আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলবদরদের বিচার শুরুর ঘটনা ছিল ২০১০ সালের আলোচিত সংবাদ



একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিদায়ী বছরের শুরুর দিকে। এ সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পরিচিত ছয়জনকে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রথম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন গত ২৬ জুলাই মতিউর রহমান নিজামীসহ চারজনের বিরুদ্ধে। এরপর ছয় মাসে ১৩ বার বসেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ সময়ে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তাঁদের একজনের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে কারো বিরুদ্ধেই গঠন করা হয়নি চূড়ান্ত অভিযোগ। গোলাম আযমসহ আরো কয়েকজন চিহ্নিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে বছরজুড়ে চলেছে নানা সমালোচনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে বিলম্বের কারণ কী, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) ও তদন্ত সংস্থা সঠিক পথে এগোচ্ছে কি না, তাদের কাজে সমন্বয় আছে কি না, সরকারই বা কী করতে চায়-এসব প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে।

তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিসেবী, গবেষক, গৃহিণী তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কখনো দেখা গেছে উদ্বেগের ছাপ, কখনো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে হতাশা। আবার যুদ্ধাপরাধীদের কেউ গ্রেপ্তার হলেই উল্লসিত হয়েছে সবাই। তদন্তদল মাঠে নামলেই ১৯৭১ সালে নরপিশাচদের তাণ্ডবের প্রত্যক্ষদর্শীরা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে সাক্ষ্য দিতে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই বছরের ২৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর অধীনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেল নিয়োগ দেওয়ার।

এর পর থেকেই শুরু হয় জাতির অপেক্ষার পালা। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদর-আলশামসের হাতে নির্যাতিত লাখ লাখ মানুষসহ পুরো জাতি আশায় বুক বাঁধে। তারা জীবিত অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের সাজা দেখে যেতে পারার আশায় দিন গুনতে থাকে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠন, তদন্ত দল, আইনজীবী নিয়োগসহ তদন্তকাজে ধীরগতিতে হতাশা দেখা দেয়। বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক বছর পর গত ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৬ ধারা অনুযায়ী গত ২৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সদস্য হিসেবে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদ। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুকে প্রধান করে গঠিত ১২ সদস্যের আইনজীবী প্যানেল এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবদুল মতিনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। দুই মাস পার হওয়ার আগেই জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মতিনের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি পদত্যাগ করেন। শুরুতে আইনজীবী প্যানেলে ১২ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু নানা জটিলতা ও বিতর্কের কারণে নিয়োগ দেওয়া হয় সাতজনকে। এদিকে জামায়াত নেতাদের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করা হয়। গত ২৮ জুলাই ওই রিট আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। অন্যদিকে গত ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটও খারিজ হয়ে যায়। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কাজ শুরু করতেই অনেক দেরি হয়ে যায় তদন্ত সংস্থার।

এরই মধ্যে প্রয়োজন দেখা দেয় আইনে কিছু সংশোধনী আনার। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আইনটি সংশোধনের কাজ শেষ হয়। এরপর শুরু হয় কার্যবিধির জন্য অপেক্ষা। অবশেষে বিধি প্রণয়ন করা হয়। বিধিতে কিছু সংশোধনীও আনা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ২৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেন পুরনো হাইকোর্ট ভবনে। এ ভবনে স্থান সংকুলান না হওয়ায় গত ৪ জুলাই বেইলি রোডে তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবীদের কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। এরপর তদন্তদল মাঠে নামে। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার সদস্যরা ঢাকার মিরপুর এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, পাবনা, শেরপুর, কুমিল্লা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলা সফর করেন। তাতে শীর্ষ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে তথ্য ও সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের চার নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দেন। গত ২৯ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মতিউর রহমান নিজামী, সাভার থেকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং শহীদবাগের বাসা থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই তিনজনকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলার ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আটক রাখার নির্দেশ দেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পল্লবীর আলোকদী গ্রামে গণহত্যার অভিযোগের দায়ের করা মামলায় ১৩ জুলাই হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কামারুজ্জামান এবং আব্দুল কাদের মোল্লাকে।

দুই আগস্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়া অপর চারজনকে হাজির করা হয় ট্রাইব্যুনালে। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের আটক রাখার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে গত ১৬ ডিসেম্বর ভোরে বনানীর এক বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। প্রথমে মগবাজারে গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হলেও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১৯ ডিসেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেন। এ ছাড়া গত ১৫ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাতিলের আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট।

একই সঙ্গে নিজামীর জামিনের আবেদনও খারিজ হয়ে গেছে। ট্রাইব্যুনালের যত নির্দেশ ২৬ জুলাই : প্রথম বসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরয়োনা জারি করা হয়। ২৯ জুলাই : নিজামীসহ চারজনকে ২ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ। ২ আগস্ট : নিজামীসহ চারজনের উপস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেপ্তারের আবেদন। ৪ আগস্ট : নিজামীসহ চারজনের মুক্তির আবেদন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ১০ আগস্ট হাজির করার নির্দেশ। ১০ আগস্ট : সাঈদীকে হাজির না করায় ২৪ আগস্ট হাজির করার জন্য পুনরায় নির্দেশ। ২৪ আগস্ট : সাঈদীকে হাজির না করায় তাঁকে ২১ সেপ্টেম্বর হাজির করার জন্য আবার আদেশ।

২১ সেপ্টেম্বর : সাঈদীকে হাজির করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করে তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন। নিমাজীসহ জামায়াতের চার নেতার মুক্তির আবেদন খারিজ করে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ। সাঈদীকে ২২ সেপ্টেম্বর হাজির করার নির্দেশ। ২২ সেপ্টেম্বর : সাঈদীর উপস্থিতিতে ১২ অক্টোবর তাঁকে আটক রাখা-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানির দিন ধার্য।

১২ অক্টোবর : অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সাঈদীকে হাজির না করায় ২ নভেম্বর প্রয়োজনে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে হাজির করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ। ২ নভেম্বর : সাঈদীকে হাজির করা হয়। তাঁকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটক রাখার নির্দেশ। ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার জন্য তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ। ১৯ ডিসেম্বর : মানবতাবিরোধী অপরাধে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।

একই সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখাতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে হাজির করার নির্দেশ। ২৯ ডিসেম্বর : সাঈদীকে হাজির করা হয়। ১৫ ফেব্র“য়ারির মধ্যে তাঁর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ। ৩০ ডিসেম্বর : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে উপস্থিত করা হয়।

কারাবিধি অনুযায়ী তাঁকে আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ওকালতনামায় স্বাক্ষর করার সুযোগ দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ। কালের কন্ঠ ** ১ জানুয়ারি ২০১১

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.