আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোবাইল অপারেটররা নামমাত্র দামে ফ্রিকোয়েন্সি পাচ্ছে : গত ১৫ বছরে সরকারের গচ্চা গেছে ৫ হাজার ২শ’ কোটি টাকা



দেশের চারটি মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স নবায়ন নিয়ে বিটিআরসি সম্প্রতি যে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, তাতে ফ্রিকোয়েন্সির দাম অনেক কম ধরা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন। কারণ, নতুন নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে স্পেকট্রামের জন্য আবেদন করতে মোবাইল অপারেটরদের মাত্র ৫০ হাজার টাকা ফি লাগবে। যদিও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই ফি আরও অনেক বেশি। এছাড়া স্পেকট্রাম অ্যাসাইনমেন্ট ফি দিতে হবে প্রতি মেগাহার্জে জিএসএম ১৮০০ ব্যান্ডের জন্য ১৫০ কোটি টাকা, ৯০০ ব্যান্ডের জন্য ৩০০ কোটি টাকা এবং সিডিএমএ’র প্রতি মেগাহার্জের জন্য ১৫০ কোটি টাকা। তাদের দাবি, গত ১৫ বছরের আয়-ব্যয়ের একটি সাদামাটা হিসাবকে বিবেচনায় এনে বিটিআরসি লাইসেন্স নবায়ন নীতিমালা তৈরি করেছে।

এতে আগামী ১৫ বছরে দেশের মোবাইল সেক্টরের সম্ভাব্য বিকাশকে হিসাবে আনেননি। তাই ন্যূনতম ফি নির্ধারণ শতভাগ ইতিবাচক নয়। বিশেষত ফ্রিকোয়েন্সি চার্জ কমপক্ষে দ্বিগুণ ধরা হলে দেশের আয় বাড়তো। তারা মনে করেন, ২০১১ সালটি বাংলাদেশের টেলিকম সেক্টরের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ, এই বছরই টেলিকম সেক্টরে এমন কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে যা আগামী ১৫ বছরের ভবিষ্যত্ নির্মাণ করে দেবে।

তাই এখানে ভুল করার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার ও বিটিআরসির সিদ্ধান্তহীনতার কারণে গত ১৫ বছরে এমনিতেই ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। অর্থাত্ ওই সময়ে দেশি-বিদেশি কয়েকটি টেলিকম অপারেটরের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করতে পারেনি সরকার। কারণ, কয়েকটি টেলিকম অপারেটরের কাছে দেশের ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি না করে তা ফ্রি বরাদ্দ দিয়েছিল। তাদের মতে, এটি এমন দুর্নীতি যা ভারতের টেলিকম দুর্নীতির চেয়েও ভয়াবহ।

জানা গেছে, সম্প্রতি বিটিআরসি চারটি মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স নবায়নের খসড়া তৈরি করতে গেলে এই ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসে। টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ওই সময় ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করেছিল ১৪.৬ বিলিয়ন ডলারে, নরওয়ে ৮৯.৬ মিলিয়ন ডলারে, সিঙ্গাপুর ১৬৫.৬ মিলিয়ন ডলারে, ইউকে ৩৫.৩৯ বিলিয়ন ডলারে, জার্মানি ৪৫.৮৭ বিলিয়ন ডলারে সেখানে বাংলাদেশ ৫টি মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি তুলে দিয়েছে বিনা পয়সায়। ১৯৯৬ সাল থেকে টেলিকম অপারেটররা বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। ওই সময় থেকে তারা সম্পূর্ণ ফ্রি চার্জে সর্বমোট ৯২ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে আসছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ফ্রিকোয়েন্সির পরিমাণ ২২ মেগাহার্জ।

রবি’র ১৪ দশমিক ৮ মেগাহার্জ, বাংলালিংক ১৫ মেগাহার্জ, এয়ারটেল ১৫ মেগাহার্জ, টেলিটক ১৫ দশমিক ২ এবং সিটিসেল ব্যবহার করছে ১০ মেগাহার্জ। ২০০৮ সালে ২২ মেগাহার্জ বিক্রি করা হয় কয়েকটি অপারেটরের কাছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোন ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্জ, বাংলালিংক ৫ দশমিক ১ মেগাহার্জ, রবি ৫ মেগাহার্জ কিনেছে, যা বিক্রি করে সরকার গত ৩ বছরে আয় করেছে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। অর্থাত্ এর আগে ১১ বছর সবগুলো অপারেটর হাজার কোটি টাকা দামের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করলেও সরকারকে কোনো টাকা দেয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০৮ সালে বিভিন্ন অপারেটরের কাছে ২২ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করার পরও সংশ্লিষ্ট অপারেটরগুলোর কাছে অবিক্রীত ফ্রিকোয়েন্সি থেকে যায় আরও ৬৫ মেগাহার্জ, যা বিক্রি করা সম্ভব হলে সরকারের কোষাগারে আসতো আরও ৫ হাজার ২শ’ কোটি টাকা।

অবিক্রীত ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে গ্রামীণফোনের ১৪.৬ মেগাহার্জ, সিটিসেলের ১০ মেগাহার্জ, রবি’র ১২.৬ মেগাহার্জ, বাংলালিংকের ১২.৬ মেগাহার্জ, টেলিটকের ১৫.২ মেগাহার্জ রয়েছে। কিন্তু এসব অপারেটর সরকারের কাছ থেকে ফ্রি ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে তা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে একই সময়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু চোখ-কান খোলা রাখলেই আগামী ১৫ বছরে সরকার মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছ থেকে কমপক্ষে ১৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। হিসাব অনুযায়ী, এই আয়ের মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছ থেকে আয় করা সম্ভব ৭ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। বাংলালিংক থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, রবির কাছ থেকে ৩ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।

সিটিসেলের কাছ থেকে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। আর এই টাকা দিয়ে চারটি যমুনা সেতু কিংবা ১০টি যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার তৈরি করা সম্ভব। কারণ, যমুনা সেতুর বাজেট ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। আর গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের বাজেটি ১৩শ’ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নসহ টেলিকম সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সরকার বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে একের পর এক হাত পাতলেও হাজার হাজার কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ফ্রি দিয়ে দিচ্ছে মোবাইল অপারেটরদের।

বর্তমানে দেশে জিএসএম প্রযুক্তির মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ৫টি ও একটি সিডিএমএ অপারেটর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিটিআরসির খসড়া নীতিমালা শতভাগ যৌক্তিক না হলেও এটি বাস্তবায়ন হলে মোবাইলফোন অপারেটরদের লাইসেন্স পেতে অবশ্যই তাদের ব্যবস্থাপনা পরিষদে ৫০ শতাংশ হারে বাংলাদেশী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে। আর বিদেশি কর্মকর্তার সংখ্যা অবশ্যই মোট কর্মচারীর ১ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না। শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পরিষদ যেমন সিইও, সিএফও, সিসিওসহ শীর্ষস্তরে দেশি-বিদেশি চাকরিজীবীর সংখ্যা হতে হবে ৫০ শতাংশ হারে। অথচ বর্তমানে মোবাইল অপারেটর কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম-কানুন, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা না থাকায় বাংলাদেশী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্ণবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

কোনো জিএসএমভিত্তিক অপারেটর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোনো বাংলাদেশীকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয়নি। তারা বলেন, খসড়া নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রতি বছর অপারেটরগুলোর মোট রাজস্ব আয়ের ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সোস্যাল অবলিগেশন ফি সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেটি বাস্তবায়ন হলে সরকার এই ফান্ড দিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়নসহ ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারবে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, সব অপারেটরকে তাদের গ্রাহকদের জন্য গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কল ড্রপ, কল ভেঙ্গে যাওয়া, নেটওয়ার্ক সমস্যা এবং ভয়েস ও ড্যাটা সার্ভিসে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া প্রচুর পরিমাণে অভিযোগ কেন্দ্র, সার্ভিস সেন্টার থাকতে হবে। জরুরি ও টোল ফ্রি নম্বরগুলোর জন্য কোনো ধরনের চার্জ রাখা যাবে না। ২০০৭ সালে সেলুলার মোবাইল ফোন সংক্রান্ত টেলিকম সেক্টরের সার্বিক সংস্কার উপলক্ষে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের ওই কমিটিতে ছিলেন ড. মো. আবু সাইদ খান, মাহাবুব সারোয়ার, এটিএম তারিকুজ্জামান, মজিবর রহমান আল মামুন, তারেক এম বরকত উল্লাহ এবং রেজাউল কাদের। ওই কমিটি সরকারের সঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের রেভিনিউ শেয়ারিং নির্ধারণ, মোবাইল টেলিফোনের শেয়ার পুঁজিবাজারে উন্মুক্তকরণ, মোবাইল টেলিফোনের বিভিন্ন চার্জ পুনর্র্নিধারণ, এই সেক্টরে দেশীয় জনবলের কর্মসংস্থান সুবিন্যস্তকরণসহ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোবাইল অপারেটরগুলোকে তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে আয়কৃত ভাড়া ও কলচার্জের শতকরা ১৫ শতাংশ টাকা রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে সরকারকে দিতে হবে।

আর নতুন লাইসেন্স নবায়ন নীতিমালা সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই তৈরি হয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.