শহিদুল ইসলাম : বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে ফাটল ধরাতে সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশ পরিচালনায় মহাজোট সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতাকে ঢাকতে সর্বক্ষেত্রেই তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানোর অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে টিআইবিকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করতে কসুর করেনি। তারাও নাকি যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিচার বিভাগকে দুর্নীতির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। টিআইবির মত প্রতিষ্ঠানকেও সরকার তাদের প্রতিপক্ষ বানানোর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তাদের কার্যক্রমের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই।
জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিরোধী শিবিরে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার আগেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে পড়তে শুরু করেছে। তাই দিশেহারা হয়ে এখন যারাই তাদের সমালোচনা করছে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জড়িয়ে প্রতিপক্ষ বিবেচনায় আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে টিআইবিকে আক্রমণ করে এটা ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে কলংকিত করা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে টিআইবি বিচার বিভাগকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে তথ্য প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, আগামী ২ মাসের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন কামরুল ইসলাম।
একই অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, টিআইবি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে মনে হয়েছে তারাও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য তৎপর রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার দেয়া হয়েছে। আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হবে এবং সেটা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আরেকটি বড় উপহার।
যদিও চীনপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। বরং মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের ক্ষমতার লড়াই বলে উপহাস করেছিল। তারপরও বিশেষ টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রীত্বের মসনদ প্রাপ্ত দিলীপ বড়ুয়ার কথায়ও স্পষ্ট হয়েছে যে সরকার সবকিছুতেই একটি জুজুর ভয় করছে। তাদের বোধ হয় পায়ের তলায় একেবারেই মাটি নেই। এজন্য একই অনুষ্ঠানে দু'জন মন্ত্রী একই ভাষায় টিআইবির মত প্রতিষ্ঠানকেও অভিযুক্ত করেছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার টিআইবি তাদের জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো বিচার বিভাগ। টিআইবি পরিচালিত জরিপে ৮৮% মতামত দিয়েছে বিচার বিভাগের দুর্নীতির পক্ষে। এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে দেখিয়েছে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী বা পুলিশকে। এই টিআইবি ২০০১ সালে সবচেয়ে সাড়া জাগানো রিপোর্ট প্রকাশ করে সারাবিশ্বের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে। ঐ বছর (আওয়ামী শাসনের শেষ বছর) সারাবিশ্বে পরিচালিত তথ্যে দেখা যায়- বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।
আর এটা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, নেতা, উপনেতা, পাতি নেতাসহ সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তারের কারণে। বিশ্বে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের সেই শীর্ষস্থানের কলংক আরো ২ বছর বয়ে বেড়াতে হয়েছিল দেশকে। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকারের সময় দুর্নীতির শীর্ষস্থান থেকে বাংলাদেশ পেছনে আসতে সক্ষম হয়। আবার কেয়ারটেকার সরকারের দুই বছরে অবস্থার আবারো অবনতি ঘটে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকারও দুর্নীতির সেই অবস্থান থেকে উন্নতি লাভ করতে পারেনি।
সর্বশেষ টিআইবি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা একেবারেই ভিকটিমদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক তথ্য সমৃদ্ধ। অথচ সেই রিপোর্টকেও আওয়ামী মহাজোট সরকার বিরোধী দলের সাথে যুক্ত করে দেয়ায় মনে হতে পারে যে, তারা বালখিল্যতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর মধ্যেই তাদের ভেতরের খবর বেরিয়ে এসেছে। থলের বিড়াল হয়তো এভাবেই বের হয়ে আসে আপন নিয়মে।
ইতোপূর্বে বিএনপি হরতাল করেছে জনগণের দাবি দাওয়াকে সামনে নিয়ে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ-পানির সংকটসহ নানা ইস্যু ছিল হরতাল পালনের পক্ষে। অথচ ঐ সময়ই সরকারের মন্ত্রী ও নেতা-নেতৃরা বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তারা হরতাল ডেকেছে। কোন কোন মন্ত্রী আরো স্পষ্ট করে তখন বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতেই বিএনপি হরতাল ডেকেছে এবং হরতালের মাধ্যমে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ওলামা মাশায়েখ পরিষদ আজ রোববার সারাদেশে হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়।
তাদের দাবি ছিল- সরকার ঘোষিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল, ইমামদের সামনে মার্কিন মুল্লুক থেকে ভাড়া করে আনা নারীদের নিয়ে নগ্ন ব্যালে ড্যান্সের আয়োজনকারী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির বহিষ্কার এবং ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের দাবিতে। এই হরতাল নিয়েও সরকারের মন্ত্রীরা মন্তব্য করেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতেই ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের নামে হরতাল ডাকা হয়েছে। এমনকি এই পরিষদের আহবায়ক প্রবীণ আলেমে দ্বীন মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকেও যুদ্ধাপরাধী বলতে দ্বিধা করেনি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আর নেতাকর্মীরা। এভাবে ওলামা মাশায়েখদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে এবং বিরোধী রাজনৈতিক জোটে ফাটল ধরাতে এখন যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে সরকার। সরকার চায় তাদের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোট বা তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন ঐক্য না হয়।
একই সাথে তাদের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আলেম সমাজও যেন ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম তৈরি করতে না পারে, এজন্য বর্তমানে সরকারের হাতে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।