"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫
মালয়শিয়ার স্মৃতি... [পর্ব-১] এখানে
ট্রেনিং শেষে ফ্রেশ হয়ে দুই বন্ধু বেড়িয়ে পড়লাম, গন্তব্য কুয়ালালামপুর শহর।
বলা বাহুল্য, আমরা যেখানে থাকতাম, সেটা কুয়ালালামপুর থেকে একটু বাইরে ছিল। উদ্দেশ্য, একটা ক্যামেরা কেনা। বাস এসে থামল কোটারায়াতে। সেখান থেকে আরেক বাসে চেপে চলে গেলাম সুংগাই ওয়াং মার্কেটে, আশে পাশে আরো মার্কেট আছে লো ইয়াট প্লাজা, বুকিত বিনতাং। জমজমাট এলাকা।
শেষ পর্যন্ত অনেক দেখে শুনে একটা সনি সাইবারশট T9 কিনে ফেললাম। ট্রেনিং এর দিনগুলোতে মূলত আমরা ট্রেনিং শেষে মূলত KL শহরে চলে আসতাম, এখানকার শপিং মল গুলোতে ঘুরতাম যদিও হাতে সময় খুব কম থাকত। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, সাইবারজায়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে হোটেলে ফিরতে ১ ঘন্টা সময় লেগে যেত। এর পর সেখান থেকে আবার KL আসতে আরো ১ ঘন্টা। হাতে সময় পেতাম মাত্র দেড় ঘন্টার মত, কারণ মালয়শিয়াতে মার্কেটগুলো সাড়ে আটটার দিকে বন্ধ হয়ে যেত।
যাইহোক তারপরেও যতদূর সম্ভব ঘোরার চেষ্টা করতাম। মিড ভ্যালি মেগামল নামে একটা বড় শপিং মল আছে। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছি ওখান থেকে, কিন্তু আসলেই খুব বিশাল একটা মল। রাতের বেলা ইন্ডিপেন্ডেস স্কয়ারে ঘুরে বেরিয়েছি। খুবই আলো ঝলমলে একটা জায়গা।
আর রাতের টুইন টাওয়ার তো অসাধারণ !
রাতের টুইন টাওয়ার
টুইন টাওয়ারের লাগোয়া একটা শপিং মল আছে, সুরিয়া KLCC (টুইন টাওয়ার যেখানে সেই জায়গাটাকে KLCC মানে Kuala Lumpur City Center বলা হয়)। সুরিয়া কে এল সি সি’র পেছনে বিশাল একটা পার্ক আর তার মাঝে পানির রিজার্ভার আছে। পানির রিজার্ভারে সুন্দর আলোক সজ্জাসহ বেশ কিছু পানির ফোয়ারাও আছে যেগুলো রাতে যখন চালু করা হয় দেখতে খুব সুন্দর লাগে। কৃত্রিম ফোয়ারার পাশে বসে কিছু সন্ধ্যায় কিছু অলস সময় পার, মন্দ না। এবং সেটা ওখানে প্রবাসী বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা করেও থাকেন দেখলাম।
ম্যান মেইড বিউটির কথা যদি বলা হয়, তাহলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মালয়শিয়া অবশ্যই প্রথম দিকেই অবস্থান করবে। কুয়ালালামপুরে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, অধিকাংশ সুউচ্চ ভবনেরই স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী নয়নাভিরাম !! দিনে রাতে যখনই ভবনগুলোকে দেখা হোক না কেন চোখ জুড়িয়ে যায়।
টেলিকম মালয়শিয়া (বর্তমানে আজিয়াটা) এর ভবন
পোস্ট অফিস মালয়শিয়ার ভবন
সুরিয়া KLCC এর ব্যাপারে আরেকটু বলি, শপিং মলটা একটা জটিল শপিং মল। টাকা যদি আপনার কাছে তেজপাতার মত মনে হয় তাহলেই আপনি সেখানে যেতে পারেন। কয়েকটা দোকানে জিনিসপত্রের দাম দেখলাম।
মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, ৪০/৫০ % ডিসকাউন্ট দেয়ার পরেও দেখি দাম বাংলাদেশী টাকায় ৪০/৫০ হাজার টাকার মত !! খালি দেখলাম আর আফসোস করলাম, কেন এই গরীব দেশে জন্মগ্রহণ করলাম !!
যাইহোক, দেখতে দেখতে সপ্তাহ শেষ হল। কি করব সেটা আগেই প্ল্যান করা ছিল। শনিবার আমরা যাব গ্যান্টিং হাইল্যান্ড, দ্য সিটি অফ এন্টারটেইনমেন্ট !! যেভাবে দিনটাকে উপভোগ করব ভেবেছিলা, শেষ পর্যন্ত আর সেভাবে হয় নি। কেন সেটা বলছি। আমরা ছিলাম দু’জন।
আমার বন্ধু বিবাহিত। সে তার বউকে সংগেই নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাবীর আবার তখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। তাই উনি আমাদের সঙ্গে শুরু থেকেই আসতে পারেন নি। ওই শনিবার সকালেই ভাবী মালয়শিয়া আসছেন।
আমার বন্ধু সকালে উঠে ভাবীকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এল। এরপর স্বাভাবিকভাবেই ভাবী ফ্রেশ হবেন, বিশ্রাম নেবেন। সব কিছু সেরে বের হতে হতে একটু বেলাই হয়ে গেল। বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখি আরেক বিড়ম্বনা ! বিকেল আড়াইটার আগে সব বাসের টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। এটা ছিল আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব।
এই পর্যায়ে গেন্টিং হাইল্যান্ড সম্পর্কে একটু বলে নেই। জায়গাটা KL থেকে ঘন্টা খানেকের একটা পথ এবং ১৭৬০ মিটার উচুতে পাহাড়ের চুড়ায়, সেখানে ওরা খুবই সুন্দর একটা থিম পার্ক এবং বেশ কিছু ফাইভ স্টার হোটেল বানিয়েছে। একটা ক্যাসিনোও আছে। KL আবহাওয়া বেশ গরম এবং আর্দ্র। অপর দিকে গেন্টিং এর আবহাওয়া চমৎকার আরামদায়ক শীতল, তাই KL এর অধিবাসীরা সপ্তাহ শেষে সপরিবারে গেন্টিং ছোটে, একটু আনন্দে সময় কাটানোর জন্য।
তাই শনি, রবিবার গেন্টিং এর জন্য সুপার পিক টাইম!
গেন্টিং হাইল্যান্ড - দ্য সিটি অফ এন্টারটেইনমেন্ট
শেষ পর্যন্ত বেলা আড়াইটার বাসেই রওনা হলাম। ব্যাপারটা আগে জানা থাকলে আগের দিন বাসের টিকেট কেটে রাখতাম। বাসের ভাড়া ৭ রিংগিত। ৩ রিংগিত বাস ভাড়া আর ৪ রিংগিত কেবল কারের ভাড়া। গেন্টিং এ যেখানে বাস থামে সেখান থেকে গেন্টিং হাইল্যান্ডের মূল এন্টারটেইনমেন্ট প্লেসে যেতে একটা ৩.৩৮ কি.মি. দীর্ঘ কেবল কার আছে।
এটা পথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম কেবল কার। পুরোপুরি পাহাড়ী জংগল আর মেঘের মধ্যে দিয়ে এই কেবল কারে ভ্রমনের অনুভূতি সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মত না !!
কেবল কারে গেন্টিং হাইল্যান্ড যাত্রা
মেঘে ঢাকা পথ...
মনজিল নজরে এল...
কেউ আবার ইচ্ছে করলে কেবল কারে না গিয়ে সড়ক পথেও ওখানে যেতে পারেন। মূল জায়গায় পৌছে আমরা সময় নষ্ট না করে সরাসরি থিম পার্কের টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম, কারণ হাতে সময় কম। টিকেট জনপ্রতি ৩৩ রিংগিত, পার্কের সব রাইডের জন্য, তবে কিছু কিছু বস টাইপ রাইডের জন্য ভেতরে আলাদা টাকা দিতে হবে। বলে রাখি, গেন্টিং এ বাস থেকে নেমে প্রথমেই আমরা ফিরতি পথের বাসের টিকেট কেটে নিয়েছিলাম, নইলে আরেক বিপদ হতে পারে সেই ভাবনায়।
গেন্টিং এ অনেক এক্সাইটিং রাইড ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল ফ্লাইং কোস্টার। কিন্তু দেখি সেটা মেরামতের জন্য বন্ধ। ভাল একটা রাইড একটা বাদ গেল। চিন্তা করলাম, সময় যেহেতু খুবই কম আর প্রত্যেকটা রাইডের সামনেই মাশাল্লাহ হাজার হাজার লোকের লাইন, জটিল দু একটা রাইডে চড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
কর্ক স্ক্রু নামে একটা রাইডের সামনে গিয়ে লাইন দিলাম। এটা হল মূলত একটা রোলার কোস্টার, কিন্তু এতে দুটো ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ আছে, এজন্যই এর নাম কর্ক স্ক্রু !
কর্ক স্ক্রু
চড়লাম, জটিল মজা পেলাম। কারণ, রাইডটা ওরা তৈরী করেছে, পাহাড়ের চূড়ায় একেবারে খাড়া ঢালের প্রান্ত ঘেষে। মানে আপনি যখন উপরে উঠবেন, দেখবেন আশে পাশে আর কোন মাটি নেই, একেবারে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে, মানে উত্তেজনার চরমে উঠানোর ব্যবস্থা !! যখন ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নেয় তখন ওরা সবার ছবি তুলে ফেলে। বের হওয়ার পর সেটা যদি কেউ চায় ১০ রিংগিতের বিনিময়ে বিক্রি করে।
নিয়ে নিলাম, এমন দুর্লভ একটা স্মৃতি, মিস করাটা ঠিক না।
এর পর আরেকটা রাইডের সামনে লাইন দিলাম, কিন্তু এখানে লাইন খুব বেশী না। কারণ, এইটা একটা সত্যিকারের ভয়ংকর রাইড !! সেইরকম হার্টের জোর না থাকলে কেউ উঠতে পারবে না। রাইডটার নাম সম্ভবত স্কাই ফল বা এ জাতীয় কিছু। জিনিসটা আর কিছুই না, আপনাকে অনেক উচুতে তুলে ফেলা হবে।
সেখান থেকে আশে পাশে তাকালে মনে হবে আপনি পাহাড়ের চূড়ারও অনেক উপরে এবং সেখান থেকে আপনাকে ফেলে দেয়া হবে।
স্কাই ফল বা ফ্রি ফল
আমার বিশ্বাস কেউ যদি এখানে একাধিকবার চড়ে তাহলে তার কাছে এটা আর কোন ব্যাপার মনে হবে না, কিন্তু কেউ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে তার কাছে সেটা চূড়ান্ত এক্সাইটিং হবে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। যখন উপরে উঠাল, আমি মনের সুখে চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। কারণ এত উপর থেকে আশে পাশের পাহাড়ী পরিবেশ, অসাধারণ! এমনিতেই পাহাড়ের প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে।
হঠাৎ করেই যখন উপর থেকে ছেড়ে দিল, আমি একটা ওজনহীনতা অনুভব করলাম, সত্যি সত্যি আমি কিছুক্ষণের জন্য আমার শরীরের উপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আমি দেখলাম, আমার মাথাটা আমার শরীরের উপর নেতিয়ে পড়ল। আর হার্টের উপর যে একটা চাপ, সে এক অন্যরকম অনুভূতি !! এত কিছুর পরও আমি এই রাইডটাকেই আমার জীবনের সবচেয়ে এক্সাইটিং রাইড হিসেবে দেখি এবং আবার যদি যাই অবশ্যই সেই রাইডে চড়ব। মজার ব্যাপার হল, আমার বন্ধু আমি ওই রাইডে চড়ার আগে বলছিল, “দোস্ত তোর এত শখ, তুই ওঠ, আমি উঠতেছি না, ভাই জানে মরতে চাই না”। আমি যখন সফলভাবে সেই রাইড শেষ করে আসলাম, তখন সেও গিয়ে ওই রাইডে উঠল (ওর সাথে ওর বউ ছিল, হয়ত মনে মনে ভেবেছিল, বউয়ের সামনে এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু )।
রাইড শেষে বলে আরে ব্যাপার না, একটু রেডি থাকলেই অত ভয় লাগে না, সে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল কি কি উপায়ে এই রাইড ভয় না পেয়ে শেষ করা যায় !!! (একটি খবর বলে যাই, আমার এই বন্ধু আজ তার দ্বিতীয় কন্যার জনক হয়েছে, মা মেয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন... )
সন্ধ্যায় গেন্টিং থেকে ফেরার পথে...
আমাদের গেন্টিং ভ্রমন এই পর্যন্তই হল, আর সময় নেই। ফিরতি বাস চেপে আমরা KL চলে এলাম। আমাদের হোটেলের সামনেই “তাজ” নামক একটা ইন্ডিয়ান টাইপের হোটেলেই আমরা রাতে খেতাম। বেশীর ভাগ সময়ই ফ্রাইড চিকেন বা ফ্রাইড মাছ খেতাম। কারণ অন্যান্য আইটেমে মসলার চোখ পাকানি দেখে ভয় লাগত আদৌ হজম করতে পারব কিনা।
এমনকি মাছ ফ্রাইএও অনেক ঝাল দিত, ডাল দিয়ে সেটাকে নিউট্রালাইজ করা লাগত। তারপরেও দূর দেশে এই খাবার পেয়েই শোকরিয়া আদায় করতাম, কারণ মালয়শিয়ান খাবারগুলোতে সম্ভবত মিষ্টি বেশী দেয় যা কিনা আমাদের কাছে খেতে খুব একটা ভাল লাগবে না... (চলবে)
মালয়শিয়ার স্মৃতি...(পর্ব-৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।