আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামরিক ভূসম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহার



বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জনে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সামরিকবাহিনীর ভূসম্পদ৻ হোটেল, ফাষ্ট ফুড শপ এবং গলফ ক্লাব – এসব কিছুরই সেবা এবং সুবিধা সীমিত শুধু বিত্তবানদের মধ্যে৻ সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি বড় বাণিজ্যিক প্রকল্প হচ্ছে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল ৠাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল৻ এই হোটেলটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রথম পর্যায়ে এর সাথে জড়িত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী৻ তাঁর বর্ণনায় জানা যায় যে ১৯৮৭ সালে প্রথম এই হোটেলের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়৻ জেনারেল চৌধুরী বলছেন যে সামরিকবাহিনীর অতিথিদের আবাসন – বিশেষ করে বিভিন্ন সেমিনার বা সমাবর্তনে বাইরে থাকা আসা ব্যক্তিবর্গের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য সেনানিবাসের বাইরে একটি হোটেলের প্রয়োজন দেখা দেয়৻ তিনি বলেন যে বিশ্বের নানা দেশেই এধরণের আবাসন ব্যবস্থা করা হয় যা, তাঁর কথায় অবশ্য, ফাইভ ষ্টার হোটেল নয়৻ জেনারেল চৌধুরী বলেন যে সময়ে এই জায়গাটি বেছে নেবার আরেকটি কারণ ছিলো হরতাল এবং যানজটের কারণে শহরের অন্য কোথাও যাওয়া আসায় অসুবিধা হতো৻ সেনাকল্যাণ সংস্থা নীরব পৃষ্ঠপোষক হিসাবে থেকে তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে এই হোটেল পরিচালনার কথা চিন্তা করে বলে জানিয়ে জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বলেন প্রথমে এজন্যে চুক্তি করা হয়েছিলো হলিডে ইনের সাথে কিন্তু পরে সেই একই ব্যবস্থায় তা পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ৠাডিসন৻ হোটেলটির পুরোপুরি মালিকানা হচ্ছে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের এবং এটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন ৠাডিসন ৻ স্থাপত্য নকশার দিক থেকে হোটেলটির নান্দনিক সৌন্দর্য্য যে কারোরই নজর কাড়বে৻ আর, যেসব বিলাসিতা বা আরাম-আয়েশের জন্য বিত্তবানেরা পাঁচতারা হোটেলের আতিথ্য গ্রহণ করে থাকেন - তার সবকিছুই এখানে আছে৻ চিত্তবিনোদনের সান্ধ্য আয়োজন অতিথিদের মাতিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট৻ রেঁস্তোরাগুলোর খাবারের কথাই বলুন, কিম্বা পানশালার পানীয় অথবা শরীর বা রুপচর্চার সেরা আয়োজনগুলোর সবই রয়েছে এই ৠডিসন ওয়াটার গার্ডেনে৻ হোটেলটি যে শুধুমাত্র সামরিক ভূসম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই নয় - এটি ঢাকা সেনানিবাসের অন্যান্য স্থাপনার কিছু সুযোগ-সুবিধাকেও বাণিজ্যিক মুনাফার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে থাকে৻ অতিথিদের জন্য যেসব বিশেষ প্যাকেজ রয়েছে তার মধ্যে একটি গলফ প্যাকেজ৻ এর ওয়েবসাইটে প্যাকেজটির বর্ণণায় বলা হচ্ছে - “ ঢাকার ৠডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে একরাত অবস্থান করে আর্মি গলফ ক্লাবের নাইন-হোল গলফ খেলার সুযোগ উপভোগ করুন৻ গলফ স্পেশালে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে ডিলাক্স কক্ষে রাত্রিযাপন, বিনাভাড়ায় হোটেলের গাড়ীতে হোটেল থেকে গলফ কোর্সে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসা, বিনাভাড়ায় গলফ ক্লাব এবং প্রত্যেকের জন্য আলাদা ক্যাডি৻ “ ঢাকায় এধরণের বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে আরো পাঁচটি - কিন্তু, আর কারো পক্ষেই তাদের অতিথিদের সেনানিবাসের গলফ কোর্সে গলফ খেলার সুযোগ দেবার কোন অবকাশ নেই৻ ঢাকার অন্যান্য পাঁচতারা হোটেলগুলোর মধ্যে দুটির মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের এবং একটি ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের৻ আর, অপর দুটি হোটেলের উদ্যোক্তা পরিচালকরাও নিশ্চিত করেছেন যে ৠডিসনের মতো প্রতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব৻ ৠাডিসনের সাথে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার কারণে এক্ষেত্রে বাণিজ্যে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়লেও হোটেলশিল্প সম্পর্কে অভিজ্ঞ বিশ্লেষকদের কেউই এবিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না৻ পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন ৠাডিসন হোটেল সেনানিবাসের প্রায় সাত একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে - বর্তমান বাজারদরে যার মূল্য শতকেটি টাকার ওপরে৻ ঐ ধরণের অংকের বিনিয়োগ কোন বেসরকারী উদ্যোক্তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব৻ আর, সেকারণেই ঢাকায় অন্য কোন পাঁচতারা হোটেলের স্থাপনা ৠাডিসনের একটি ভগ্নাংশ মাত্র৻ ঐ বিশেষজ্ঞ বলেন যে জমি ছাড়াও আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের যে অর্থ এই হোটেলে বিনিয়োগ করা হয়েছে - সেই একই পরিমাণ বিনিয়োগ কোন বেসরকারী উদ্যোক্তা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন - তাহলে তার সুদের হার হবে দশ থেকে চৌদ্দ শতাংশ৻ সুতরাং, এখানে কোন প্রতিযোগিতার অবকাশ কোথায় ? বিষয়টি সম্পর্কে ৠডিসন হোটলস এন্ড রিসর্টসের মূল কোম্পানী – কার্লসন হোটেলস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হলে কোম্পানীর এশিয়া প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্পোরেট কমিউনিকেশন্সের পরিচালক জে কৃষ্ণন এক লিখিত বিবৃতিতে জানান যে তাঁরা হোটেল ব্যবস্থাপনার কাজ পরিচালনাকারী একটি প্রতিষ্ঠান যারা হোটেলের মালিকদের ব্যবস্থাপনা সেবা প্রদান করে থাকেন৻ মি কৃষ্ণন জানান যে এশিয়া প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৠাডিসন যেসব হোটেল পরিচালনা করি তার কোনটিতেই তাঁদের মালিকানা নেই৻ সুতরাং ৠাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল ঢাকাতেও তাঁদের কোন মালিকানা নেই৻ বিবৃতিতে বলা হয় যে অতিথিসেবা বা হসপিটালিটি খাতে এটা একটা প্রচলিত রীতি যে স্থাপনার মালিকের সহযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবসার উন্নয়নে নানাধরণের সুযোগ বা সুবিধাকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে থাকেন৻ সেনানিবাসের গলফ কোর্স এভাবে একটি হোটেলকে বাণিজ্যিক সুবিধা নেবার জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত ? এসম্পর্কে সেনাসদরের কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি৻ তবে, জেনারেল চৌধুরী এতে কোন সমস্যা দেখছেন না৻ তিনি বলেন যে যেহেতু হোটেলটির মালিক সশস্ত্রবাহিনী এবং গলফ কোর্সটিও সেনানিবাসের মধ্যে সেকারণে এটি ঐ পাঁচতারা হোটেলকে ব্যবহার করতে দেওয়ায় সেনাবাহিনীর কোন ক্ষতি হচ্ছে না৻ তাছাড়া গলফ ক্লাবটিও এভাবে কিছুটা আয় বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে৻ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেসরকারী খাতের হোটেলগুলোর মধ্যে একটির উদ্যোক্তা পরিচালক রাজনৈতিক কারণে একবছরেরও বেশী সময়ে বিদেশে অবস্থান করেন৻ আর, অপর আরেকটি হোটেলের উদ্যোক্তা পরিচালককে সামরিক গোয়েন্দারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করতে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে৻ হোটেল এবং বিলাসবহুল খাদ্য - পানীয় এবং বিনোদন সেবা খাতে ৠডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেলই সেনাবাহিনী-সম্পৃক্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়৻ ঢাকায় সেনানিবাস সংলগ্ন সড়কে নতুন প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ফাষ্টফুড শপ - ক্যাপ্টেনস ওর্য়াল্ড আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠান৻ লন্ডন বা নিউইয়র্কের মতো শহরগুলোতে যেধরণের ফাষ্ট ফুড শপ দেখা যায় এটি অনেকটা সেধরণেরই একটি প্রতিষ্ঠান৻ সংস্থাটি যে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুধুমাত্র বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তা নয়৻ খুব সাদামাটা হোটেলের ব্যবসাও বাদ যায় নি৻ এরকম একটি হোটেল হলো দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খুলনার নিউ টাইগার গার্ডেন হোটেল৻ খুলনা শহরের প্রবেশমুখেই এই হোটেলটি৻ এছাড়াও ওয়াটার গার্ডেন হোটেলস নামে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আরেকটি পাঁচতারা হোটেল প্রকল্প এখন বাস্তবায়নের কাজ চলছে৻ বিত্তবানদের জন্য সেনানিবাসের গলফ ক্লাব উন্মুক্ত আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের রয়েছে তিনটি গলফ ক্লাব - ভাটিয়ারী গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব এবং সাভার গলফ ক্লাব৻ এসব ক্লাবের সবগুলোই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন শত শত একর জমির প্রতিষ্ঠিত৻ একমাত্র ভাটিয়ারী গলফ ক্লাবেরই গলফ কোর্স প্রায় ছশো একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত৻ তবে, ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব লিমিটেড নামে যে কোম্পানী সরকারী এই সম্পদকে বিনোদনমূলক ব্যবসার কাজে লাগাচ্ছে সেই ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদে সেনাবাহিনীর বাইরে ধনী ও বিত্তবান কয়েকজন ব্যবসায়ীও রয়েছেন৻ ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার ঠিক দুবছরের মধ্রেই এই ক্লাবের সদস্যসংখ্যা শয়ের কোঠায় পৌঁছে যায়৻ এসব ক্লাবের আয়-ব্যয় বা লাভ - লোকসানের কোন হিসাব ক্লাবটির পরিচালকদের বাইরে কারো জানার সুযোগ নেই৻ সাভারের গলফ ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে প্রায় উনসত্তুর একর জমির ওপর৻ বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা সাড়ে সাতশোজন – যার মধ্যে প্রায় চল্লিশ শতাংশ হলেন সেনাবাহিনীর বাইরের৻ এমনকী এদের মধ্যে আটাশজন প্রবাসী বা বিদেশীও রয়েছেন৻ সেনানিবাস সংলগ্ন এসব গলফ ক্লাবের প্রধান হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সেনানিবাসের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বা জিওসি৻ আর, পরিচালকদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠরা কর্মরত সেনা কর্মকর্তা৻ এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কীভাবে সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য সেনাসদর থেকে পাওয়া যায় নি৻ তবে, এসব ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সেনাবাহিনী কীধরণের নীতি অনুসরণ করে থাকে – জানতে চাইলে সাবেক এডজুটেন্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বলছেন যে সাধারণত সেনা সদর দপ্তরের কাছে গলফ কোর্স থেকে থাকে যাতে কর্মকর্তারা অবসরে খেলতে পারেন৻ কিন্তু, ফাইটিং ফরমেশনের কাছে তা থাকেনা৻ কেননা, অফিসারদেরকে সকাল – বিকাল সাধারণ সৈনিকদের সাথে শরীরচর্চা এবং অন্যান্য খেলাধূলায় অংশ নিতে হয়৻ জেনারেল চৌধুরী বলেন যে সাভারে গলফ কোর্স করায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বাইরের সাথে যোগাযোগ বেড়ে যাবে এবং সেটা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার জন্য একটা মন:পূত বিষয় হবে না৻ সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় সব বাণিজ্যিক উদ্যোগের প্রাথমিক পুঁজির যোগানদাতা হলো সরকার৻ কিন্তু, সরকারের এধরণের নীতি কতোটা যৌক্তিক? সেপ্রসঙ্গ ফৌজি বাণিজ্যের ষষ্ঠ পর্বে৻

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.