আত্মঘাতী রাজনীতির জাতীয়তাবাদী উপাখ্যান
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------------------------------
নতুন বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা সর্বত্র। এর মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, তার দল ক্ষমতায় এলে বর্তমান মহাজোট সরকারের সব সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করা হবে। তার এ বক্তব্য প্রমাণ করেছে, বর্তমান সরকারের সময়ে আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ক্ষতি তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। অবৈধ কাজ ও সিদ্ধান্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় যেগুলো হয়েছিল সেগুলোর কী হবে? এ বিষয়টি খুব সূক্ষ্মভাবে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বেগম জিয়া। ক্ষোভ খালেদা জিয়ার থাকতেই পারে।
কিন্তু সে ক্ষোভ কার বিরুদ্ধে? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে? রাষ্ট্রের জনগণের বিরুদ্ধে?
খালেদা জিয়া গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা প্রায়ই করেন। তিনি 'মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন'র সরকার বলে অভিহিত করে নানা ভর্ৎসনা বাণী দেশবাসীকে মাঝে মাঝে শোনান। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তিনি 'ইয়াজউদ্দিন'র নামটি একবারও নেন না। অথচ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল বেগম জিয়ারই সৃষ্ট। 'যিনি রাষ্ট্রপতি-তিনিই তত্ত্বাবধায়ক প্রধান'- এ তত্ত্ব প্রয়োগ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল হাওয়া ভবন।
সেনা সমর্থিত 'মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন' সরকার কী প্রেক্ষিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, তা দেশবাসীর অজানা নয়। সেই সরকারের অধীনে বেগম জিয়া ও তার জোট নির্বাচনে অংশও নিয়েছিলেন। সেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে জিতেই বেগম জিয়া এমপি হয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়েছেন। সে নির্বাচনকে যদি খালেদা জিয়া অবৈধ মনে করেন, তবে তো তিনি নিজেও অবৈধ এমপি।
বেগম জিয়ার কথাগুলো তো আত্মঘাতীই হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, খালেদা জিয়া কী কথাগুলো বুঝে-শুনে বলছেন? নাকি শুধুই জনগণের আইওয়াশ করতে চাইছেন?
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতি এখন বেশ সংকটাপন্ন। মাত্র ৩০ জনের মতো এমপি নিয়ে তারা সংসদ বর্জন যেমন অব্যাহত রেখেছেন তেমনি পুরো দেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তিও খুব নড়বড়ে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান প্রকৃতপক্ষে আলবদর-রাজাকারদের অনুকূলে। যদিও সম্প্রতি একটি মতবিনিময় সভায় বেগম জিয়া বলেছেন, তারা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেবে।
তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করতে হবে।
এখানে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার, বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। এসব ওয়ার ক্রিমিনালরা কোন রাজনৈতিক দলের, তা জনগণের বিবেচ্য বিষয় নয় মোটেও। বিএনপি প্রকাশ্যে রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে গাঁটছড়া করে রাজনীতি করছে জন্মলগ্ন থেকেই। কারণ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসন জে. জিয়াউর রহমানের মূল লক্ষ্য ছিল 'ডানপন্থি তমদ্দুনের উন্মেষ ঘটিয়ে' তার রাজাসন দীর্ঘস্থায়ী করা।
সে ধারা অব্যাহত রেখেই বেগম জিয়া একাত্তরের দুই আলবদর কমান্ডারকে মন্ত্রিত্ব প্রদান করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছেন, তার একটা স্বপ্ন ছিল এ দেশে রাজাকার মন্ত্রীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়বে! প্রকান্তরে একই চেতনা ধারণ করে চলেছেন জে. জিয়ার উত্তরসূরি রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়াও।
বর্তমান সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, একাত্তরের পরাজিত শক্তির জন্য অশনি সংকেত অবশ্যই ছিল। কিন্তু বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা নেতারা পারেননি, তাদের নেত্রীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত করতে। এটি বেগম জিয়া প্রায়ই বলেন, বিএনপি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।
যদি সেটিই তিনি মনে করেন তবে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সমর্থন তাকে নিতে হবে কেন?
দুই
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে জরিমানা করেছে সিঙ্গাপুরের সরকার। তিনি মিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচারের জন্য এ দ- করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
এরপরও প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে 'ধোয়া তুলসী পাতা' বানাতে ব্যস্ত রয়েছেন দেশের জাতীয়তাবাদী আত্মঘাতী রাজনীতিবিদরা। যারা সুশাসনের জন্য লম্বা লম্বা বুলি আওড়াচ্ছেন, তারাও অবলীলায় এসব দুর্নীতিবাজদের পক্ষাবলম্বন করে মিছিল, সমাবেশ শুরু করেছেন।
বাংলাদেশে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণ নানা ইস্যুতে সরগরম করার চেষ্টা করছেন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। কখনো 'টিআইবি'কে তাসের তুরুপ হিসেবে ব্যবহার করে, কখনো কোন কুখ্যাত রাজাকার পুত্রের পক্ষাবলম্বন করে তারা গোটা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করেই যাচ্ছেন।
টিভি সংবাদে দেখলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন মেডিকেল বিভাগের প্রায় ২০০ ডাক্তার চাকরিচ্যুত হয়ে বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের ভাষ্য থেকেই জানা যাচ্ছে, তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভিন্ন মেডিকেল সেক্টরে চাকরি পেয়েছিলেন।
সরকারি চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপি জোট কেমন স্বেচ্ছাচারিতা করেছিল তা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায়নি।
এটিও দুর্ভাগ্যজনক, বর্তমান সরকারও নিজেদের দলীয় মতাদর্শের ব্যক্তিদের চাকরি দেয়ার জন্য একই পথ অবলম্বন করছে। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে বলেছেন, যারা এ সরকারের সময় চাকরি হারিয়েছেন, তার সরকার ক্ষমতায় গেলে সেসব চাকরি ফেরত দেয়া হবে।
এই যে আদর্শপন্থি রাজনীতির সিঁড়ি, তা 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' কিংবা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' চেতনা ধারা কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণকর নয়। নিউইয়র্কে সম্প্রতি বিএনপির একজন নেতা বলে গিয়েছেন, সরকার যে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার ঘোষণা দিয়েছে তা বাস্তবায়িত হতে ১০ বছর সময় লাগবে। আর বিএনপি সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবে।
তারা 'বঙ্গবন্ধু'র নাম বাদ দিয়ে সেখানে 'জিয়া'র নাম দিয়েই ওই বিমানবন্দরের উদ্বোধন করবেন!
বাংলাদেশে আত্মঘাতী রাজনীতির বীজ এভাবেই অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এটি চাইছেন না। তারা চাইছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এ পর্ব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করুক। আর আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় কোন যুদ্ধাপরাধী যদি পার পেয়ে যায় তবে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেসব আলবদর-রাজাকারদের বিচারও করুক।
কিন্তু কথা হচ্ছে, বিএনপি কি সে পথে হাঁটছে? খালেদা জিয়ার ভাষ্য কী তা প্রমাণ করছে? না, করছে না।
তিনি চাইছেন যে কোনভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া ভন্ডুল হয়ে যাক। আপাতত তার রাজনীতি সে প্রমাণই দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আসলেই তিনি আন্তরিক কিনা তা দেখার জন্য আরও ক'মাস অপেক্ষা করতে হবে।
নিউইয়র্ক , ৫ জানুয়ারি ২০১১
-------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ৭ জানুয়ারি ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি - টনো হর্ভাথ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।