্রতিক ভারতীয় বাজারি সংস্কৃতির আগ্রাসন আর সেই সাথে আমাদের স্ব-ইচ্ছায় পশ্চিমা, বিদেশী ভাবধারার স্রোতে গা ভাসানো, তাদের অন্যায় নীরবে মাথা পেতে নেওয়া— এরকম চললে আর কতদিন আমরা বলতে পারবো আমরা বাংলাদেশী? তাই ছাত্রসমাজ সহ সকলের কাছে একটি অনুরোধ- ১৪ ফেব্রুয়ারী শুধুমাত্র ভ্যালন্টাইনস ডে পালন না করে শহীদদের স্মরণ করি, তাঁদের তারুণ্যমাখা চেতনা লালন করি বাংলাদেশী হিসেবে। একটি প্রশ্ন:: ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পাশাপাশি যদি ভ্যালেন্টাইনস ডে থাকতো, তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, আমার বিজয়গাঁথা স্মৃতি ভুলে আমি পশ্চিমা স্রোতে উত্তাল হবো! যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে গণমাধ্যম আর শাসকচক্রের হীন ষড়যন্ত্র এড়িয়ে আসুন আমরা নিজেদের ইতিহাস জানি, তুলে ধরি বীর বাঙালির শাশ্বত ঐতিহ্যকে …..
লিখেছেন: প্রীতম অংকুশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।