"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫
২০০৪ এর অগাস্টে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর পরই একটা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে ফেললাম।
এক দেড় মাসের মধ্যেই সেটা পেয়ে গেলাম আর তার এস্তেমাল করেছিলাম পরের বছর নভেম্বরে দার্জিলিং সিকিম ভ্রমন করে। যাইহোক পাসপোর্টটা দ্রুত করানোর উদ্দেশ্যটা ছিল আসলে অফিসের কোন ট্রেনিং এর সুযোগ এলে যাতে কোন ঝামেলা না হয় সে জন্য। সে সুযোগটা চলে এল ২০০৬ এর মার্চে। মালয়শিয়ার সাইবারজায়ায় এরিকসন এডুকেশন এ ৯ দিনের একটা ট্রেনিং। ব্যাপক উত্তেজনা অনুভব করলাম, প্রথম কোন সুপরিসর উড়োজাহাজে চড়া এবং উন্নত কোন দেশে ভ্রমনের সম্ভাবনার আনন্দে।
নতুন ব্যাগ কেনা হল। ট্রেনিং এর চেয়ে ঘোরাঘুরির প্ল্যানটাই মূখ্য হয়ে উঠল। যারা আগে গিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলাম আর ১৪ দিনের একটা ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম। ৯ দিনের ট্রেনিং এ মাঝে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি, শেষে দুই দিন অফিস থেকে নেয়া ছুটি আর পৌছানোর পর এক দিন এই হল আমার ঘোরার সময়। সাথে আছে আমার ছোট বেলার বন্ধু এবং সহকর্মী, আমরা দুজন এক দিনেই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম, আবার এক সাথেই ট্রেনিং এ যাচ্ছি।
ফ্লাইট ছিল সম্ভবত রাত সাড়ে বারটায়, মালয়শিয়া এয়ারলাইন্সে। এয়ারপোর্টে ঢুকে লাগেজ স্ক্যান করিয়ে চেক ইন এর দিকে এগুলাম। জীবনে প্রথম আন্তর্জাতিক বহিগ্রমন, মনে একটা চাপা উৎকন্ঠা, কারণ শুনেছিলাম এয়ারপোর্টে এরা নাকি অনেক ঝামেলা করে। ঝামেলা কিছুটা হল, তবে সেটা আমার নয়, আমার বন্ধুর ! ঘটনা কি? আমার বন্ধুর পাসপোর্টে তার পেশা হল Student । চেক ইনে বসা এয়ারলাইন্সের ভদ্রলোক সেটা দেখেই বেকে বসলেন।
তার কথা আপনি চাকরি করছেন, কিন্তু আপনার পেশা ছাত্র কেন? আমার বন্ধুর উত্তর, আমি পাসপোর্ট করিয়েছি ছাত্র থাকাকালীন, তাই পেশা এখনো ছাত্রই রয়ে গেছে। যাইহোক, এই জিনিসটা কিন্তু আসলে ইমিগ্রেশনে ধরার কথা। কিন্তু এখানে চেক ইনেই বেচারা মাতব্বরি করা শুরু করেছে !! মানে সূর্যের চেয়ে বালি গরম আরকি!! শেষ পর্যন্ত তাদের বড় সাহেব এসে বলল, ওনার কি রিটার্ণ এয়ার টিকেট আছে? হ্যা আছে। তাহলে ছেড়ে দাও। যেখানে মালয়শিয়ান হাই কমিশন তাকে ভিসা দিয়ে দিয়েছে, সেখানে চেক ইনেই এয়ার লাইন্স কর্মকর্তার বাড়াবাড়ি !
প্লেনে উঠে বিমানবালাদের সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করলাম।
ফ্লাইট আধা ঘন্টা দেরিতে ছেড়েছিল, ভোর বেলা গিয়ে মালয়শিয়া পৌছলাম। রাতের আধারে ভ্রমন করার সুবাদে চার ঘন্টা প্লেনে বসে থেকে মাঝে মাঝে একটু ঘুমানোর অপচেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। আসলে একটু পর পর কেবিন ক্রুরা এটা সেটা নিয়ে হাজির হচ্ছিল। এসব কারণেই আর ঘুমানোর কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ভুখা নাংগা টাইপের প্লেন, সামনে কোন ভিডিও ডিসপ্লেও নেই যে একটু মুভি দেখব।
খালি গান শোনার একটু ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশের লেবারদের জন্য এর চেয়ে বেশি আর কি ই বা দরকার??
দুই দেশের ইমিগ্রেশনেই কোন বাজে অভিজ্ঞতা হল না, খুব ভাল লাগল, কারণ শুনেছিলাম, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট দেখে মুগ্ধ হলাম। রাস্তায় বের হয়ে আরো ভাল লাগল, প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ীগুলো দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। মনে মনে বললাম, এইবার সত্যিকারের বিদেশে এলাম! সাথে সাথে মনের মধ্য একটা কষ্ট অনুভব করলাম, আহা আমাদের দেশটা যদি এমন হত!! ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম সানওয়ে হোটেল পিরামিড টাওয়ার, একটি চার তারকা হোটেল।
বিশাল কমপ্লেক্সে একটি পাচ তারকা হোটেল, একটি চার তারকা হোটেল, লাগোয়া সুবিশাল শপিং মল এবং খুব সুন্দর একটা থিম পার্ক! শপিং মলের নীচ তলায় খুব সুন্দর একটা আইস স্কেটিং গ্রাউন্ড, নানা বয়সের ছেলে মেয়েরা সেখানে স্কেটিং করে চলেছে, কেউ শিখছে আর কেউ কেউ তাদের অসাধারণ নৈপূণ্য প্রদর্শন করে যাচ্ছে! চমৎকৃত হলাম দেখে।
সানওয়ে সিটি, পিরামিড কমপ্লেক্স
সানওয়ে শপিং মলে আইস স্কেটিং
রিসেপশনের স্মার্ট মেয়েটি জানাল, এখন কোন রুম খালি নেই। দুপুর বারটার পর্যন্ত চেক আউট টাইম, তাই বিকেল চারটা নাগাদ রুম পাওয়া যাবে। মাথাই গরম। সারা রাত ঘুমানো হয় নি, ঘুমে মাথা জ্যাম হয়ে আছে।
বললাম অন্তত একটা রুম ম্যানেজ করে দাও, দুজনের লাগেজ একটু রাখি। শেষ পর্যন্ত ২/১ ঘন্টা পর একটা রুম মিলল। রিসেপশনেই দেখলাম ওরা কিছু টিকেট রেখে দিয়েছে, হোটেল বোর্ডারদের জন্য সানওয়ে থিম পার্কে ৮/১০ রিংগিত ছাড় আছে। কয়েকটা টিকেট নিয়ে নিলাম আর ভাবলাম এই সুযোগে তাহলে থিম পার্কেই ঘুরে আসি প্রথমে। দুই দোস্ত চলে গেলাম থিম পার্কে।
রোলার কোস্টারে চড়লাম, খুব একটা এক্সাইটিং ছিল না। একটা নৌকার রাইডে চড়লাম, চরম লাগল। নৌকাটা পানিতে না, ডাঙ্গায় ! নৌকাটা দুইদিকে দোলনার মত দুলতে থাকল। আমরা বসেছি নৌকার এক প্রান্তে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, একবার আমরা উপরে উঠে যাচ্ছি আর একবার একেবারে নীচে চলে আসছি। এক পর্যায়ে নৌকা পুরো ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নিয়ে নিল সম্ভবত দুবার।
খুবই উত্তেজনাকর অনুভূতি, আর নৌকাটা বেশ বড়ই ছিল। এর পর গেলাম ওয়াটার পার্কে। আমরা দুজনেই ফুল প্যান্ট পরা। একটা স্লিপার টাইপের রাইড আছে না, যে উপর থেকে টিউবের মধ্যে বসে লম্বা প্যাচানো পথ ধরে নীচে চলে আসা, সেটাতে আমাদের উঠতে দিল না, ফুল প্যান্ট পরে থাকার কারণে। মনটা খারাপ হল, এত সুন্দর একটা রাইড ! আমার বন্ধু বেশ ধার্মিক, আমি মিডিয়াম লেভেল ধার্মিক, তাই আমাদের কারো পক্ষেই হাফ প্যান্ট পরা সম্ভব না, এটা ছেলেদের জন্য হারাম।
যাইহোক এর পরে কৃত্রিম বীচে চলে গেলাম, কৃত্রিম ঢেউয়ে গা ভাসালাম, সাতার কাটলাম, ভালই লাগল।
সানওয়ে থিম পার্ক
সানওয়ে থিম পার্কের আরেকটি ভিউ
আমাদের হোটেলের সামনেই ছিল বেশ কিছু দোকান পাট, খাওয়ার হোটেল। "তাজ" নামে একটা হোটেল পাওয়া গেল, ইন্ডিয়ান ধাচের। সেখানেই কিছু খেয়ে বিকেলের দিকে আমরা আবার বেরিয়ে পরলাম, উদ্দেশ্য KL Tower দর্শন।
কে এল টাওয়ার
কে এল টাওয়ার আসলে ৪২১ মিটার উচু একটি কমিউনিকেশন টাওয়ার।
তবে এতে আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার ও ঘূর্ণায়মান হোটেল। এখান থেকে পুরো কুয়ালালামপুর শহর দেখা যায় আর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার এর খুব কাছের একটা ভিউ পাওয়া যায়।
কে এল টাওয়ার থেকে কুয়ালালামপুর শহরের একটা ভিউ
তাই এমনভাবে প্ল্যান করে গেলাম যাতে আমরা বিকেলে ওখান ঢুকে রাতে বের হব। এতে আমরা দিনের কুয়ালালামপুরের পাশাপাশি রাতের KL এর সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারব। জনপ্রতি প্রবেশ চার্জ ২০ রিঙ্গিত।
খুব ভাল লাগল উপরে উঠে। ওখানে দূরবীনের ব্যবস্থা আছে, চারিদিক আরো কাছ থেকে দেখার জন্য। টুইন টাওয়ার দেখে খুব ভাল লাগল। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম মেঘ ভেসে যাচ্ছে টুইন টাওয়ারের গা ঘেষে।
টুইন টাওয়ারের চূড়া সহ বিভিন্ন অংশে উজ্জ্বল আলোকসজ্জা আছে যার জন্য টুইন টাওয়ার রাতে আরো আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে! KL Tower এর Observation deck এ কাচে খোদাই করা আছে বিশ্বের বিভিন্ন উচু ভবনের প্রতিকৃতি।
লেখা আছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য। যাইহোক, KL Tower থেকে যখন নীচে নেমে এলাম তখন বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হল মালয়শিয়া এসে প্রথম দিনেই একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। রাতে ভাল ঘুম হল, পরের দিন সকালেই ট্রেনিং, সকাল আটটায় গাড়ী ধরতে হবে, মিস করলে ট্যাক্সিতে যেতে ৫০ রিংগিত (২০০০ টাকা) গচ্চা যাবে...
হোটেল রুম থেকে আশে পাশের একটা ভিউ
সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হল।
বাইরে মোটামুটি গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া থাকলেও হোটেলের ভেতর শীতকাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে নরম বিছানায় শুয়ে আছি, কার উঠতে মন চায়, বলেন?? লবিতে নেমে রেস্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা খেতে। গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড ! বুফে নাস্তা, কত রকম খাবার চারিদিকে, অনেক ফলও আছে ! এদিকে হাতে সময় কম, কারণ ঘুম থেকে উঠে গোসল করে রেডি হয়ে নীচে নামতেই অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেছে। নাস্তার যেই আয়োজন, অন্তত ১ ঘন্টা প্রয়োজন মনের খায়েশ মিটিয়ে নাস্তা করার জন্য। তারপরও যতদূর পারলাম উদরপূর্তি করলাম।
দুধ দিয়ে কর্ণ ফ্লেক্স আর তার সাথে চকলেট ও কিসমিস ছিল আমার খুব প্রিয় একটা আইটেম। এছাড়া সবুজ রঙের একটা নাশপাতিও থাকত, খেতে খুব মজা। হাতে কয়েকটা নাশপাতি আর আপেল নিয়ে দৌড়ে বাসে উঠলাম, এক ঘন্টার যাত্রা, গন্তব্য সাইবারজায়ার এরিকসন এডুকেশন মালয়শিয়া।
এরিকসন মালয়শিয়ার অফিসের প্রবেশ পথ
এরিকসন মালয়শিয়া অফিসের ভেতর
সাইবারজায়া হল একটা অফিশিয়াল আলাকা, এখানে সব বড় বড় কোম্পানির অফিস। সেখানে এরিকসনের অফিস দেখে চমৎকার লাগল।
ভবনের স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন ! ভেতরের ইন্টেরিয়র ও বেশ আকর্ষনীয়। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। ট্রেনিং রুমে ঢুকেই সকালের নাস্তার প্রভাব টের পেলাম। ভরা পেটে ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। ট্রেনিং আর কি করব, ঝিমুতে ঝিমুতেই সময় গেল।
সাড়ে দশটায় refreshment break. আবার খাওয়া দাওয়া। সবচেয়ে লোভনীয় ছিল অফিসের চা, কফি, মাইলোর ভেন্ডিং মেশিনটা। এক গ্লাস গরম মাইলোতে চুমুক দিতে যে কি মজা সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না। পুরো ট্রেনিং এ সেই জিনিসের সহি এস্তেমাল করেছি। বিকেল পাচটায় ট্রেনিং শেষ।
ফিরতে ফিরতে ছয়টা... (চলবে)
মালয়শিয়ার স্মৃতি... (পর্ব- ২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।