মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীর সম্ভাবনা শিরোনামে আমি যে সিরিজটি লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম সেটার প্রথম পর্বে বিজ্ঞানী ড্রেক এর সমীকরণের কথা উল্যেখ করেছিলাম। তাঁর মতে এই সমীকরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বে ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতা থাকবার সম্ভবনা হিসাব করা যাবে। কে জানে এই বুদ্ধিমান প্রানিরাও হয়তো আমাদের মত তাদেরও আন্তঃনাক্ষত্রিক প্রতিবেশীদেরকে খুঁজে বেড়াবার জন্য মহাকাশ চষে বেড়াচ্ছে!
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে অ্যামেরিকার ন্যাশনাল রেডিও এস্ট্রোনমি অবজারভেটরিতে বিশ্বের সেরা কিছু জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানীরা একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন, যা গ্রিন ব্যাংক কনফারেন্স হিসেবে পরিচিত। সে সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা জ্যোতিপদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক ড্রেক “ গ্রিন ব্যাংক কনফারেন্স“ এ তাঁর এই বিখ্যাত ফর্মুলাটি বিজ্ঞানী মহলে উপস্থাপন করেন। সেই থেকে এই সমীকরণ টি “ড্রেকের সমীকরণ” হিসেবে গবেষকদের কাছে পরিচিতি লাভ করে।
ড্রেক সাতটি ফ্যাক্টরকে একসাথে বিবেচনা করে এই সমীকরণটি প্রদান করেন। ড্রেকের সমীকরণটি হলো
N = R*Fp*Ne*F1*Fi*Fc*L
এখানে সমীকরণের বামপাশে N হলো বর্তমান সময়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক যোগাযোগ এ করতে সক্ষম এমন বহিঃজাগতিক বুদ্ধিমান জীব থাকার সংখ্যা।
আর সমীকরণের ডান পাশের ফ্যাক্টরগুলো প্রত্যেকেটি গুণ আকারে রয়েছে।
ফ্যাক্টর R হলো প্রতি বছর আমাদের গ্যালাক্সীতে সূর্যের মত গঠনের নক্ষত্র সৃষ্টির গড় সংখ্যা। এই গড় বের করা হয় কোনো গ্যালাক্সিতে থাকা সকল নক্ষত্রের মোট সংখ্যাকে গ্যালাক্সিটির বয়স দ্বারা ভাগ করে।
যেমন আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতে আনুমানিক ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে এবং আমাদের নক্ষত্রের বয়স হলো প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর। সুতরাং এক্ষেত্রে R হবে ৪০০/১০ = ৪০
অর্থাৎ আমাদের গ্যালাক্সিতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০ টি নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়।
ফ্যাক্টর Fp হলো নক্ষত্র গুলোর মাঝে কত শতাংশ (যেমন ১= ১০০%, ০.২৫=২৫%) নক্ষত্রের গ্রহ আছে সেই সংখ্যা।
এখন পর্যন্ত যদিও সৌরজগত ছাড়া গ্যলাক্সির অন্য কোথাও গ্রহ রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে গবেষকরা নিশ্চিত নন। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং গবেষকদের বিরামহীন গবেষণার ফলে এমন কিছু প্রোটপ্লানেটরী ডিস্ক জোন আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো থেকে পরবর্তীতে সৌরজগতের বাইরেও অন্য কোনো নক্ষত্রকে ঘিরে গ্রহ তৈরি হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, প্ল্যানেটারি সিস্টেম গঠন হওয়া কোনো ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়া নয় বরং এটি একটি নির্দিষ্ট নিয়মে গঠিত হ্য়। এরকম একটি ধারণা থেকেই কোনো কোনো বিজ্ঞানীরা মনে করেন যেকোনো গ্যালাক্সিতে বিদ্যমান নক্ষত্র গুলোর অর্ধেকেরই গ্রহ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্র এই Fp এর মান হলো ০.৫।
ফ্যাক্টর Ne হলো একটি প্ল্যানেটরি সিস্টেমে থাকা হ্যাবিটেবল জোন এর গড় সংখ্যা। বর্তমানে ধারণা করা হয় গড়ে প্রতি দুইটি প্ল্যানেটারি সিস্টেমে অন্তত একটি হ্যাবিটেবল জোন থাকবে যেখানে প্রাণের উন্মেষ ঘটা সম্ভব।
সুতরাং এক্ষেত্রে Ne হবে~০.৫
হ্যাবিটেবল জোন হলো এমন একটি অঞ্চল যেখানে প্রানের বিকাশ ঘটবার মত যথেষ্ট অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান। যেমন আমাদের সৌরজগতের মঝে পৃথিবী একটি হ্যাবিটেবল জোনে রয়েছে। প্রানের বিকাশ ঘটবার জন্য অনুকূল আবহাওয়া একটি আপেক্ষিক বিষয়। বিভিন্ন প্রানের অভিযোজনের জন্য অনুকূল পরিবেশ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে ইউরোপাতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেলে অন্য পরিবেশগুলোতে কিভাবে প্রাণের বিকাশ সম্ভব সে বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
প্রসঙ্গত ইউরোপা হলো বৃহস্পতি গ্রহের চারটি চন্দ্রের সবচেয়ে ছোটটি। অন্য চন্দ্র তিনটি হলো লো, গ্যানিমেড এবং ক্যালিস্ট্রো। একটি সাধারণ টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে দেখলে বৃহস্পতির যে বলয় আমরা দেখতে পাই সেগুলো হলো এই লো, ইউরোপা, গ্যানিমেড এবং ক্যালিসট্রো। এদের একসাথে গ্যালিলিয়ান মুন ও বলা হয়ে থাকে।
ফ্যাক্টর F1 হলো ফ্যাক্টর Ne তে যে গ্রহগুলো রয়েছে সেই সকল গ্রহের মাঝে যে গ্রহগুলোতে সত্যিকার অর্থেই প্রাণের বিকাশ ঘটবে এবং যুগ যুগ ধরে সেই পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে সেগুলোর শতকরা হার।
বর্তমানে এ্যস্ট্রোবায়োলজিস্টরা মনে করেন এই মান ১=১০০% হতে ০=০% এর কিছু কম হতে পারে।
আগেই বলেছি যে, প্রানের বিকাশ ঘটবার জন্য বায়োলজিক্যাল হিসেবে অনুকূল আবহাওয়া একটি আপেক্ষিক বিষয়। কোনো গ্রহে প্রাণের আবির্ভাব ঘটবার সবরকম অনুকূল অবস্থা থাকলেও সেখানে প্রাণের সুচনা নাও হতে পারে। আবার প্রাণের সূচনার জন্য আমাদের পরিচিত কোন রকমের অনুকূল “টিপিক্যাল” পরিবেশ না থাকলেও সেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটবার সম্ভাবনা রয়েছে। মহাকাশে কিছু অরগ্যানিক ম্যাটেরিয়াল পাওয়া যাওয়ায় দ্বিতীয় তত্ত্বটি এখন বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রমানিত হতে শুরু করেছে।
অরগুয়্যেল ম্যাটিওরাইট, কমেট, এবং অন্য গ্রহ থেকে সংগৃহীত লিকুইড অথবা ফ্রোজেন পানিতে প্রাপ্ত এই জৈব পদার্থগুলো বিজ্ঞানীদের ভিনগ্রহে প্রাণ থাকবার সম্ভাবনার ধারনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের পৃথিবীতেই এমন কিছু পরিবেশে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গেছে যেখানে স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এদেরকে এক্সট্রিমোফাইল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন থার্মোফাইল হিসবে এমন কিছু ব্যাক্টেরিয়া কে গ্রুপ করা হয়েছে যেগুলো ৪০°সেঃ থেকে ৭০°সেঃ পর্যন্ত তাপমাত্রায় নিজেদের টিকিয়ে রাখে এবং বংশবিস্তার করে। আর এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যেগুলো ৬০°সেঃ থেকে ১১০°সেঃ পর্যন্ত আবহাওয়াকেই নিজেদের জন্য অনুকূল হিসেবে মেনে নিয়েছে।
সাইক্রোফাইল গ্রুপে রয়েছে এমন কিছু অণুজীব যারা কিনা হিমাংকের নিচে অর্থাৎ -১০°সেঃ থেকে -২০°সেঃ বরফ শীতল তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকে। আর রয়েছে হ্যালোফাইলস, অ্যাসিডোফাইলস অথবা অ্যালকালিফাইলস যেগুলো কিনা অতি লবণাক্ত, অম্লীয় অথবা ক্ষারীয় পরিবেশে নিজেদের এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে যা আসলেই আশ্চর্য হবার মত বিষয়। পরবর্তী অন্য কোনো পোষ্টে এরকম এক্সট্রিমোফাইলস অথবা প্রতিকূলজীবীদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। এগুলোর সবগুলোই যদিও প্রোক্যারিওটিক ব্যাক্টেরিয়া এবং আরকিয়া(Archea) কিন্তু এদের ও তো প্রাণ আছে!আর কেই বা জানে আমাদের কাছে প্রাণের বিকাশ ঘটবার জন্য অসম্ভব মনে হওয়া ভিন গ্রহের এরকম কোনো পরিবেশেই হয়তো বুদ্ধিমান কোনো প্রাণের বসতি গড়ে উঠেছে! যতদিন পর্যন্ত সেই জীবের সাথে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছেনা ততদিন এ ধারণাগুলো শুধূই কল্পনায় আর থিওরি হয়ে গবেষণাপত্র গুলোতে জমা হয়ে থাকবে। অপ্টিমিস্টিক সেইসব খ্যাপাটে বিজ্ঞানীদের ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের সেই অজেয় অর্জনের অপেক্ষায় আমরা আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকিনা কেন!!!
সিরিজ-১ এবং সিরিজ-২এর জন্য আমার ব্লগ দেখুন।
(সম্ভবত হাইপার লিংকটি কাজ করছেনা। )
পোষ্ট বড় হয়ে যাওয়ায় অন্য ফ্যাক্টরগুলোকে পরবর্তী সিরিজে আলোচনা করা হবে। লেখায় যে কোনো ধরণের বিচ্যুতি ধরিয়ে দেবার জন্য সিনিয়র ব্লগারদের অনুরোধ জানাচ্ছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।