আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিসরীয় স্ফিংসের শেষ প্রশ্ন

মিসরের পৌরাণিক প্রাণী স্ফিংস আবার চ্যালেঞ্জ করছে: উত্তর দাও, নয়তো ধ্বংস হও। কয়েক সহস্রাব্দ উজিয়ে আবার সে ছুড়ে দিয়েছে কঠিন এক ধাঁধা। বিবদমান দুটি শিবিরই খুঁজছে তার উত্তর। প্রাচীনকালে প্রথম ধাঁধার উত্তর দিয়ে ইদিপাস গ্রিসের রাজা হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ধাঁধার জবাব আজও দেওয়া বাকি।

সেটা এই: এক দেশে দুই বোন ছিল। প্রথম বোন জন্ম দেয় দ্বিতীয়জনকে। বিনিময়ে দ্বিতীয়জন জন্ম দেয় প্রথমজনকে। বল, কারা সেই দুই বোন? মোবারক ব্যর্থ ও পতিত। অনেকে ভেবেছিল মোহাম্মদ মুরসিই বুঝি জানেন মুশকিল আসানির সূত্র।

কিন্তু তিনিও রসাতলে। এবার নাটের গুরু জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির পালা। তিনিও দিন গুনছেন। বিশ্বও ভয় আর আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে কায়রোর দিকে। আরব গণজাগরণের যমজ সন্তান ওই ভয় আর আশা।

ভয় কাটিয়েই আশার জন্ম, আর আশা হারালেই আসে ভয়। মিসরের রাজা-উজির-নাজির-প্রজা সবাই এখন ভয় আর আশার দোলাচলে দুলছে।  বৈপরীত্যই যেন মিসরের নিয়তি। যা ছিল সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের ঘাঁটি, ব্রাদারহুড তাকে টানছে ধর্মবাদী পথে। গামাল আবদেল নাসেরের সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ মিসর থেকে ইরাক, সিরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে জয়ী হয়।

আরবরা আশাবাদী হয়: ফিলিস্তিন মুক্ত হবে, সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। সেনাশাসনে সেই আশা নিভে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যেই মিসর থেকে পশ্চিমা সমর্থনে জয়যাত্রা শুরু হয় মুসলিম ব্রাদারহুডের। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় জয়ী হয়ে বাদবাকি আর ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোয় ব্রাদারহুডের বিরাট খিলান নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দলটি। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রেরও তাতে সায় ছিল।

কিন্তু জয়ের এক বছরের মাথাতেই আশা পরিণত হয় আশঙ্কায়। আমেরিকা-ইসরায়েল আর আইএমএফকে খুশি করে মুরসি চেয়েছিলেন আরেকজন মোবারক হতে। অবশেষে জনগণের চাপে সামরিক বাহিনী তাঁর দিবাস্বপ্ন ভেঙে দেয়। দিতে বাধ্য হয়।  মিসরের উথালপাতাল ঘটনাবলি দেখে একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগছে।

কয়েক মাস পরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমেই যখন ব্রাদারহুডের শাসনের অবসান ঘটানো যেত, তখন কেন সেনাবাহিনী ও পাশ্চাত্যশক্তি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করল? অভ্যুত্থানের ঠিক আগে আগেই যখন পর্দার অন্তরালে মুরসি ও বিরোধীরা অন্তর্বর্তীনির্বাচনের আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখন কেন প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করে সংকটকে গভীর করা হলো? হয়তো এভাবে ছাড়া রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে থাকা (ডিপ স্টেট) সামরিক-বাণিজ্যিক এসটাবলিশমেন্ট নিজেকে বাঁচাতে পারত না। ব্রাদারহুড সরকার আসলে মোবারকের রেখে যাওয়া স্বৈরশাহির গায়ে চড়ানো ইসলামি আলখাল্লা ছাড়া আর কিছু ছিল না। সাবেক শাসকদের অনেকেই নিজ নিজ পদে বহাল থেকে অনাচার চালিয়ে যাচ্ছিল, আর দোষ হচ্ছিল মুরসির। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে পরিপক্ব মিসরীয় জনতা যে অচিরেই আলখাল্লা সরিয়ে তাদের আসল শত্রু সেনা-এসটাবলিশমেন্টের মোকাবিলায় নেমে পড়ত; তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি জেনারেলদের আর তাঁদের মুরব্বি পেন্টাগনের। এ জন্যই তাদের এই প্রি-এম্পটিভ অ্যাটাক, তথা সামরিক অভ্যুত্থান।

এভাবে মুরসিকে সরিয়ে পোশাক বদলে বাঁচবার চেষ্টা করছে মিসরীয় সামরিক-অভিজাততন্ত্র। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে গণতন্ত্রের বর্মটা সরে যাওয়ায় তারা আরও উদোমই হয়ে পড়ল। উদোম হয়েপড়ল তাদের ইসরায়েল-মার্কিন আঁতাত।  বৈপরীত্যের যুগলবন্দীর বিরল নজির এই ঘটনা। যত ভোট পেয়ে মুরসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি মানুষ রাজপথে তাঁর পতন চেয়েছে।

এবং তারা গণতন্ত্র চাইছে না, চাইছে তাদেরই নির্বাচিত সরকারের অপসারণ। মোবারকের আমলে মারা পড়ত ইসলামপন্থী থেকে সেক্যুলার সবাই। মুরসি নির্বাচিত হওয়ার পর শিকার হতে থাকল সেক্যুলাররা। আর এখন সেনা সমর্থিত সরকারের হাতে গণহত্যার শিকার হচ্ছে ইসলামপন্থী কর্মীরা— তারা বন্দী মুরসিকে প্রেসিডেন্টের পদে ফিরে পেতে মরিয়া।  আরব জাগরণ যেন রোমান দেবতা জানুসের মতো দুই মুখ নিয়ে জন্মেছে।

এর এক মুখ অতীতের সামরিক শাসনের দিকে বাড়ানো, অন্য মুখটা স্বাধীন ও সচ্ছল ভবিষ্যতে আগানো। জানুসের এক মুখ হলো শেষের প্রতীক, অন্য মুখটা নতুন আরম্ভের। মিসরে এখন শেষ আর শুরুর যুগল মহড়া চলছে।  বৈপরীত্যের এখানেই শেষ নয়। আরব জাগরণের এক মুখে গণ-আন্দোলন (মিসর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেন ও তুরস্ক), অন্য মুখে গৃহযুদ্ধ (লিবিয়া ও সিরিয়া)।

ইতিহাসে গণ-অভ্যুত্থান আর (গৃহ) যুদ্ধ যেন ঝড়-বৃষ্টির মতো সহগামী। গত শতকের প্রতিটি বিপ্লবই জন্ম দিয়েছিল গৃহযুদ্ধের। ভারতীয় উপমহাদেশসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার স্বাধীনতাসংগ্রামগুলোও গণ-আন্দোলন ও গণযুদ্ধ অথবা দাঙ্গায় গড়িয়েছিল। এদের সবাইকেই ইউরো-মার্কিন থাবা ওপড়াতে হয়েছিল। মিসর থেকে সিরিয়া হয়ে ইরাক, ইরান, লেবানন ও ফিলিস্তিন আবারও গৃহযুদ্ধ আর ইউরো-মার্কিন-ইসরায়েলি হুমকির মুখে।

 মিসরে বিপরীতমুখী এই শক্তিগুলোর হিসাবটা দেখে নেওয়া যাক। শীর্ষে আছে সামরিক অভিজাত ও তাদের সহযোগী প্রশাসনিক ও বিচারিক আমলাতন্ত্র এবং ব্যবসায়ী শ্রেণী। এদের মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের পরে আছে ক্ষমতা অভিলাষী মধ্যপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড ও চরমপন্থী আল-কায়েদা ও সালাফি গোষ্ঠী—যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, সৌদি আরব এদের মদদদাতা। ভেতর ও বাইরের এই বাধা ডিঙানোর ওপরই নির্ভর করছে আরব জাগরণের সত্যিকার সাফল্য।

‘ডিপ স্টেট’ ও তাদের ডিপ পলিটিকসের বাইরে জড়ো হয়েছে শহুরে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত তরুণ, বামপন্থী ও শ্রমিকশ্রেণীর দুর্বল এক সংহতি। এরাই আরব জাগরণের জ্বালানি ও ইঞ্জিন হলেও সংগঠনের অভাবে এরা নিজেরা ক্ষমতায় যেতে অসমর্থ। এই সুযোগটাই নিচ্ছে মিসরের সেনাবাহিনী ও তাদের বিদেশি মুরুব্বিরা।
ইরাক যুদ্ধকে জর্জ বুশ নয়া মধ্যপ্রাচ্যের প্রসব বেদনা বলেছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর বারাক ওবামা কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতায় বলেছিলেন, মিসর থেকেই নতুন আরব জমানা শুরু হবে।

রক্ত আর অশ্রুর ধারাপাতে সেই ‘নতুনের’ স্বাদ পাচ্ছে বৃহত্তর আরব দুনিয়া। নাসেরের যুগে আরবরা ধর্ম, সম্প্রদায়, গোত্র ও আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে অসাম্প্রদায়িক নিখিল আরব ‘ন্যাশন’ হয়ে উঠতে চেয়েছিল। আরব জাগরণ আবার সেই স্বপ্নকে ফিরিয়েএনেছে। একে বিপথগামী করতেই পুরোনো শাসকেরা চাঙা করছে শিয়া-সুন্নি, আরব-কুর্দ, মুসলিম-খ্রিষ্টান বিরোধ। আরবের তেলসম্পদ দখলে রাখা, ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব টেকানো এবং ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে হলে আরবকে বিভক্ত ও দিশাহীন রাখাই আমেরিকার ইচ্ছা।

কিন্তু দিনের শেষে মিসরীয় বিক্ষোভকারীরা মুরসি আর আমেরিকাকে সমানভাবে বিরোধিতা করছে। তাই ভাবার কারণ নেই যে জনতার অ্যাকশন এখানেই শেষ। যে মিসরীয়রা ইসলামপন্থীদের দেখেছে, তাদের সামনে এখন মার্কিন সমর্থিত সামরিক-বাণিজ্যিক এসটাবলিশমিন্ট মোকাবিলার কাজ। মিসরে যদি তারা জয়ীহয়, তবে সমগ্র আরবেও তা প্রভাব ফেলবে।
গত দুই শতকে আরবের যাবতীয় পরিবর্তনের সূচনা মিসর থেকেই ঘটেছে।

পরিবর্তনের এই ঢেউ কত দূর বয়ে যাবে, তা-ই মিসরীয় স্ফিংসের তৃতীয় ও চূড়ান্ত প্রশ্ন। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, ফৌজি রাজ মিসরের শেষ কথা নয়।  আরবই এখন বর্তমান আধিপত্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার সবচেয়ে নাজুক গ্রন্থি। এই গ্রন্থি খুলতে পারাই আরব জাগরণেরও আশা, পৃথিবীরও আশা। তুর্কি গণজাগরণের পর এই আশার সংবাদ দিয়েছেন এ যুগের ফরাসি দার্শনিক আলা বাদিউ।

তুর্কি তরুণদের উদ্দেশে তিনি যা বলেছেন তা মিসরীয় তরুণদের জন্যও প্রযোজ্য: ‘প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, আমাদের বিরাট উপকার হবে যদি তোমরা প্রমাণ করতে পার যে এই জাগরণ তোমাদের আমাদের থেকে ভিন্ন এক গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে। যে বৈষয়িক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির অসুখে পুরোনো দেশগুলো ভুগছে, তোমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে তা অসম্ভব হয়ে যাবে...। আমাদের মতো হতে চাইলে তোমরা মস্ত ভুল করবে। তোমাদের অঞ্চলই এখন মহান ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সৃজনের আদর্শভূমি। তোমরাই পারো আমাদের অবাক করে দিতে।

’ আর তা করতে হলেতাহরির আর নাসর সিটির মাঝখানে নতুন রাজনীতির নতুন ময়দান খুঁজে পেতে হবে মিসরীয়দের। দুই বিপরীত মেরুর কোনো একটি সমাধান নয়, সমাধান রয়েছেমাঝখানে কোথাও, আর সেটাই আরব জাগরণের এগোবার রাস্তা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@gmail.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।