সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
১৯৪৫ এর অক্টোবার মাসে ২৩ জন নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের তদানিন্তন পশ্চীম জার্মানীর নুরেমবার্গ শহরে বিচারের জন্য হাজির করা হয়। সেই সময় আমেরিকার একজন মনস্তত্ববিদ(যিনি একই সাথে জার্মান ভাষায়ও পারদর্শী) জি এম গিলবার্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ওই ২৩ জন নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের সাথে প্রত্যক্ষ কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের বর্বর মনোজাগতিক বিশ্লেষনের। গিলবার্ট তাদের কথোপকথনগুলো টুকে নিয়ে আদালতে নথি আকারে সেগুলো প্রদান করেন।
পরবর্তীতে নুরেমবার্গ ডাইরী নামে যা পৃথিবী বিখ্যাত হয়।
বছর পনের আগে বইটি প্রথম পড়বার পর নিছক শখের বশে একেবারেই ব্যক্তিপর্যায়ে বইটির বাংলা অনুবাদে হাত দেই, যার "সুচনা" ও "প্রতিক্রিয়া" পর্বদুটি এখানে তুলে ধরছি একটি বিশেষ কারণে। কারণটা এই পোস্টের টাইটেলেই ইঙ্গিত হিসেবে দেয়া আছে, তারপরও বইটির গিবত কেন তুলে ধরলাম, পোস্টের শেষে তার আরেকটু ব্যাখ্যার উল্লেখ করবো।
নুরেমবার্গ ডাইরীর শুরুর দু’টো পর্বঃ
সূচনাপর্বঃ অভিযুক্তগন
একঝাঁক বন্দীসহ আমি ২০শে অক্টোবর, ১৯৪৫ সনে নুরেমবার্গে পৌঁছলে আন্তর্জাতিক সামরিক জুরিবর্গ অভিযুক্ত ২৩ জন নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জিম্মায় গ্রহণ করলেন। একজন জার্মানভাষী সামরিক গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে আমি প্রতক্ষ্য করেছি ধ্বসে পড়া নাৎসী যুদ্ধমেশিন এবং ভি ই ডে (V-E Day)-এর পূর্বের ডাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের নাৎসী বর্বরতার চিহ্নসমূহ।
পেশাগতভাবে একজন মনস্তত্ববিদ হিসেবে আমি স্বভাবতই একদল মানুষের নাৎসী বর্বরতার এই হিংস্র হোলিখেলায় অংশগ্রহণের কারণগুলি খুঁজতে কৌতুহলী হয়ে পড়েছিলাম।
কথিত যুদ্ধবন্দী এবং জার্মান নাগরিকদের সাথে আমার বাদানুবাদ আমার কৌতুহলী প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেনি। সেই ২৩ জন ‘খুদে মানুষগুলো’ শুধুমাত্র তাদের কথিত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতিবাদ করে গেলেন, আর দায়ী করলেন সেই লোকটিকে, যিনি ছিলেন তাদের দলনেতা, যার প্রতি তারা ছিলেন অনুগত অথচ শেষ পর্যন্ত যিনি কিনা তাদের সাথে করলেন বিশ্বাসঘাতকতা। সেই নাৎসী নেতারা আজ এই নুরেমবার্গ জেলে এবং আমি এরকম একটা স্থানেই তাদের দেখতে চাচ্ছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ বন্দী শিবিরের দোভাষীর স্থানে আমি নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম হলাম এবং বিচার চলাকালীন সময়ে আমাকে বন্দী শিবিরের মনোবিশেষজ্ঞ রুপে নিযুক্ত করা হলো।
আমার প্রধান কাজ ছিল বন্দীদের সাথে প্রত্যহ ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা, তাদের আত্মবিশ্বাসের নৈতিক অবস্থার প্রতি সতর্ক থাকা এবং বিচারের সময় তাদের শৃঙ্খলাবোধ নিশ্চিত করার ব্যাপারে আগে থেকেই তাদের যে কোন ধরণের সাহায্য করা। এছাড়াও বন্দীদের মানসিক পরীক্ষার দরকার পড়লে আমি সাইকিয়াট্রিক কমিশন ও বন্দী শিবিরের মনরোগ বিশেষজ্ঞের সহযোগীতায় আসতাম।
বিচার চলাকালীন সময়ের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দীদের সাথে অবাধ যোগাযোগ রক্ষার সুযোগ আমাকে দেওয়া হয়েছিল, আর এ কারণেই সারা বছরের বন্দীবস্থায় তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া নিরিখের সুযোগ আমার সম্ভব হয়। আর এই সুযোগ লাভের কৌশল হিসেবে আমাকে বেছে নিতে হয় নিতান্তই তাদের সাথে একজন গণসংযোগকারী ব্যক্তির ভূমিকা, যার মধ্য দিয়ে একজন মনোবিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে তাদের সাথে খুব সতর্কভাবে আলাপ-আলোচনা চালাতে হয়েছিল। আর এর ফলাফল বিচার কাজ এগিয়ে নেবার ব্যাপারে অনেকটা বাড়তি চালিকাশক্তি রুপে কাজ করে।
আলাপ করার সময় তাদের সামনে আমি কখনই কাগজে নোট টুকে নেইনি, বরং প্রত্যেকের সেল্ থেকে বের হবার পর অথবা কোর্টরুম বা খাবার ঘর থেকে বের হবার পর তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে আমার আলোচনার নোট গোপনে টুকে রাখতাম। পরে প্রাত্যহিক ডাইরী লিখবার সময় নোটগুলো কাজে লাগাতাম। এই প্রাত্যহিক ডািরী একসময় টাটকা তথ্য বা উপাত্তে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, যার ঐতিহাসিক ও মনোজাগতিক মূল্য হয়তো পরবর্তীতে এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
বন্দী শিবিরে আনার পর বিচারকাজ শুরুর এই মধ্যবর্তী মাসটিতে প্রত্যেক নাৎসী বন্দীদের আলাদা আলাদা সেল্-এ অবরোধ করে রাখা হয়। এই সময়টাকে আমি বন্দীদের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনে ব্যবহার করি, তাদের প্রতিক্রিয়া জানবার চেষ্টা করি এবং এর অন্তর্নিহিত মনোসমীক্ষার তদারকি করি।
আমার এই যোগাযোগ তাদের একাকিত্মবোধ লাঘবে সহায়তা করেছিল, আর আমার জন্য তা ছিল নাৎসী নেতাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় লাভের একটি প্রারম্ভিক পদক্ষেপ। মধ্যবর্তী সময়ের এই সমীক্ষা কালানুক্রম পর্যায়ের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এই সূচনা পর্বে উপস্থাপিত হবে।
প্রতিক্রিয়াঃ
নাৎসী বন্দী হিসেবে তাদের প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমাকে সংক্ষেপে লিখে জানাবার জন্যে আমি তাদের অনুরোধ জানাই। নীচে উদ্ধৃত তাদের স্বতস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ার প্রধান চরিত্রগুলো ফুটে উঠবে।
হেরমান গ্যোরিংঃ Hermann Goering, Reichmarschall der Luftwaffe (Head of Airforce), Reichstag (রাইখসটাগ)-এর সভাপতি, চতুর্থবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
তার সবচেয়ে পছন্দনীয় বিশ্বনিন্দিত উক্তিটি লিখলেন, “বিজয়ী সবসময়ই বিচারকের আসনে বসবে, আর দোষী সাব্যস্ত হবে বিজিতগন”।
ইয়াখিম ফন রিবেনট্রম (Joachim Von Ribbentrom)ঃ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে লিখলেন, “ভুল মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে”। তার সাথে যোগ করলেন, “আমরা প্রত্যেকেই হিটলারের ছায়ার নীচে ছিলাম...”, অবশ্য এ বাক্যটা তিনি মুখেই বললেন।
রুডলফ্ হেস্ (Rudolf Hess)ঃ নাৎসী পার্টি সেক্রেটারী, ইংল্যান্ড হতে ফিরে আসার পর থেকে যার স্মৃতি লোপ পেয়েছিল, ইংরেজীতে শুধু এই শব্দক’টি লিখতে পেরেছিলেন, “আমার কিছুই মনে পড়ছে না”।
এরন্স্ট কাল্টেনব্রুনার (Ernst Kaltenbrunner)ঃ হিমলার-এর প্রতিরক্ষা হেডকোয়ার্টারের প্রধান (গেসটাপো এবং এস ডি সহ), প্রতিবাদ জানালেন, “আমি কোন ধরনের যুদ্ধাপরাধে নিজেকে অপরাধী বোধ করছি না।
একজন গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র এবং হিমলারের অবর্তমানে তার কাজের দায়িত্ব গ্রহণের কথা আমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করি”।
আলফ্রেড রোসেনব্যার্গ (Alfred Rosenberg)ঃ প্রধান নাৎসী দার্শনিক এবং দখলিকৃত পূর্বাঞ্চলের রাইখ মিনিস্টার, তিনিও ঘোষনা করলেন তার সরলতার কথা, “চক্রান্তের কারণে আমার অভিযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা আমি অবশ্যই অস্বীকার করবো, আর ইহুদী বিরোধী আন্দোলনটা ছিল প্রতিরক্ষামূলক”।
হান্স ফ্রাঙ্ক (Hans Frank)ঃ হিটলারের আইনজীবি এবং পরবর্তীতে অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্নর জেনারেল, বন্দীদশায় সম্প্রতি হঠাৎ তার ধর্মীয় চেতনার বিকাশ লাভ করলো, যার প্রতিফলন তার এই উক্তিটিতে, “এই বিচার আমার কাছে ঈশ্বর নির্দেশিত পৃথিবীর আদালত হিসেবে ধরা দিয়েছে, পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা কার্য চলছে এবং এডলফ্ হিটলারের বিভীষিকাময় অত্যাচারের যুগ পেরিয়ে এর সমাপ্তি”।
উইলহেলম্ ফ্রিক (Wilhelm Frick)ঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তার বৈদগ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, “একটি অলীক অসত্য কুটচক্রের উপর ধারনা করে আমাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। ”
ফ্রিটৎ সাউকেল (Fritz Sauckel)ঃ স্লেইভ লেবার রিক্রুটমেন্ট প্রধান, শ্রমিকদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার কোন কারণ তিনি খুঁজে পাননি, “সামাজিক গোষ্ঠীবদ্ধতার আদর্শ এবং কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের ভয়ঙ্কর ঘটনাবলী- এ দু’য়ের বিশাল বৈপরিত্য আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে”।
আলবার্ট স্পিয়ার (Albert Speer)ঃ সমরাস্ত্র ও সামরিক ভান্ডারের রাইখ মিনিস্টার, নাৎসী শাসনের ঘৃণ্য অপরাধের কথা খোলাখুলি ভাবে স্বীকার করলেন, “এই অপরাধের বিচার হওয়া প্রয়োজন। একনায়কতন্ত্রের হাত-পা বাঁধা কর্মচারী হওয়া সত্বেও এই ভয়ঙ্কর অপরাধের ব্যাপারে প্রত্যেকের একটি সাধারণ দায়িত্বজ্ঞান বোধ থাকা প্রয়োজন। ”
ইয়ালমার শাখ্ট (Hjalmar Schacht)ঃ যুদ্ধপূর্ব অর্থমন্ত্রী এবং রাইখব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট, ঘোষনা করলেন, “আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না কেন আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হ’লো”।
ভাল্টার ফুঙ্ক (Walter Funk)ঃ শাখ্ট পরবর্তী অর্থমন্ত্রী, তার প্রতিবাদলিপিটি ছিল বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও আবেগপ্রবণ, “আমি সচেতনভাবে জীবনে এমন কিছু করিনি যা দ্বারা আমাকে অভিযুক্ত করা চলে। ভুল অথবা অজ্ঞতাপ্রসূতভাবে আমি যদি (অভিযোগলিপির আওতায় পরে) কোন অপরাধ করে থাকি, তবে সেটা হবে একটা মানবিক ট্র্যাজেডি, সত্যিকার অর্থে অপরাধ নয়।
”
বারন ফন নয়েরাথ (Baron Von Neurath)ঃ নাৎসী শাসনে প্রথমদিককার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নাৎসী দুঃশাসনের একটি দিক তুলে ধরলেন, “সম্ভাব্য প্রতিরক্ষার কারণ ছাড়া আমি সবসময়ই ‘শাস্তি’-র বিপক্ষে ছিলাম”।
বালডুর ফন শিরাখ (Baldur Von Schirach)ঃ হিটলারের যুব নেতা, দেরীতে হলেও তার উক্তিটি ছিল দৃশ্যতঃ সততাপূর্ণ, “সমস্ত দুঃস্কর্মই ছিল জাতিগত রাজনীতির ঔরসজাত”।
ইয়্যুলিউস স্ট্রাইখার (Julius Streicher)ঃ নাৎসী জার্মানীর এক নম্বর ইহুদী নিধনকারী, Der Strümer পত্রিকার সম্পাদক, যেনবা ঘোর আচ্ছন্নের মধ্যে লিখলেন, “নুরেমবার্গের এই বিচার ইহুদী জাতির জন্য একটি বিজয়”।
ফিল্ড মার্শাল কাইটেল (Field Marshal Keitel)ঃ ভেরমাখ্ট (Wehrmacht) হাই কমান্ডের চীফ অফ স্টাফ, একজন প্রুসিয়ান অফিসারের মতো ব্যক্ত করলেন তার প্রতিক্রিয়া, “একজন সৈন্যের জন্য আদেশ আদেশই!”
***************************************************
নুরেমবার্গ বিচারের প্রায় ৬৬ বছর হতে চললো। তবু কী আশ্চর্যরকম ভাবে মানবতার কলঙ্ক নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের সাথে ৭১ এর বর্বর যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, কামরু, দেলু, সাকা, গো আজমদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়! খুব জানতে ইচ্ছা করে ইন্টারোগেশান সেল্-এ একজন প্রতীকী গুস্তাভ গিলবার্টের কাছে এই নরপশুরা কী রকম আত্মপোলব্ধি লিখিত আকারে পেশ করতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।