সত্যানুসন্ধিৎসু
১৯৭১ সালের ১০-১৬ ডিসেম্বর - মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিনগুলিতে ৭ ও ৮ নম্বর সেক্টরে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াই চলেছে খুলনা, যশোহর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি ও পাবনায়। এসব যুদ্ধে উভয়পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও অগণিত সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ডিফেন্স দেয়ার জন্য পাকিস্তান আর্মির ৯ম ডিভিশন তৎসহ ২৯তম ক্যাভালরির একটি স্কোয়াড্রন নিয়োজিত ছিল যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর শের-উর রহমান ও কোম্পানী কমান্ডার মেজর জাহিদ (১৮ পাঞ্জাব)। এই পর্যায়ে কুষ্টিয়ায় যুদ্ধরত পাক আর্মির ৫৭তম ব্রিগেডটি যুদ্ধ না করে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ হয়ে নাটোরে অবস্থিত তাদের ১৬তম ডিভিশন অঞ্চলে পালিয়ে যাবার ফন্দি আটঁছিল। নির্দেশ ছিল রাজাকাররা যেন সে সময় তাদেরকে সাপোর্ট দিতে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হয়।
কিন্তু কুষ্টিয়ার কোনো যুদ্ধেই ৯ম ডিভিশনের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরকে দেখা যায় নি। বরং তখন কুষ্টিয়ায় মেজর জাহিদের ইন্ফ্যান্ট্রি
কোম্পানীর একটি এ্যাম্বুশকে নিরাপদ আশ্রয় বিবেচনায় সেখানেই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। ওই এ্যাম্বুশটি ছিল কুষ্টিয়া শহর থেকে উঁচু বাঁধের পাশ দিয়ে ভেড়ামারা-পাকশী অভিমুখী সড়কে যার দু’ধারে ফাঁকা জায়গা, কোথাও কোথাও কিছু কিছু গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি যার আড়ালে ছিল শের-উর রহমানের দু’টি ট্যাংক-ট্রুপ আর জাহিদের কোম্পানীর পদাতিক সৈন্যদের অবস্থান। তার দুই দিকেই নরম মাঠ, সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংকবহর কষ্ট করে হলেও পৌঁছাতে সক্ষম। বেলা ২টার দিকে দু’টি ট্যাংকবহরসহ ভারতীয় বাহিনী কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়।
তখন ভারতীয় বাহিনীর ২ করপ্স কমান্ডার লে.জেনারেল টি.এন. রায়না, ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল এম.এস. ব্রার, তাঁদের জিওসি ৪ মাউন্টেন ডিভিশন দলবলসহ একটি হেলিকপ্টারে করে উড়ে এসে নামেন এবং সৈন্যদের সেখানে বৃথা সময় নষ্ট না করে শত্রুর দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। এসময় মুক্তিবাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সেনা তাদের অনুগামী হয়। কিন্তু শত্রু তো ছিল কাছেই। তাদের ৬টি ট্যাংক ও ২২তম রাজপুত কোম্পানীর সৈন্যরা এ্যাম্বুশের মধ্যে এসে পড়ামাত্র গর্জে ওঠে পাকিস্তানিদের M-24 Chafee হালকা (২৯তম ক্যাভালরি) ট্যাংক।
ওই যুদ্ধে ২২তম রাজপুত কোম্পানীর প্রায় সবাই হতাহত হন আর ৬টি পিটি-৭৬ ট্যাংকের মধ্যে মাত্র একটি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে; অপরদিকে পাকবাহিনীর ২টি Chafee ট্যাংক ধ্বংস হয়।
মিত্রবাহিনীর ৭ম ব্রিগেডের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন মেজর গুরুচরনের কমাণ্ডের অধিনে কুষ্টিয়া শহরের অদূরবর্তী একটি ক্যানালের ধারে পজিশন নেয়। পাকবাহিনীর ট্যাংকবহর সেখানেও আক্রমন চালায় এবং ক্যানালের ওপর অবস্থিত ব্রীজটি উড়িয়ে দিয়ে ৯ ও ১০ ডিসেম্বর নিজেরা পাকশীর দিকে সরে আসতে থাকে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংক, কামান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্র অকেজো করে পথেই ফেলে দেয়। পরের ৩-৪ দিন ১০-১৪ ডিসেম্বর এসব পাকিসেনারা শুধুমাত্র হাতে বহনযোগ্য হালকা অস্ত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে ঈশ্বরদী পর্যন্ত পৌঁছতে সারা পথ জুড়ে মুক্তিবাহিনীর এ্যাম্বুশ ও মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড বিমান হামলার শিকারে পরিণত হয় আর খুব কম সংখ্যকই প্রাণে রক্ষা পায়।
ওদিকে করপ্স কমান্ডারের নির্দেশে ফরিদপুর অভিমুখী ৪ মাউন্টেন ডিভিশনকে যাত্রা স্থগিত করে তার এক ব্যাটালিয়ন মধুমতি রেখে ডিভিশনের বাকি সৈন্যকে (দু’টি পদাতিক ব্রিগেড) কুষ্টিয়ার দখল নিতে এবং পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিয়ন্ত্রণ নিতে বলেন। এ লক্ষ্যে ৯ম ডিভিশন থেকে আরো ৪৫ ক্যাভালরির দু’টি ট্যাংক-ট্রুপ কুষ্টিয়ার ‘এ’ স্কোয়াড্রনের শুন্যস্থান পুরণে পাঠানো হয়।
এ লক্ষ্যে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর দু’দিন ধরে কুষ্টিয়ায় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করা হয়। এ সময়ের মধ্যে পাকবাহিনীর শেষ অংশটিও কুষ্টিয়া থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ অতিক্রম করে পাকশীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
১৪ ডিসেম্বর ভোর থেকে পাকশী-ঈশ্বরদী রোডের উভয়পাশের খানা-খন্দক, ঝোপ-ঝাড়, গাছ-পালা ও ঘর-বাড়ির আড়ালে এ্যাম্বুশ করে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পলায়নপর পাকবাহিনীর অন্তত একটি কোম্পানীর পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঈশ্বরদী অঞ্চলের প্রায় ৫ শ মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পাকবাহিনী ভেড়ামারার দিক থেকে আগত যৌথ বাহিনীর আগমন ও পদ্মানদী পারাপার ঠেকাতে ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রীজের অংশবিশেষ উড়িয়ে দেয় - যেভাবে এর আগে তারা ভৈরব ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছিল।
। ফলে উত্তর-দক্ষিণ যোগাযোগ অকস্মাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এই পথে যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবেই শেষদিকে পাকবাহিনীর ৯ম ডিভিশনের অবশিষ্ট সৈন্যরা ঈশ্বরদীতে এসে ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আলহাজ্ব ট্রেক্সটাইল মিলস্ এলাকায় জড়ো হয়। ১৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ঈশ্বরদীতে প্রবেশের প্রাক্কালেও শহর ও আশে-পাশের এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এসময় পাকবাহিনী থেকে বিতাড়িত শতাধিক রাজাকার পালাতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনীতে নিহত হয়।
কুষ্টিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানি অনেক সেনানায়কের লেখায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। এমন কি তখন ঢাকায় অবস্থিত পাক-জার্ণালিস্ট সিদ্দিক সালিকও এব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে কুষ্টিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, ওই যুদ্ধই পূর্বপাকিস্তানে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের গোটা ব্রিগেডের একমাত্র যুদ্ধ। জেনারেল মঞ্জুর পরে পাকবাহিনীতে তিরস্কৃত হন এই বলে যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নামাজ পড়াকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন, যুদ্ধকে নয়। ডিভিশন কমান্ডার মে.জে.আনসারির বেলাতেও তাই, সন্মুখ সমরে নেমে যা করা দরকার ছিল তার কিছুই তিনি করেন নি বা করতে পারেন নি। অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা কমান্ডার লে.জেনারেল টি.এন. রায়না পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সি.এন.সি হন।
প্রকৃতপক্ষে সেদিন পাকবাহিনীর যুদ্ধ করার মত যথেষ্ট মনোবল ছিল না, তাছাড়া মিত্রবাহিনীর তুলনায় তাদের সমরশক্তিও ছিল অপ্রতুল, আকাশপথের সাপোর্টও তারা হারিয়েছিল ক'দিন আগেই। তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, সামনে অগ্রসর হওয়ার অর্থ বরং মৃত্যুকেই বেছে নেয়া।
ছবি পরিচিত:
উপরে - লে.জে. টি.এন.রায়না (বামে) ও মে.জে.আনসারি (ডানে)।
মাঝে - যথাক্রমে ব্রি.জে. এম এস ব্রার, কুষ্টিয়ায় বিধ্বস্ত একটি পাকিস্তানি ট্যাংক, ঈশ্বরদী-পাকশী অঞ্চলে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টু।
নিচে - পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্র:
- Fierce battles in Kushtia and Ashuganj
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সূত্র:
- 1 9 7 1 W a r - Tank Ambush at Kushtia : Squadron and Company Commander Dislocate a Corps Commander!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।