প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট বিজ্ঞানের সাদৃশ্য- বৈসাদৃশ্য
বিজ্ঞানের ডিজিটাল উন্নতির সাথে সাথে মানুষ তার প্রকৃত অবস্থাকে সহজভাবে বুঝার সহায়ক অনেক পথ হাতের মুঠোয় পেয়েছে। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই দয়া করে মানুষের আমলনামাটা কি ধরণের বিষয়? তা আমাকে একটা বৈজ্ঞানিক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিন। তখন আপনি ভিডিও ফাইল এর সাথে তুলনা করে তাকে তা অতি সহজেই বুঝাতে পারবেন। একবার আমি একজন কারী সাহেবের উপস্থাপিত নূরাণী পদ্ধতিতে পবিত্র কুরআন শরীফ এর কারিয়ানা ট্রেনিং কোর্সের প্রায় এক ঘন্টার প্রোগ্রাম ক্যামেরায় ধারণ করেছিলাম। প্রায় দুবছর পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
আমি প্রায় প্রায়ই তাঁর সেই ভিডিও ফাইলটি ওপেন করে দেখি এবং ভাবি; কারী সাহেব দ্বারা তখন যা কিছু প্রদর্শিত হয়েছিলো এখন দেখছি ঠিক তারই হুবুহু চলমান প্রতিচ্ছবি। যাকে আমরা বলতে পারি তাৎক্ষনিক আমলনামা।
আমরা যদি মানুষ হয়ে ভিডিওতে আমাদের চাক্ষুষ আমলনামা অন্তত: কিছু সময়ের জন্য হলেও ধারণ করে তা সংরক্ষণ করতে পারি তবে মহান আল্লাহপাক কেন তা পারবেন না? মহান আল্লাহপাক, আমাদের আমলনামা লিপিবদ্ধ করার জন্য দুজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। যারা আমাদের কৃতকর্মসমূহ লিখে রাখেন। এতে করে আমাদের জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে কৃত কর্মকান্ডের ভিডিওগুলো আমাদের চর্ম চক্ষুর অগোচরে প্রতিনিয়ত রেকর্ড হয়ে থাকছে।
যা আমরা বর্তমানে দেখতে না পেলেও হাশরের ময়দানে যখন দেখার সময় হবে তখন ঠিকই মহান আল্লাহপাকের তরফ থেকে দেখতে পাবো। মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত আমালনামার রেকর্ড করার পদ্ধতির সাথে আমরা আমাদেরই সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ভিডিওগ্রাফী তথা কম্পিউটারাইজড্ মাল্টিমিডিয়া ফরমেটের সাথে মিল খুঁজে পাই।
কম্পিউটারের হার্ডওয়ার আর সফট্ওয়্যার এর কথা চিন্তা করলে আমরা
আমাদের দেহ ও প্রাণের কথা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারি। মাটি দিয়ে গড়া রক্ত- মাংসের দেহে অদৃশ্য প্রাণের উপস্থিতি আছে বলেই আজো আমাদের দেহ জীবন্ত। নতুবা লাশ নামে পরিচিত হতে আর কতক্ষণ।
ভাবলে অবাক হতে হয়, মানুষ কিভাবে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার এর মাঝে সফট্ওয়্যার এর উপস্থিতি ঘটায়ে পুরো সিস্টেমটাকে জীবন্ত করে তুলেছে?
কম্পিউটার এর হার্ডওয়্যারকে যদি মানবদেহ ভাবি আর সফটওয়্যারকে যদি ভাবি মানুষের প্রাণ তবে উপলব্ধি করা যায় কম্পিউটারের সাথে একজন জীবন্ত মানুষের কত সুন্দর এক অদ্ভুত মিল। এতে করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনে মানুষ যেমন নিজেকে সঠিক ভাবে বুঝতে ও চিনতে পারছে; তেমন ভাবে সে তার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাকের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসী হয়ে উঠার পক্ষে যথেষ্ট উপমা খুঁজে পাচ্ছে।
কার্টুনিষ্টদের করা এমিনেশন ভিডিওগুলো দেখলে মনে হয় যেন একবারে জীবন্ত জীবজন্তুর গতিবিধি উপস্থাপিত হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ফরমেটে। কিন্তু যতই জীবন্ত মনে হোক না কেন পার্থক্য মূলত এক জাগাতেই। মানুষ আল্লাহর দেয়া ক্ষমতায় অনেক কিছু পারলেও কেবল একটি জিনিসই কোনদিন করতে পারে নাই এবং পারবেও না।
আর এই অসাধ্য বিষয়টি হলো: মহান আল্লাহর মতো করে রক্ত মাংসের দেহ তৈরি এবং তাতে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো। মানুষ যদিও মাটি বা রাবার দিয়ে মানুষের দেহের মডেল তৈরি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের দেহে বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে কিন্তু মৃত দেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে চিরদিনই ব্যর্থ।
বুদ্ধিমান বৈজ্ঞানিকরা অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আসলে আমরা যে যতই কথা বলিনা কেন মহান আল্লাহপাক যে ক্ষমতা মানুষকে দেন নাই। মানুষ তার দেয়া ক্ষমতা বা ইচ্ছার বাইরে কোন কিছুই করার
ক্ষমতা রাখে না। মহান আল্লাহর মতো প্রাকৃতিক ভাবে কোন কিছু হুকুম দিয়ে সৃষ্টি করতে পারে না।
বিপরীতে মহান আল্লাহপাক সবই পারেন। মানুষের যাবতীয় পারা আর না পারার ব্যাকগ্রাউন্ডে ( নেপথ্যে) মহান আল্লাহপাকের ভুমিকা আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাই না বটে কিন্তু তিনি আছেন। যিনি এক এবং অদ্বিতীয়। যার কোন শরীক নাই। যিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা।
মহাবিশ্বের সবকিছু একই নিয়মে চলছে। চাঁদ, সূর্য একই নিয়মে নিত্যদিন উঠছে এবং ডুবছে। সুতরাং একাধিক প্রতিনিধিত্ব থাকলে কর্তৃত্বের লড়াই এর ফলে ফিকশন বা দ্বন্ধ সৃষ্টি হতো। মহাবিশ্বে ক্ষমতার দ্বন্ধে সর্বদা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করতো। এতে করে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।
তার কোন শরীক নেই। তার ক্ষমতা অসীম আর আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আমাদের এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতাও মহান আল্লাহপাকের একান্ত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
এই এক এবং অদ্বিতীয় মহান আল্লাহপাক এই দুনিয়ার অগণিত মানুষকে কিভাবে চালাচ্ছেন বা সর্বক্ষণ আমাদের দিকে কিভাবে তাঁর স্বকীয় দৃষ্টি অক্ষুন্ন রাখছেন? লক্ষ্য করলে দেখবেন, একই নেটওয়ার্কের আওতায় অসংখ্য কম্পিউটার বা মোবাইলের সাথে একই সময়ে বহুবিধ কাজ এবং যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। সেরূপ মহান আল্লাহপাকের দ্বারা একই সময়ে পৃথিবীর সব মানুষের খবর নেয়া সম্ভব হচ্ছে।
মহান আল্লাহপাকের অসীম ক্ষমতাকে সহজভাবে বুঝার জন্য মানব সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত উদাহরণের প্রয়োজন খুবই সীমিত। আসল প্রয়োজন হলো: সে ধরণের মন-মানসিকতা এবং অন্তরের অনুধাবণ ক্ষমতা। মহান আল্লাহপাকের দ্বারা যে সবই সম্ভব তা আমাদের বুঝে আসুক বা না আসুক বিনা শর্তে মেনে নেয়াই হলো প্রকৃত ঈমাদারের কাজ। এখানে যুক্তি তর্কের কোন অবকাশ নেই।
এখন আমরা কি ভাবে বুঝবো যে; আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাক এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন? এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বুঝগুলো উৎসুক মানুষকে আস্তিকতার পক্ষে রায় দেয়।
১. এই মহাবিশ্বের সবকিছুই কত সাজানো গুছানো। তাহলে এই সাজানো গুছানো মহাবিশ্ব একা একাই সৃষ্টি হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর নেপথ্যে কারো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর তিনিই হলেন মহান আল্লাহপাক । ২. মহান আল্লাহপাক আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য।
সুতরাং পরীক্ষা ক্ষেত্রে সবকিছুই যে অতি সহজে বুঝে আসবে এমন নয়। বিষয়টা বুঝার জন্য কুরআন-হাদীস ভিত্তিক জ্ঞান, বিবেক ও সময়ের প্রয়োজন। সুতরাং পরীক্ষাকে মেনে নিয়ে তাতে পাশ করার চেষ্টা করে যাওয়াই হলো সত্যিকারের বুদ্ধিমানের কাজ। ৩. পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা সিজদাতে এসেছে- আল্লাহই তিনি যিনি মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে--।
আমরা বিবেক সম্পন্ন মানুষ খুবই কৌতুহল প্রিয় বিধায় সত্যকে নানা দৃষ্টিকোন থেকে বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক ভাবে জানতে ও বুঝতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে থাকি।
বিশেষ করে যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ দ্বিনী জ্ঞান সম্পন্ন আলেম নই তাদের ভেতরেই এই কৌতুহলটি বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়। কুরআন-হাদীস বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান চর্চার অভাবই মানুষকে এই মানসিকতার দিকে ধাবিত করে থাকে।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ পরিবেশগত কারণেই বেশির ভাগ সময় দুনিয়াবী জ্ঞান অর্থাৎ মানব মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞানকেই লালন করে থাকে। ফলে, তারা প্রকৃত সত্য অর্থাৎ মহান আল্লাহপাকের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিকে মানব মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান দিয়ে যাচাই করে উপলব্ধি করতে চায়। এ ক্ষেত্রে মানব সৃষ্ট বিজ্ঞানের সাথে আল্লাহ সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তুলনামূলক মিল বা অমিল মানুষের হিদায়াতের পথ প্রশস্ত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
তবে তা তখনই সম্ভব হয়ে উঠে যখন ব্যক্তি তার অন্তরের নিয়্যাত বা কামনা কে প্রকৃতপক্ষেই সত্যতে জানার প্রচেষ্টায় মহান আল্লাহপাকের কাছে আকাঙ্খা করে থাকে।
মানব সৃষ্ট বিজ্ঞানকে যদি ভালো কাজে লাগানো যায় তবে তা মানবিক আবেদন রক্ষা করতে সক্ষম বিপরীতে তাকে যদি মানবতা বিরোধী কাজে লাগানো হয় তবে তা মানব জাতির জন্য অভিশাপ হয়ে দ্বারায়। যেমন ধরুন একই ছুরি নামক অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসীরা মানুষকে ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায় আবার সার্জনরা সেই একই ছুরি নামক অস্ত্র দিয়েই অপরেশন করে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে ভূমিকা রাখেন।
আমরা যদি সত্যি সত্যি প্রকৃত সত্যের বিরোধিতা অন্তরে পুষে না রেখে প্রকৃত পক্ষেই সত্যকে জানার উদ্দেশ্যে মানব সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাথে আল্লাহ সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তুলনামূলক বিচার করতে চাই; তবে আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো আসলে আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনা। আমরা যা কিছু পারি তা তো মহান আল্লাহপাকের দেয়া ক্ষমতা বলে।
আমাদের সৃষ্ট যাবতীয় প্রযুক্তির সমস্ত উপাদানই মহান আল্লাহপাকের কাছ থেকে ধার নেয়া।
মহান আল্লাহপাক আমাদের যে অসীম প্রাকৃতিক বিজ্ঞানময় বিষয়াবলী দান করেছেন তা মহান আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য অশেষ নেয়ামত এবং বিশেষ রহমত। যদিও দুনিয়ার ধোকায় পড়ে আমাদের চলমান জীবনে আমরা তা খুব একটা ভেবে দেখিনা এবং দেখার প্রচেষ্টা চালাই না। এই দুনিয়াতে আমরা ইচ্ছা করলেই কি সব কিছু করতে পারি? না তা পারি না। আমাদের সব কাজ কর্মের মাঝেই রয়েছে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা।
আমরা নিত্যদিনই ২৪ ঘন্টা বায়ূমন্ডল হতে অক্সিজেন গ্রহন করি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করি । এটা হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত জ্ঞান। এতে আমাদের কোন টাকা-পয়সা খরচ হয় না। আবার দেখুন, আল্লাহ না করুন, কোন কারণবশত: শ্বাস-প্রশ্বাস এর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অল্প একটু বাঁধাগ্রস্থ হলে কৃত্রিম অক্সিজেন প্রয়োগে আমরা সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও বিষয়টা কত ঝামেলাযুক্ত, পেরেশানী আর
কত টাকা পয়সা খরচ। এ ছাড়াও এতে রয়েছে কত দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা।
মানব সৃষ্ট বিজ্ঞান আমাদের জীবনের মানকে উন্নত করলেও এর ভিত্তি কিন্তু আল্লাহ সৃষ্ট বিজ্ঞান অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। মানুষের ব্রেণ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের যাবতীয় উপাদান মহান আল্লাহপাকেরই দান। বিজ্ঞানীদের অবদানটুকু হলো শুধু পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে মানব জাতির কল্যাণ সাধন। এই পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতাও মহান আল্লাহপাকেরই অশেষ দান। ।
* হাকীম আল-মীযানের রূহানী মেথডের একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ। লেখার তাং-২২-১২-২০১০ঈ:। লেখকের বিনা অনুমতিতে অন্যত্র কপি, পেষ্ট নিষিদ্ধ। কারো কাছে ভালো লাগলে শুধুমাত্র সামহোয়্যার এর লিংক দিলে লেখকের কোন অভিযোগ নেই। লেখাটিতে চিন্তা ও ভাষাগত কোন ভুল - ত্রুটি থাকলে তা জানালে শুধরিয়ে দেয়া হবে -ইনশাআল্লাহ।
সবার কাছে দোয়ার দরখাস্ত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।