"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫
মালয়শিয়ার স্মৃতি... [পর্ব-১] এখানে
মালয়শিয়ার স্মৃতি... [পর্ব-২] এখানে
মালয়শিয়ার স্মৃতি... [পর্ব-৩] এখানে
পরের দিন সকালে উঠেই আমরা লাংকাউই এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
এক ধরনের বড় স্পিড বোটে বা সি ট্রাকে করে রওনা হলাম। আগের দিনই টিকেট কেটে রেখেছিলাম। পেনাং থেকে ভাড়া ৪৫ রিংগিত। জলযানটি বেশ ভাল গতিতে চলে। আর ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং বসার ব্যবস্থা খুবই আরামদায়ক।
সব মিলিয়ে ওই সমুদ্র ভ্রমনটা বেশ উপভোগ্য ছিল।
দুই আড়াই ঘন্টায় আমরা লাংকাউই পৌছে গেলাম। কুয়াহ বন্দরে নামলেই হাতের বামে আপনার চোখে পড়বে একটা বিশাল ঈগল পাখির মূর্তি। বেশ সুন্দর। এটার কিছু ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে সম্ভবত, আগ্রহীরা গুগল মামার সাহায্য নিতে পারেন।
লাংকাউইর কুয়াহ বন্দরে ঢুকে খুব ভাল লাগল। ভেতরে ডিউটি ফ্রি শপ আছে, আর যেই জাক জমক, একেবারে এয়ারপোর্টের মত মনে হয়। আপনার ইম্প্রেশনই ভাল হয়ে যাবে। বের হয়েই দালালদের খপ্পরে পড়ে গেলাম। ওখান থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে দিলাম।
আমাদের সাথে এরিকসন বাংলাদেশের দুজন ভাইয়া ছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন কানাডিয়ান পাসপোর্টধারী অভিবাসী। তো ওনার কানাডিয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। লাংকাউইতে ইচ্ছে করলে গাড়ী ভাড়া করে নেয়া যায়, ড্রাইভিং ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে। তো আমরা তাই করলাম, একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে নিলাম দু’দিনের জন্য।
এরপর আমরা আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথের নির্দেশনা দেখে দেখে চলে এলাম হোটেলে। আমাদের হোটেলটি মোটামুটি জনপ্রিয় কিছু বিচের পাশেই ছিল এবং সেটা ছিল আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এর আশে পাশেই। আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড হল একটা বড় একুরিয়াম যেখানে মিঠা ও নোনা পানির জলজ প্রাণীরা রয়েছে। এটা পান্তাই সেনাং বিচে অবস্থিত, মানে আমরাও আসলে এই বিচের আশে পাশেই ছিলাম।
এখানে প্রায় ৫০০০ এর উপরে জলজ প্রজাতি প্রায় ১০০ এর বেশী ট্যাংকে রাখা আছে। এখানে একটা বড় ট্যাংক আছে যার মধ্যে ১৫ মিটার লম্বা একটা সুড়ংগ করে দেয়া আছে, যাতে আপনি সেখানে গেলে একেবারে সমুদ্রের তলদেশে আছেন এমন একটা অনুভূতি পাবেন। আর সেই একুরিয়ামে দানবাকৃতির কিছু মাছও রেখেছে। আরো আছে অনেক সুন্দর সুন্দর সামদ্রিক প্রাণী এবং জীবন্ত প্রবাল ! সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা সংগ্রহ। ওখানে একটা থিয়েটার হল ও আছে যেখানে সংস্লিষ্ট বিষয়ের উপর ছোট প্রামাণ্য চিত্রও দেখানো হয়।
বলা বাহুল্য, হোটেলে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা প্রথমেই আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এই ঢু মারি। কিছু ছবি আপনাদের জন্য পেশ করলাম।
এরপর বিকেলে একটু বিচের জলে ঝাপাঝাপি করলাম। যদিও আমাদের কক্সবাজারের মত মজা পাওয়ার কোন উপায় নেই। এখানকার বিচগুলো ছোট হওয়াতে ঢেউ তেমন নেই, তাই মোটামুটি শান্ত বিচ।
এরপর আবার মেঘ কালো করে বৃষ্টি এল, বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রে গোসল করতে ভালই লাগল।
পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। আজই শেষ দিন লাংকাউইতে। বিকেলেই এই দ্বীপ ছাড়তে হবে। প্রথম গন্তব্য লাংকাউইর সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান, কেবল কার ! এটা আমার জীবনে চড়া সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং সেরা কেবল কার।
জনপ্রতি ২৫ রিঙ্গিত ভাড়া নেবে। কিন্তু টাকা দেয়াটা স্বার্থক। এই কেবল কারটির বিশেষত্ব হল, এটি খুব খাড়াভাবে উঠে গেছে এবং একটা সিংগেল কেবলে সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কেবল আছে এখানে, মানে দুটো স্টেশনের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ একক কেবল আছে এই কেবল কার সিস্টেমে। যাইহোক, আপনি যখন খাড়াভাবে উপরে উঠে যাবেন, সেই অনুভূতি খুবই রোমাঞ্চকর !! আমার বন্ধু পত্নীতো বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন !! এই কেবল কারটি আপনাকে নিয়ে যাবে Mount Mat Cincang এর চূড়ায় আর সেখান থেকে আপনি পুরো দ্বীপেরই একটি ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ পাবেন। কেবল কার সিস্টেমে দুটো ল্যান্ডিং স্টেশন আছে।
ল্যান্ডিং স্টেশন দুটো চমৎকার, অনেকটা স্পেস শীপের মত করে বানিয়েছে।
শেষ ল্যান্ডিং স্টেশনের পাশেই ওরা একটা অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীর স্কাই ব্রিজ বানিয়েছে যেটা কিনা দাঁড়িয়ে আছে মাত্র একটি পায়ের উপর !!
এক কথায় পুরো পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর যে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। চূড়া থেকে আপনি একপাশে পাবেন সমুদ্রের ভিউ (আন্দামান সাগর), এক দিকে পাহাড়ের ভিউ আর কেবল কার চলার পথেই আপনি একপাশে একটা ঝর্ণার ভিউ পাবেন। লাংকাউই কিন্তু থাইল্যান্ডের একেবারেই সিমান্তবর্তী একটি দ্বীপ, তাই এখান থেকে আপনি থাইল্যান্ডের দ্বীপ এবং একটি প্রদেশের কোস্টাল লাইনও দেখতে পাবেন।
ওহ, আর একটা কথা বলে রাখি, শাহরুখ খানের অভিনীত “ডন” সিনেমার শেষ দৃশ্য এই কেবল কারের শেষ ল্যান্ডিং স্টেশন ও স্কাই ব্রিজেই ধারণ করা হয়েছিল!!!
অসাধারণ কিছু অনুভূতি নিয়ে কেবল কার ছেড়ে আমরা খোজা শুরু করলাম দ্বীপে আর কি কি দেখা যায়।
কুমিরের খামার আমাদের তালিকায় ছিল, কিন্তু পথ চিনতে না পারায় সেটা ছেড়ে আমরা গাড়ী নিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথে ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ বলে এক জায়গায় থামলাম, যদিও তেমন আকর্ষনীয় কিছু বলে মনে হল না। আরো এগিয়ে সাপের পার্কে গেলাম। হরেক রকম সাপ দেখে মুগ্ধ হলাম।
কি সুন্দর একটা সাপ...
এর পর রাজার বাড়ি টাইপের একটা জায়গায়ও গেলাম, বিস্তারিত মনে পড়ছে না।
দ্বীপ ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। হোটেলে ফিরে এলাম। আবার কুয়াহ জেটি, গাড়ী জমা দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পড়ন্ত বিকেলে আবার এক অসাধারণ সমুদ্র যাত্রা, আসলেই অসাধারণ !!
আমরা ফিরেছিলাম আবার পেনাং হয়েই কুয়ালালামপুর। তবে আপনারা যদি কুয়ালা পারলিস হয়ে এখানে আসেন সেক্ষেত্রে আপনাদের সমুদ্র যাত্রার সময়টা কমে যাবে, খরচও বেশ কমবে।
আমার তখন না জানার কারণে আবার পেনাং হয়েই ফিরেছি। আরেকটা কথা, যদি লাংকাউই যান, আর কিছু না দেখলেও অবশ্যই কেবল কারটা দেখে আসবেন, আপনার ট্যুরের পয়সা উসুল!! এ ব্যাপারে আমার এক ফুফুর ঘটনা বলি, উনার স্বামী মালয়শিয়ার এক ভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল। সেই সুবাদের ওনারা বেশ কয়েক বছর মালয়শিয়াতে ছিল। ওনারাও একবার লাংকাউই গিয়েছিলেন, কিন্তু মজার ব্যাপার হল অনেক জায়গায় ঘুরলেও, কেবল কারেই যান নি। যুক্তিটা হল, “আমরাতো কেবল কার গেন্টিং এই দেখেছি, তাই আর যাইনি।
“ মনে মনে ভাবলাম, মক্কার লোক হজ্জ্ব পায় না। :p বললাম, আপনারা লাংকাউইর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটাই দেখেন নি।
আপনাদের বলে রাখি, মালয়শিয়া গেলে গেন্টিং এবং লাংকাউই দুইটার কেবল কারেই চড়বেন, কারণ দুইটার বিশেষত্ব দুইরকম !! আরো কিছু পরামর্শ, লাংকাউইতেও আইল্যান্ড হপিং, স্নরকেলিং বা স্কুবা ডাইভিং এর ব্যবস্থা আছে, আগ্রহীরা সেগুলোও ট্রাই করতে পারেন, যদিও আমার করা হয়ে ওঠেনি। খাবার দাবার খেয়ে খুব একটা মজা পাই নি। তবে KFC আছে, সেখানেও ঢু দিতে পারেন, আমার ভায়রা ওখানে খেয়েছে, তার কাছে নাকি বেশ ভাল লেগেছে।
কেনা কাটার জন্য অনেক শপিং সেন্টার আছে। যদি কখনো মালয়শিয়া বেড়াতে যান, আশা করি খুব সুন্দর ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবেন... শুভ কামনা রইল...
মালয়শিয়া থেকে ফেরার দিন সকালে শেষবারের মত একবার গিয়েছিলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে, আমার তোলা একটা ছবি শেয়ার করে মালয়শিয়া ভ্রমনের স্মৃতি শেষ করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।