‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগকে সম্পৃক্ত করবেন। ’ যুবলীগের গঠনতন্ত্রে এভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকের কার্যাবলির বর্ণনা রয়েছে।
তবে যুবলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ছাত্রজীবনেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ হিসেবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারে তিনি কোনো কাজ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শিক্ষা ভবনে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে পিটুনি খেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্যের ছাত্র ও তৎকালীন মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুল।
গ্রেপ্তার অবস্থায় পত্রিকায় তাঁর ছবি ছাপা হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু শিক্ষা ভবন ছাড়েননি শফিক। সেই শফিক এখন শিক্ষা ভবনের টেন্ডারবাজির প্রধান নিয়ন্ত্রক।
আওয়ামী যুবলীগ ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর নেতারা প্রায় সবাই কোনো না-কোনো সরকারি ভবনে তৎপর। শিক্ষা ভবন, সড়ক ভবন, মৎস্য ভবন, বিদ্যুৎ ভবন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, সর্বত্রই তাঁদের আনাগোনা। এসব ভবন থেকে সারা দেশের বিভিন্ন খাতের উন্নয়নকাজ ও কেনাকাটা সরকারি সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন করা হয়। আর যুবলীগের নেতাদের মাধ্যমেই সব রকম ঠিকাদারি কাজের বিলি-বণ্টন হয়।
আপস-মীমাংসার মাধ্যমে দরপত্র ফেলা হয়।
যুবলীগের বর্তমান ও ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়, এমনকি সচিবালয়ের ভেতরে মন্ত্রণালয়ে পর্যন্ত যুবলীগ নেতাদের আনাগোনা। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, নিজস্ব মাস্তান বাহিনী এবং টাকা ছড়িয়ে তাঁরা সব ধরনের ঠিকাদারি ও সরবরাহ কাজ হস্তগত করেছেন। আর দলের ঠিকাদারদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হলে সমঝোতার জন্য রয়েছেন বড় নেতারা। তবে কাজ যে-ই পাক, নেতাদের কমিশনের টাকা পৌঁছে দিতে হবে শতাংশ হিসেবে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাও তাঁদের অগ্রজদের (সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা) সঙ্গে এই টেন্ডারবাজির অংশীদার। আবার কয়েকটি জায়গায় মহানগর ছাত্রলীগের গুটিকয়েক নেতা-কর্মীও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে জুয়ার আসর থেকে যুবলীগ নেতারা বিশাল অঙ্কের টাকা রোজগার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা জুয়া খেলে ও জুয়ার আসর বসিয়েই ধনী হয়েছেন এবং রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ওই নেতা জুয়া খেলতে আমেরিকার লাস ভেগাসে ও সিঙ্গাপুরে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিয়েছি। কোনো ঘটনায় মামলা হলে সেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখে। সহযোগিতা চাইলে সহযোগিতা করা হয়। তবে বিএনপি সরকারের আমলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে দলের অনেক ভালো কর্মীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। ’
ভবনে ভবনে টেন্ডারবাজি: নেতা-কর্মীরা বলছেন, মহানগর যুবলীগের সাবেক নেতা বর্তমান সাংসদ (বৃহত্তর বরিশালের একটি আসনের) আর দক্ষিণ যুবলীগের ওই জুয়াড়ি শীর্ষ নেতা পুরো রাজধানীর টেন্ডার প্রক্রিয়ার অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করেন।
ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তাঁরাই আবার সমঝোতার আয়োজন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে হামলা-গুলির ঘটনাও ঘটে। বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পুরো নিয়ন্ত্রণ এই দুই নেতার হাতে। এমনকি সাংসদ হওয়ার পরও ওই নেতা নিয়মিতভাবেই সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে যান।
ক্রীড়া ভবনের টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন সদ্য নিহত রিয়াজুল হক খান মিল্কী, ক্রসফায়ারে নিহত জাহিদ সিদ্দিকী তারেক, মিল্কী হত্যা মামলার আসামি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে চঞ্চল ও মতিঝিল যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু।
মৎস্য ভবনের টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান ওরফে বকুলসহ শাহবাগ থানা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী নাজির, শিমুল ও স্বপন।
পূর্ত ভবনের টেন্ডারবাজি (পিডব্লিউডি) নিয়ন্ত্রণ করেন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ও কাউসার মোল্লা নামে এক যুবলীগ নেতা।
খাদ্য ভবনের টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন ইসমাইল চৌধুরী, শফিকুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান বকুল।
পিডিবির পরীবাগ কার্যালয়ে ইসমাইল, মিজানুর ও শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের অনুসারীদের আধিপত্য। ইমন কারাগারে বসেই এখানকার টেন্ডারবাজির টাকার ভাগ পান বলে জানা গেছে।
মতিঝিলের বিদ্যুৎ ভবনের টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন মিজানুর রহমান আর গণি রোডের পিডিবি কার্যালয়ে চঞ্চলের আধিপত্য।
তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে সম্রাট টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঠিকাদারি করি না। এসব ভবনে কখনো যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমার বিরুদ্ধে এসবই অপপ্রচার।
ঠিকাদার সমিতির নেতারা বা অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, নিজেরা এসে ঘুরে দেখুন কেউ আমার কথা বলে কি না। ’
মামলা হলেও ব্যবস্থা নেই: স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ যুবলীগের সাবেক নেতা বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক জুয়েলের হাতে। গত ১৯ জানুয়ারি রাতে একদল দুর্বৃত্ত জিয়াউলের শাহবাগ জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্সের নিচতলার কার্যালয়ে গুলি চালায়। পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষ আর শাহবাগ থানা থেকে কয়েক গজ দূরত্বের মধ্যে হলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় ১২ ঘণ্টা পরে। এ বিষয়ে জিয়াউলের কার্যালয়ের এক কর্মী মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল আলম আরিফ ও সজলের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন।
এই মামলাটি তদন্ত শেষে ঘটনার সত্যতা পেলেও কোনো আসামিকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। তাই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
গত বছরের ১২ জুন সড়ক ভবনে ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোলাগুলিতে কয়েকজন আহত হন। র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, গোলাগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম, ক্রসফায়ারে নিহত মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক ও মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন। তাঁরা সড়ক ভবনে গোলাগুলির পর বিজি প্রেস-সংলগ্ন রংধনু ক্লাবে এসে বসেছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলাতেও কোনো যুবলীগ নেতাকে ধরেনি পুলিশ। ওই ঘটনার সঙ্গে পুলিশ তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি বলে জানিয়েছে। তবে পুলিশ ছাড়া যুবলীগের নেতা-কর্মী, সড়ক ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই জানতেন যুবলীগের নেতারা সেখানে গুলি ছুড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অন্তত ৬০ জন আহত হন। এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা আরেক পক্ষকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করেন।
গুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, যুবলীগের বিজ্ঞান সম্পাদক শফিকুল টেন্ডারবাজিতে আধিপত্য বজায় রাখতে তাঁর অনুসারী নেতাদের দিয়ে অবাধ্যদের শায়েস্তা করতে গেলে এই রক্তপাত ঘটে। সেই ঘটনায় শফিকুলকে প্রধান আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরও তাঁর কিছুই হয়নি। এই মামলাটিও তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে পুলিশ, কিন্তু আসামি পায়নি।
অবশেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ওই ঘটনার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পের জন্য ২০ হাজার ৫০০টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই দরপত্রে অংশ নিতে গিয়ে শফিকুলের অনুসারীদের দ্বারা হেনস্তা হন সরকারি টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) কর্মকর্তারা। বিষয়টি টেশিসের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালককে ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি দিয়ে জানানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ‘শিক্ষা ভবন নিয়ন্ত্রণের কিছু নেই।
৭০-৮০টি করে টেন্ডার ফেলা হয়। আমি প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। আমি খোঁজও নিতে যাই না। আমি কাউকে বাধা দেওয়া বা বলা “ড্রপ কইরেন না” এ রকম করিনি কখনো। কেউ বাধা না দিলে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন আসে না।
একমাত্র শিক্ষা ভবনেই টেন্ডার নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় না। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে কেউ বলতে পারবে না কেউ বাধা দিছে। যিনি সর্বনিম্ন দর দেন, তিনিই কাজ পান। ’
পুরান ঢাকার যুবলীগ নেতা সাগর আহমেদ শাহীন গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে অস্ত্র কিনতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা হয়।
১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। হাতেনাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়লে এত দ্রুত জামিনে বের হওয়ার ঘটনা কমই ঘটে বলে কর্মকর্তারা জানান। এই সাগর আহমেদ ঢাকা মেডিকেল, শিক্ষা বোর্ডসহ আশপাশের কার্যালয়গুলোর টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
গত ৭ এপ্রিল বাড্ডা থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কায়সার মাহমুদকে (৩৮) ও তাঁর পরদিন একই এলাকার (৮ এপ্রিল) স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেনকে (৩৫) একই কায়দায় গুলি করে দুর্বৃত্তরা।
এরপর ১৬ জুন গুলিবিদ্ধ হন ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা ইমরুল হোসেন। এসব গোলাগুলির ঘটনায় পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। মামলা হলেও কোনো তদন্ত হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) মোহা. আবদুল জলিল মণ্ডল বলেন, অপরাধের সঙ্গে যুক্ত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের যে কেউ হোক না কেন, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।