আগুন নিভেছে কিন্তু লাশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত লাশের প্রকাশিত সংখ্যা ৩১। আগুনে পোড়া লাশ, ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে মরা লাশ, লাফিয়ে পড়ে মরা লাশ। তা বাড়ুক। এ আর নতুন কি।
এগুলোতো উচ্ছৃংখল গার্মেন্টস শ্রমিকের লাশ , এদের মৃত্যুতে কি যায় আসে? বছর বছর এরকম অগ্নিকান্ড না ঘটলে তো নাগরিকেরা বৈদেশিক মুদ্রা উতপাদনের কারখানার উত্তাপটুকু টের পাবেনা! আজকে হামীম গার্মেন্টস এ লেগেছে, এর আগে গরীব এন্ড গরীব গার্মেন্টস এ লেগেছিল, তারও আগে কেটিএসএ। এরকম লাগেই, লাগতেই থাকে। মন্দ কি, শাপে বর হিসাবে গরীব পরিবারগুলো তো ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুটো কাচা পয়সার মুখ দেখবে।
আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বহুতল ওই কারখানা ভবনে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে স্থানীয়রা জানায়।
গত বছরের জুন মাসে একই স্থানে এ প্রতিষ্ঠানের আরেকটি কারখানায় আগুন লাগে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি একে আজাদ হা-মীম গ্র"পের কর্ণধার। আগুনে পুড়ে ও লাফিয়ে পড়ে আহত শতাধিক শ্রমিক রাজধানী ঢাকা ও সাভারের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে শতাধিক শ্রমিক এখনো কারখানার ভিতরে আটকা রয়েছে বলে দাবি করছেন শ্রমিকরা। তাদের আশংকা নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
মনে আছে, এর আগে এবছরই ২৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে "গরীব এন্ড গরীব" গার্মেন্টেস এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ঘোষণা শুনে নিহতদের একজন জরিনা বেগমের ছেলে মো.জুয়েল বিলাপ করে উঠেছিলেন-
“এক লাখ টাকা দাম দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো আমার মায়ের।
বোনের লাশের দামও এক লাখ। আর লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবে আরও ১৫ হাজার করে। গরিব গার্মেন্টসে কাজ করে আমার মা আর বোন যে এখন অনেক বড়লোক হয়ে গেছে!"
আমরা জানিনা গরীব এন্ড গরীব গার্মেন্টস এর লাশেরা বড়লোক হতে পেরেছিলো কি-না, তবে হামীম গামের্ন্টস উতপাদিত লাশের ভাগ্যেও ইতোমধ্যেই জুটে গেছে ২ লক্ষ টাকার প্রতিশ্রুতি। বিজিএমইএ'র সভাপতি সালাম মুর্শেদী সাংবাদিকদের বলেছেন, আগুনের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের জন্য এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া লাশ পৌঁছানোর জন্য আরো ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
তিনি আরো জানান, হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের জন্য আরো এক লাখ টাকা ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
(বিস্তারিত খবর: বিডি নিউজ২৪ Click This Link
বাঙলানিউজ ২৪ Click This Link)
আহা! কি শ্রমিক দরদী আমাদের বিজিএমই, কি শ্রমিক কল্যাণী হামিম গার্মেন্টস!
কিছু পুরানো গান আমরা আবার শুনবো। যথাযথ ক্ষতিপূরণের আশ্বাস, সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার "গভীর শোক" প্রকাশ, মালিকদের প্রতি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে "প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের আহবান" এবং আহতদের "যথাযথ" চিকিৎসার ব্যাবস্থার নির্দেশ ইত্যাদি ঘুমাপাড়ানি গান কি আমরা আগে শুনিনাই?
অথচ হামীম গামেন্টস এ অগ্নিকান্ডের এই ঘটনাটি এরকম আরো অসংখ্য ঘটনার মতোই নিছক দুর্ঘটনা নয়- মালিক, কারখানা পরিদর্শন বিভাগ ও সরকারের অবহেলায় ঘটা হত্যাকান্ড। ইতিপূর্বেও একই ভাবে আগুনে শ্রমিক নিহত হয়েছে। প্রতিবারই বের হয়েছে কারখানা ভবনের ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন, যথাযথ অগ্নী নির্বাপন ব্যাবস্থা না থাকা, নিয়মিত ফায়ার ড্রিল না হওয়া, আগুন লাগার সময় কারখানা গেট বন্ধ থাকা ইত্যাদি কারণেই এইরকম ঘটনাগুলো ঘটছে।
এভাবে রাষ্ট্রের অবহেলায় বিভিন্ন সময় ভবন ধ্বসে ও অগ্নিকান্ডে গার্মেন্টসেক্টরেই ১৫০০'র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার। তারা পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বেচে আছে। কিন্তু এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকদের আজ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি।
কলকারখানায় পণ্যের পাশাপাশি বিষাক্ত বর্জ্য উৎপাদনের মতোই আগুনে পুড়ে কিংবা ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শ্রমিকের লাশ হওয়াটা আমাদের কাছে ইতিমধ্যেই খুব স্বাভাবিক ঘটনার মতো হয়ে গেছে এবং সেই সাথে বোধহয় "নেসেসারি ইভিল" হয়ে উঠেছে- কারখানায় পণ্য উৎপাদন করতে চাইলে যেমন বর্জ্য উৎপাদন অবশ্যম্ভাবি! ভাবটা এমন, যেন কারখানা থাকলে, হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে চাইলে এই সব একটু আধটু তো সইতে হবেই! ফায়ার এলার্ম সিস্টেম নাই তো কি হয়েছে- ধোয়ার গন্ধ তো আছে- কুত্তার মতো শুকে শুকেই তো শ্রমিক বুঝতে পারে আগুন লেগেছে, এর জন্য "আমাদের" ঘাম ঝরানো পয়সা খরচ করে ফায়ার এলার্ম সিস্টেম রাখার কি দরকার! প্রতি ফ্লোরে কলাপসিবল গেট তালাবদ্ধ থাকে? তালাবদ্ধ থাকবে না তো কি সদর-ঘাট বানিয়ে রাখতে হবে যেন শ্রমিকরা ইচ্ছামত বাইরে আসা যাওয়া করতে পারে, গার্মেন্টস পণ্য বাইরে পাচার করতে পারে! গেটের দারোয়ান? দারোয়ানদের কি আর বিশ্বাস করা যায়, ওরাও তো শ্রমিকদের মতোই হাড় হাভাতে।
দুইটাকার শ্রমিক যার নূন্যতম বেতন মাত্র ৩০০০ টাকা(তাও সেটা পাওয়ার জন্য তাকে রক্ত ঝরাতে হয়), সে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আনুক আর যাই করুক, সে তো শেষ বিচারে শ্রমিকই, এলিট শ্রেণীর তো কেউ না! তাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারার অপরাধে দোষ স্বীকার করেও মাত্র ১,৫০০ টাকা জারিমানা দিয়ে ছাড়া পায় মালিক পক্ষ! ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারিতে চট্টগ্রামের কেটিএস গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে সরকারী হিসেবেই ৫৪ জন গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার ২মাস পর মেজিষ্ট্রেট কোর্টে এই হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করলেও রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে ঠিক ঠাক অভিযোগ দাখিল না করার কারণে কারখানার দুই পরিচালক এবং এক ম্যানেজারকে জনপ্রতি ১,৫০০ টাকা করে অর্থাৎ সর্বমোট ৪,৫০০ টাকা জরিমানা করে বেকসুর খালাশ দেয়া হয় (সূত্র: ডেইলিস্টার, মার্চ ১, ২০১০)।
আগুনে পুড়িয়ে শ্রমিক হত্যা প্রতিরোধ করার জন্য কি করা হয়েছে বা হচ্ছে? নতুন আইন তো দূরের কথা প্রচলিত আইন মানার ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে ফ্যাকটরি অর্ডিন্যান্সকে আপগ্রেড করা এবং তা বাস্তবায়ন করার কোন পদক্ষেপই তো দেখছি না। যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরী করা হয়েছে কি-না, কারখানায় যথাযথ অগ্নিনির্বাপন ব্যাবস্থা আছে কি-না, ফায়ার এক্সিট আছে কি-না, থাকলে সেটা সবসময় খোলা থাকে কি-না, নিয়মিত ফায়ার ড্রিল হয় কি-না ইত্যাদি সাধারণ রুটিন মূলক কাজগুলো নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর দিয়ে নিয়মিত ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের ব্যাবস্থা করা এবং এসব ব্যাবস্থা না থাকলে মালিকপক্ষকে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা ইত্যাদির ব্যাপারে রাষ্ট্রের তো কোন মাথা ব্যাথা দেখি না।
মালিক শ্রেনী নিশ্চিন্তে থাকুন কারো কোন শাস্তি হবে না, বিচার হবে না, প্রতিরোধ হবে না-কারণ আপনারা তো স্বাধীন, আপনাদের জন্য নিশ্চিন্তে শোষণ, লুটপাট, খুন আর আগুনে পোড়ানোর স্বাধীনতা এনে দিতেই তো এই বিজয়ের মাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।