_
“যত মাথা তত ব্যথা” – প্রবাদটার ভাবার্থে যাব না, আক্ষরিক অর্থে আসি।
একটি সাধারন পাটিগণিত দিয়ে শুরু করি। মাথার “সংখ্যা বাড়লে যদি “ব্যথাও” বেড়ে যায়, তাহলে মাথার “আকার” বাড়লেও “ব্যথা” বেড়ে যাওয়ার কথা। সমানুপাতিকের গুণাবলী মেনে সেই “ব্যথা” আবার কমেও যাওয়ার কথা মাথার “আকার” কমে যাওয়ার সাথে সাথেই। এর ব্যতিক্রমটাই আমার আলোচ্য বিষয়।
আগেই বলে নেই, এই জাতীয় ব্যাপার নিয়ে কাগজ এবং কলমের কালি (মতান্তরে আজকালকার ভার্চুয়াল মেমরি) আগেও কম খরচ হয় নাই। কাজেই, অনেকেই যে পড়তে গিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকাতে পারেন, সে কথা মাথায় রেখেই লিখছি।
খবরটা আপনারাও নিশ্চয়ই জানেন। আর কোনো প্রাইমারী/হাই স্কুলে “ভর্তি যুদ্ধ” অনুষ্ঠিত হবে না। ইতোমধ্যে তা কার্যকরও হয়ে গেছে।
হাফপ্যান্ট/ফ্রক পড়ে টুকটুক করে এলাকাময় ঘুরে বেড়ানো ঐসব “ছোট ছোট মাথার” অধিকারীদের জন্য (আমরা যারা তাদের বড় ভাই/বোন, তাদের জন্যও) এই সংবাদটা যে কত “বড় একটা ব্যথা” পাগলা মলমের মত উপশম করল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি নিজেও এ জাতীয় এক অসুস্থ প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে আমার স্কুল জীবন শুরু করেছিলাম এবং তখন থেকে শুরু করে টানা দশটা বছর আমি এই “ভর্তি যুদ্ধের” ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখে এসেছি। প্রথম ৩/৪ বছর হয়তো কিছু বুঝি নাই, কিন্তু পরের ৬/৭ বছর তো ঠিকই টের পেয়েছি। আমার স্কুল জীবনের শেষ দুই বছর নিতান্ত কৌতূহলের বশে আমি নিয়ম করে ভর্তি পরীক্ষার দিন আমার স্কুলের চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে আসতাম। খুব চেষ্টা করতাম বাইরে যেসব অভিভাবক বসে থাকতেন তাদের মুখের দিকে তাকাতে; আমি বোধহয় খানিকটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির, তাই তাকাতেও পারতাম।
কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। সেটা কারো পক্ষেই সম্ভব না।
অভিভাবকদের মাথা আকারে বড়, ব্যথা তো বেশি হবেই। তাই বলে ভাববেন না পরীক্ষার হলে যারা কাগজ আর কলম নিয়ে রীতিমত “কারবালা কারবালা” খেলছে, তাদের মাথা ছোট ছোট বলে ব্যথাও কম। প্রত্যাশার চাপ কি শুধু টেন্ডুলকারের উপরেই থাকে, তাদের উপরে থাকে না?
# বাবা-মার প্রত্যাশার চাপ
# কাড়ি কাড়ি টাকা হস্তগত করা শিক্ষকদের “গরম চক্ষু”র চাপ
# “বড় ভাই-বোন এই স্কুলে পড়েছিল, আমাকেও পড়তে হবে” জাতীয় চাপ
# খালা-মামা-চাচা-ফুপু কি বাদ?
# জ্ঞানের সৌখিন বাথটাবে সাঁতার কাটার ব্যাপারটাতো বাদই দিলাম
যারা পড়াশোনায় একটু অমনযোগী, তাদের কে চকলেট-বার্গার কিংবা হালের পোকেমন-ডিজিমন আরোও কতকিছুর লোভ দেখানো! আমি ছোটবেলা থেকেই খুব খেলা পাগল ছিলাম।
বাসার আশে পাশে কোনো মাঠও ছিল না। আমার বাবা-মার মাথায় আমার চেয়েও বেশি বুদ্ধি – তারা আমাকে একদিন স্কুলটার মাঠ দেখাতে নিয়ে গেল! বলতে দ্বিধা নাই, টোপটা সেদিন আমি সত্যিই গিলেছিলাম! আহা, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি! এই আলোচনা বাদ!
কাজেই, আমি যখন শুনলাম ভর্তি পরীক্ষার অপসংস্কৃতি তুলে দেওয়া হচ্ছে, বলাই বাহুল্য, আমি যার পর নাই রকমের খুশি হয়ে গেলাম। অনেক ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমাদের মত পিচ্চিপাচ্চাদের এই যন্ত্রণা দান থেকে মুক্তির জন্য মুখ দিয়ে ফেনা তুলে আসছেন। আর এখন তো শিক্ষানীতির প্রায় সবকিছুই স্যারের হাত ধরে আসছে। কাজেই স্যারকে আমি মনে মনে দুইটা ধন্যবাদ দিয়েও ফেললাম।
ঠিক যখন তিন নম্বর ধন্যবাদটা দিতে যাবো, তখন শুনি “ভর্তি পরীক্ষা”র বিকল্প হিসেবে লটারী করে ছাত্র ভর্তি করা হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কি জাফর স্যার জানেন?” উত্তর আসল “হ্যাঁ”।
আমি একজন “অতি বিশ্বাসী” মানুষ। যে যা বলে তাই চোখ কান বন্ধ করে বিশ্বাস করি। “অতি বিশ্বাসী”র মাত্রা বোঝানোর জন্য একটা ছোট গল্প বলি।
গল্পটা অবশ্যই নিজেকে নিয়ে না।
৬/৭ বছরের এক ছেলে অতি জরুরী কাজে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে তার খালার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে। পথে এক কিম্ভুতকিমাকার পেত্নী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,
“কে তুমি?”
“ওঁরেঁ, তুঁই দেঁখতেঁ পাঁচ্ছিঁস নাঁ রেঁ, আঁমিঁ পেঁত্নীঁ রেঁ!”
এমন ভয়ংকরদর্শন পেত্নী দেখেও ছেলেটা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“ও আচ্ছা।
দেখি, একটু সরো তো, যেতে দাও আমাকে। “
পেত্নীটা যেন রীতিমত আকাশ থেকে পড়ল! বলল,
“কীঁরেঁ, তুঁই ভঁয়ঁ পাঁচ্ছিঁসঁ নাঁ রেঁ? আঁমিঁ পেঁত্নীঁ রেঁ!”
“ভয়! ভয় পাবো কেন? মা বলেছে রাস্তায় যদি ভুত দেখি, তাহলে যেন এক দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই। তুমি তো আর ভুত না, তোমাকে ভয় পাবো কেন? ভুত নাকি খুবই ভয়ংকর এক জিনিস! তুমিও কিন্তু সাবধানে থেকো। “
পেত্নী যেন কিছুটা হতাশ হল। ভয় দেখানোই যেহেতু তার কাজ, এক্ষেত্রে তো আর ব্যর্থ হলে চলে না! তাই সে এবার বলল,
“ঠিকঁ আঁছেঁ, যাঁহ! আঁমিঁই সেঁই ভুঁত, পেঁত্নীঁ নাঁ!”
এই কথা শুনেও ছেলেটার মুখে ভয়ের কোনো ছাপ পড়ল না।
পেত্নী দ্বিগুন হতাশা নিয়ে বলল,
“কীঁরেঁ, তুঁই এঁখঁনঁও ভঁয়ঁ পাঁচ্ছিঁস নাঁ কেঁন রেঁ?”
ছেলেটা নিজের বুকে একটা চাপড় দিয়ে বলল, “কারন আমি জানি তুমি ভুতও না। মা বলেছিল বটগাছটার নিচ দিয়ে যেন না যাই, বট গাছে ভুত থাকে। তাই তো আমি এই শ্যাওড়া গাছের নিচ দিয়ে আসলাম। মা তো শ্যাওড়া গাছের কথা কিছু বলে নাই। তাহলে তোমাকে ভয় পাওয়ার কী আছে?”
আমি গল্পের এই ছোট ছেলেটার মতই “অতিবিশ্বাসী”।
ছেলেটাতো তাও তার মায়ের কথা বিশ্বাস করেছিল, আমি সবার কথাই দাড়ি-কমা সহ বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি যত বিশ্বাসীই হই, লটারী করে ভর্তির বুদ্ধিটা স্যারের মাথা থেকে বের হয়েছে - এই কথা আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস করতেও চাই না। কোনো সন্দেহ নাই ব্যাপারটার পেছনে অনেক মহৎ এক উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু উপশম হিসেবে যেই ওষুধকে বেছে নেওয়া হল, সেই ওষুধকে যদি আমি “বিষ” বলি, কেউ কি দ্বিমত করতে পারবে? এর চেয়ে কোচিং সেন্টার কালচারটা বন্ধ করাই কি শ্রেয়তর ছিল না? হোক সেটা যতই কষ্টসাধ্য কাজ।
একটা স্বপ্ন কখনই একটা “ক্রীড়া উন্নয়ন লটারী”র টিকেট না যে ১০ টাকা দিয়ে কিনলাম, মিলল না, ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। আমি বলছি না যে সব বাচ্চারই “আহা, আমি যদি অমুক স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম” জাতীয় স্বপ্ন থাকে। কারো না কারো তো থাকেই রে ভাই। স্বপ্নের পেছনের কারন সবার জন্যই যে এক হবে, সেটা বলছি না। আমার এক বন্ধুর আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ছিল কারন তার বাবাও এই একই স্কুলে পড়েছিলেন।
আমার স্বপ্নের কারন ছিল স্কুলের বিশাল বড় মাঠ (আক্ষরিক অর্থেই বিশাল!)। আমার ছোট ভাইটা যে এখন এই স্কুলে পড়ছে তার পেছনের স্বপ্ন ছিল “আমি আর আমার বড় ভাই একসাথে স্কুলে যাব”। এরকম সবারই কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকেই – হোক সেটা যতই খাপছাড়া।
আমরা মনে করছি, “থাক না, এতটুকু একটা বাচ্চা আর লটারীর ব্যাপার কী বুঝবে। বুঝতে বুঝতে সে তার স্কুল জীবন পার করে দিবে।
“ ব্যাপারটা আসলে মোটেই এমন না। আমি আমার কথা বলতে পারি। কম তো আর বড় হলাম না! এখনও পর্যন্ত যে সব স্মৃতি একদম দাড়ি কমা সহ মনে পড়ে তার মধ্যে প্রায় সবই সেই পিচ্চিকালের স্মৃতি – বেশিরভাগই দুঃসহ টাইপের স্মৃতি। কার সাথে দৌড় প্রতিযোগীতায় অল্পের জন্য পারি নাই, কীভাবে একদিন রাস্তায় হারিয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আবার ঠিকই অবচেতন মনে বাসায় ফিরে আসলাম! (মজার ব্যাপার হল, বাসায় ফিরে এসেও আমি কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে বলছিলাম, আমি হারিয়ে গেছি!) কে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ড্রেনের পানিতে ফেলে দিয়েছিল, কে আমার সাথে ভয়াবহ এক মিথ্যা কথা বলেছিল (আজকালকার যুগ হিসেবে ছোট মিথ্যা!) যার জন্য রাগে দুঃখে তাকে তারচেয়েও ভয়াবহ অভিশাপ দিতে পিছপা হই নাই (এখন যদিও ভাবলে হাসিই পায়!)
বাচ্চাকালের স্মৃতি ভোলা চারটিখানি কথা না। আর সেই স্মৃতি যদি স্বপ্নভঙ্গের হয় তাহলে তো কথাই নাই! “দাগ তোলায় টেন অন টেন” সার্ফ এক্সেল দিয়েও সেই দাগ তোলা সম্ভব না।
(লাগবা বাজি?) আমি জানি না কোনো মানবাধিকার কর্মী আমার এই লেখাটা পড়ছেন কিনা, (প্লিজ পড়বেন না) স্বপ্নভঙ্গ যেহেতু মানবাধিকার (ব্যাপারটাকে শিশু অধিকার জাতীয় কোনো একটা শব্দ দিয়ে আখ্যায়িত করা হয়, আমার ভাল জানা নাই) লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে যায়, সেহেতু এক্ষেত্রে মানবাধিকার কীভাবে কোথায় লঙ্ঘন হচ্ছে আশা করি আপনারা বুঝতে পারছেন। যেই বাচ্চাটার মনে সত্যিই সেরকম কোনো স্বপ্ন আছে, তার স্বপ্নপুরণের সামান্য সুযোগ কি রাখা উচিৎ ছিল না? ভাইভার ব্যবস্থা থাকার দিকে আঙুল তাক করে অনেকেই ব্যাপারটাকে স্বপ্নপুরণের সুযোগ রাখার কথা বলছে। কিন্তু এই একই ব্যাপার কত বড় একটা হীন প্রকৃতির ব্যাবসার ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে সেটা কি কেউ জানে না?
সব কথার শেষ কথা : “যত মাথা তত ব্যথা”। ছোট ছোট মাথায় ব্যথার বোঝা আর বাড়াবেন না। আপনাদের মত “বড়” মাথার লোকেরাই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার মত ব্যথা বইতে পারছেন না, তারা কীভাবে পারবে, বলুন?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।