আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুজিবাজার: জানুন, বুঝুন, বিনিয়োগ করুন

স্বর্গের খোঁজে

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে অনেকেরই রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রত্যাশাটি প্রকটভাবে কাজ করে। আর তাই না জেনে না বুঝে নিজের কষ্টার্জিত জমানো টাকা কিংবা সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনোয়োগ করেন। তাদের ভাবনা শেয়ারে বিনোয়োগ মানেই কাড়ি কাড়ি লাভ। কারো কারো স্বপ্ন যে পুরণ হয়না তা নয়; তবে অনেকেই তাদের বিনিয়োগ হারিয়ে এক পর্যায়ে নিঃস্ব হয়ে ফেরেন। আর তখন তারা বুঝতে পারেন, তাদের ভুলগুলো।

এরমধ্যে অন্যতম ভুলটিই হয়, তাদের বিনোয়োগ ঠিকমতো হয় না। তাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের আগে যে কোনো বিনিয়োগকারীরই উচিত পুরো বিষয়টি বুঝে নেওয়া। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আগেই জেনে থাকা প্রয়োজন। প্রথমেই জেনে নিন বাজারটির সার্বিক চিত্র। বর্তমানে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা প্রায় ৩৩ লাখ।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) তথ্য মতে, প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ লোক নিয়মিত শেয়ার বেচাকেনা করেন। আর প্রতিটি কার্য দিবসে আড়াই লাখ বিনিয়োগকারী বাজারে সক্রিয় থাকেন। প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার ঘর ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। এ এক বিশাল হিসাবযজ্ঞ। এখান থেকে কেউ লাভ করছেন, কারও আবার বিনিয়োগ করা টাকা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

শেয়ার ব্যবসা কি সবার জন্য? শেয়ার ব্যবসা কি সবার জন্য? বিরাজমান পরিস্থিতিতে এটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইলে কেউ আটকাবে না। তবে এ ব্যবসায় বিনিয়োগ সঠিক হবে কি না, তা আপনাকেই বুঝতে হবে। বর্তমানে দেখা যায়, ন্যূনতম জ্ঞান নেই, এমন অনেক লোক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। কেউ ভাগ্যচক্রে দাও মারেন আর অনেকেই অজ্ঞতা ও অসচেতনার কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।

তাই এটা মনে রাখতে হবে যাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে জ্ঞান আছে, যারা ব্যবসায় ঝুঁকি নিতে পারেন, কেবল এমন পেশাদার শিতি লোকেরই উচিত এখানে বিনিয়োগ করা। বিনিয়োগকারী কারা হতে পারেন? পুঁজিবাজারে সাধারণত দুই ধরনের বিনিয়োগকারী থাকে। এক. ব্যক্তি বিনিয়োগকারী দুই. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অন্য কাজের ফাঁকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। তাদের কেউ চাকরিজীবী, কেউ অন্য ব্যবসা বা পেশায় জড়িত। একদল রয়েছেন শিক্ষিত বেকার, কেউ বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

কেউ কেউ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে রীতিমতো পেশা হিসেবেই নিয়ে নিয়েছেন। তাদের ধ্যান মন, জ্ঞান সবটাই পুঁজি বাজারে। বিনিয়োগ কৌশলটি গুরুত্বপূর্ণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে মুনাফা লাভে বিনিয়োগ কৌশলটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকেও লটারির মতো মনে করেন। এ ভাবনাটি মোটেই সঠিক নয়।

শেয়ার ব্যবসা কোনো লটারির খেলা নয়। এখানে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে হলে কৌশলী হতে হবে। বাজারের গতিধারা বুঝতে হবে। বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক তথ্য যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। তা ঠিকভাবে না করতে পারলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ শেয়ারে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে চাইলে বিনিয়োগ করার সময় একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। মূলধনের টাকাকে খাত অনুযায়ী ভাগ করে নিতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ফলে কোনো একটি বিশেষ খাতের বিনিয়োগ যদি ক্ষতির মধ্যেও পড়ে যায় তা অন্য খাতের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। পুরো মূলধন একটি খাতে বিনিয়োগ করে ফেললে সেই সুযোগটি আর থাকে না। পুঁজিবাজারের খাতগুলো কি? বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সিকিউরিটিকে ২২টি খাতে ভাগ করা হয়েছে।

এগুলো হলো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, প্রকৌশল, খাদ্য ও সমজাতীয় পণ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, করপোরেট বন্ড, ওষুধ ও রসায়ন, কাগজ ও মুদ্রণ, সেবা ও আবাসন, পাট, বস্ত্র, সিমেন্ট, চামড়াশিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি, সিরামিক, পর্যটন, টেলিকমিউনিকেশন, ভ্রমণ ও অবকাশ, ট্রেজারি বন্ড এবং বিবিধ। শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চাইলে হিসাব-নিকাশ করে একাধিক খাতে করতে হবে। শেয়ার ক্যাটাগরি জেনে নিতে হবে পুঁজিবাজারের যেসব কোম্পানির শেয়ার আছে সেগুলোকে আবার এ, বি, এন এবং জেড ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও ১০ শতাংশের ওপর লভ্যাংশ ঘোষণা করা কোম্পনিগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরিতে। এর বাইরে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোও ‘এ’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত।

নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করলেও ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেয় এমন কোম্পনিগুলো পড়ে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। ‘এন’ ক্যাটাগরিভুক্তগুলো হচ্ছে এক বছরের কম সময় আগে নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ার। আর ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় না এবং এজিএমও করে না এমন কোম্পনিগুলো। যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে সাবধানতা মেনে চলেন, তারা সাধারণত ‘বি’ ও ‘জেড’ ক্যাটাগরি কোম্পানিগুলোকে এড়িয়ে চলে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে আরও এ খাতে ব্যবহৃত কিছু টার্ম এর ব্যাপারেও বিনিয়োগকারীকে বুঝতে হবে।

মৌলিক বিশ্লেষণ (ফান্ডামেন্টাল অ্যানালিসিস) মৌলিক বিশ্লেষণ হলো- কোনো কোম্পানির আর্থিক রিপোর্ট বিবেচনা করে শেয়ারের ন্যায্য বাজারমূল্য ও ভবিষ্যৎ অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা। এজন্য বিনিয়োগকারীকে কোম্পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে কোম্পানির ধরন, কোম্পানিটি কোন খাতের পণ্য বা সেবা বিপণন করে, পণ্যের ধরন, বাজারে নামডাক, কোম্পানির গত কয়েক বছরের আর্থিক পরিস্থিতি এবং পণ্যের তুলনামূলক চাহিদা। সার্বিক বাজারের অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর কোম্পানির নিজস্ব দক্ষতা এবং সুনাম সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়াও কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের সম্পর্কেও জেনে নেওয়া ভালো।

পাশাপাশি কোম্পানিটি যে পণ্য বা সেবা বিপণন করে বাজারে তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস একটি কোম্পানি প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছে তাই ওই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস। অর্থাৎ ওই কোম্পানি ওই সময়ে ব্যবসা করে যে মুনাফা করেছে প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডার তা থেকে কত টাকা পাবে তাকেই সংক্ষেপে ইপিএস বলা হয়। লোকসানি কোম্পানির ক্ষেত্রে ইপিএস হবে ঋণাত্বক। তবে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, শেয়ারবাজারে কোম্পানির শেয়ারের দর কত হলো তার সঙ্গে ইপিএসের সম্পর্ক নেই।

কোম্পানিটির মূল ব্যবসা থেকে যে আয় হয় তা থেকেই ইপিএস নির্ধারিত হয়। বর্তমানে তিন মাস পরপর প্রতিটি কোম্পানি ইপিএস ঘোষণা করে। আর বার্ষিক হিসাবের ইপিএসের ভিত্তিতে কোম্পানিটি বছর শেষে লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ফলে যে কোম্পানির ইপিএস যত ভালো সেই কোম্পানির লভ্যাংশের হার তত বেশি হয়। কোম্পানির সারা বছরে অর্জিত মুনাফা থেকে কর পরিশোধের পর যে অর্থ থাকে সেটাই প্রকৃত মুনাফা।

প্রকৃত মুনাফাকে মোট শেয়ার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ইপিএস পাওয়া যায়। যে কোম্পানির ইপিএস যত ভালো সে কোম্পানির শেয়ার কেনা তত নিরাপদ। তবে বাজারে ওই শেয়ারটি আগেই অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে কি নাÑ তা দেখে নিতে হবে। বাজার মূল্য ও আয়ের (পিই) অনুপাত (পিই রেশিও) পিই অনুপাতের পূর্ণ রূপ হলো বাজার মূল্য ও আয়ের অনুপাত (প্রাইস আর্নিং রেশিও)। অর্থাৎ, কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্যের অনুপাত।

ঝুঁকি নির্ণয়ে পিই অনুপাতই সবচেয়ে কার্যকর ও জনপ্রিয় মাপকাঠি। এ অনুপাত যতো বেশি হবে ওই শেয়ার ততো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তুলনামূলকভাবে যেসব কোম্পানির পিই রেশিও ২০-এর নীচে রয়েছে সেগুলোই অধিক নিরাপদ। পিই অনুপাত নির্ণয় করতে হলে শেয়ারের বর্তমান বাজার দরকে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দিয়ে ভাগ করতে হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারী তার ক্রয়কৃত শেয়ারের ভবিষ্যৎ আয় এবং কত লভ্যাংশ আসতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, প্রতিদিন শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দর উঠানামার সঙ্গে সঙ্গে পিই অনুপাতও উঠানামা করে। তাই প্রতিদিনই শেয়ার কেনার আগে ওই কোম্পানির সেদিনকার পিই অনুপাত জেনে নেয়া ভালো। ডিভিডেন্ড কোম্পানির লভ্যাংশের পরিমাণ বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়। এ লভ্যাংশ কখনো স্টক হতে পারে, কখনো নগদও হতে পারে। কোম্পানির নিট লাভ থেকে একটি অংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে দেওয়া হয়।

শেয়ার কেনার আগে তাই আগের বছরের ডিভিডেন্ড পর্যালোচনা করে নেওয়া জরুরি। বুক ভ্যালু বুক ভ্যালু হচ্ছে কোনো কোম্পানির সম্পদের অবচয় এবং সব দেনা পরিশোধের পর শেয়ারপ্রতি সম্পদের পরিমাণ। শেয়ার কেনার আগে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মূল্য কত হতে পারে তার জন্য বুক ভ্যালু কত তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গ্রোথ স্টক আয় হচ্ছে এমন সিকিউরিটিজ বা শেয়ারকে বেছে নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে ওই কোম্পানির শেয়ার থেকে কত টাকা আয় হতে পারে।

পুঁজিবাজারের ভাষায় এটাকে হাই রিটার্ন অব ইক্যুইটি (আরওই) বলে। একজন বিনিয়োগকারী যদি অন্তত ১৫ শতাংশ আরওই-র সম্ভাবনা দেখেন তাহলেই ওই কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারেন। এক্ষেত্রে কোম্পানির পেছনের ইতিহাসটি ভালো করে জেনে নিতে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কোম্পানির মৌলিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে শেয়ার কিনলে শেয়ার ব্যবসায় সফল হওয়ার আশা করা যায়। এজন্য কোম্পানিগুলোর বিগত বছরগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন ও সর্বশেষ খবর জানা থাকা জরুরি।

বাজার সূচক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর দৈনিক বাজার দরের ভিত্তিতে বাজার সূচক তৈরি হয়। সব শেয়ারের মূলসূচক এবং নামিদামি শেয়ারের মূল্যসূচক নামে দুটি সূচক আছে। এছাড়াও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী একটি সাধারণ সূচক রয়েছে। এগুলো নির্দিষ্ট ‘ভিত্তি সূচকের’ ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়। সাধারণত আগের দিনের সবশেষ সূচক এবং বর্তমান বাজার মূলধনের গুণিতক ফলকে বাজার শুরুর মূলধন দিয়ে ভাগ করে সূচক নির্ধারণ করা হয়।

তবে যেভাবেই সূচক নির্ধারিত হোক না কেন দৈনিক বাজার সূচক দিয়ে শেয়ারমূল্য পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ বাজার সূচক বাড়লে বোঝা যায় তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দামই বেড়েছে। আবার বাজার সূচক কমলে দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি নির্দেশ করে। আর এই বাজার সূচক দেখেই কোন দেশের শেয়ারবাজারে কতটা সমৃদ্ধিশালী তাও অনুধাবন করা যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।