জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..
''লাল কয়েনকে 'কয়েল' ভেবে বিপাকে হাশেম '' আজকের দৈনিক কালের কন্ঠের মফস্বল পাতার সংবাদটি পড়েছেন? মাগুরা সদর উপজেলার ছয়চার গ্রামের কৃষক হাশেম আলীর বিড়ম্বনাকে নিয়ে লেখা এই সংবাদ। এক টাকার কয়েন কেনা বেচার গুজবে কান দিয়ে হাশেমের হাত এখন মাথায়। কয়েন কে 'কয়েল' ভেবে বিপাকে পড়েছেন হাশেম। কেন? কি হয়েছিল হাশেম আলীর?
খবরে প্রকাশ, বুধবার রাতে মোবাইল ফোনে তাঁর এক নিকটাত্মীয় তাঁকে জানান, এক টাকার লাল কয়েন বাজারে অনেক টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পারলে যত খুশি সংগ্রহ করে রাখতে পারেন।
কিন্তু হাশেম আলী ফোনে 'লাল কয়েন'-এর স্থলে শোনেন মশা তাড়ানোর 'লাল কয়েল'। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে সদরের কাটাখালী বাজারে গিয়ে তিনি হান্নান মিয়াসহ বেশ কয়েকজন মুদি দোকানদারের কাছ থেকে এসিআইসহ বিভিন্ন কম্পানির মশা তাড়ানোর লাল কয়েল কিনে বাড়ি নিয়ে যান। পরে প্রতিবেশীরা তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি সেগুলো ফেরত দিতে ফের বাজারে আসেন। কিন্তু দোকানদাররা সেগুলো ফেরত নিতে না চাইলে হাশেম আলীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ব্যাপারে হাশেম আলী বলেন, 'ফোনে আমি কয়েনকে কয়েল শুনিছি।
মনে করিছি হঠাৎ করে দাম বাড়ে যাতি পারে বলে আমার আত্মীয় আমারে এগুলো কিনে থুতি কইচ্ছে। ' হান্নান আরো জানান, এগুলো তিনি বিভিন্ন দোকান থেকে এক প্যাকেট, দুই প্যাকেট করে সংগ্রহ করেছেন। এ জন্য ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
হাশেম আলীর এই কয়েন জটিলতা সংবাদপত্র পাঠক মনে প্রথমেই যে অনুভূতি তৈরি করে তার বাংলা নাম 'হাসির খোরাক'। আমাদের প্রান্তিক অঞ্চলের অসহায় চাষাভুষা হাশেম আলীররা এরকমই।
এরা রাতে যে গামছা দলা পাকিয়ে মাথার বালিশ বানায়, পরদিন তা-ই নেংটি করে পাছায় মুড়িয়ে মাঠে ছুটে। সংখ্যায় গরিষ্ট এই হাশেম আলীররাই এই দেশে ভাতের সংস্থান করে। নিজের পাতে জুটুক আর নাই জুটুক।
কয়েন নিয়ে এই তাজা গুজবের উৎস কী? যেহেতু বলা হচ্ছে গুজব তাই কিছু শোনা কথা শেয়ার করি। প্রথম শোনা কারণ ছিল 'আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া'! আবার 'এক টাকার এই কয়েন পুরোটাই স্বর্ণের তৈরী, ভরি হিসেবে একটা কয়েনে প্রায় ২০০০ টাকার স্বর্ণ আছে! হঠাৎ করে এটা দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জেনে গেছেন, তাই সব কয়েন সংগ্রহে নেমেছেন'।
এই গুজব। এরকম এন্তার কারণে অকারণ ঘষাঘষি খেতে খেতে গুজব গড়গড়িয়ে গড়িয়ে চলে সারা দেশ। শুধু বাকি ছিল 'এই কয়েন ধুয়ে পানি খেলে অনন্ত যৌবন লাভ করা যায়। সৌন্দর্য কয়নের মতই চকচক করবে' এমন গুজব!
এইরকম একটা তাজা গুজবে সারাদেশে হাশেম আলীর মতো অনেকেই ঠকেছেন। হুদাই শ্রম দিয়েছেন, মাতামাতি করে নিজের সময়টুকু নষ্ট করে গুজবের স্থাস্থ্য বৃদ্ধি করেছেন।
সমাজে আমরা অনেকে গুজব ছড়ানো বিদ্যায় ওস্তাদ। কেউ আছি গুজবে কান দিয়ে নিজের ছেলেকেও মাসী ডাকি। কেউ সব দেখে শুনে 'তাতে আমার কী স্বার্থ' বলে মুখ ফিরিয়ে নিই, কেউবা গুজবে ঘি ঢালি, কেউবা তফাতে দাড়িয়ে দেখে 'দেখিতো মজা কেমন জমে'। আবার কেউবা গুজবের বিনিয়োগ করে ফটকা লাভ তুলে চম্পট মারি। গুজবের ভরা সংসারে আমাদের বাস।
কোটি কোটি লোকে গিজগিজ করা গণসমাজের এই বঙ্গভূমিতে গুজবের ভরে চলে আামদের কান। শুনে তরাক করে লাফ দিয়ে নিজেরা হই তার অংশীদার। কখনো সচেতনে, কখনোবা আমাদের অচৈতন্যে। গুজব-গুঞ্জনের এই রঙ্গ ভরা বঙ্গ দেশে ক্ষণে ক্ষণে রটে গুজব।
গণমাধ্যমবিদরা বলছেন, গণমাধ্যমের প্রাযুক্তিক প্রকৌশলগত বিকাশ আর অফুরন্ত ব্যবহারের যুগে গড়ে উঠা গণসমাজের অন্যতম গণআচরণের নাম 'গুজব'।
গুজবে যৌথ আচরণের প্রবণতা থাকলেও কোন সংঘবদ্ধ আচরণ নয়। তা বেশিরভাগই ব্যাক্তি আচরণেরই প্রতিফলন। বহুজনের ব্যাক্তিগত আচরণই এই গণআচরণ। গুজব ছাড়াও গণসমাজের অন্যান্য গণআচরণগুলো হলো হুজুগ, ফ্যাশন, উন্মাদনা আর গণহিস্টিরিয়া। হুজুগ হলো প্রচলিত আচরণের কোন ব্যতিক্রম।
হুজুগ সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী। হুজুগের উদ্দেশ্যই হলো অন্যের কাছ থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র প্রমাণ করে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা। আর গণ উন্মাদনা হলো মানসিক পরিতৃপ্তির জন্য কোন কিছুর দিকে পাগলের মতো ছুটে যাওয়া। মাস হিস্ট্রিরিয়া বা গণবিকার এক ধরণের ভাবাবেগযুক্ত উন্মুক্ত আচরণ যার মধ্যে বুদ্ধি বা যুক্তির লেশমাত্র নেই। গণসংস্কৃতি নিয়ে অধ্যয়নের পথে এসম্পর্কে আমরা আরো বিস্তর খোঁজ পাবো।
তবে এই আধুনিক গণসমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী গণআচরণ হলো গুজব। গুজব হলো তাই, যা সত্য নয়। এককথায় পাকা তথ্য দ্বারা অসমর্থিত। গণযোগাযোগ তাত্ত্বিকদের মতে, যে কোন সমাজেই গুজব ঘটতে পারে। তবে গণসমাজে যেহেতু একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন সেহেতু এই সমাজে গুজবের প্রবণতাও বেশি।
গত দুই মাসে আমাদের চর্মকর্ণে ধরা পড়েছে এমন কিছু গুজবকে যদি একটু রিভাইস করি তাইলে আমরা পাই- 'তারেক জিয়ার ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা'র গুজব। 'গোলাম আজম দেশ থেকে পালিয়ে গেল, তারে ধর ধর' গুজব। আবার কিছুদিন আগেও ছিল 'ছেলেধরা গুজব'। গুজবের হাত ধরে আগমণ ঘটে আতঙ্কের। আর এই আতঙ্কের উপর ভর করে মানুষ পিঠিয়ে মারে মানুষকে।
এই তো কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরে আবারও এক প্রতিবন্ধী ভিখারিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেদিনতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মুখেই তো শুনলাম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গ্রেপ্তারের খবরটি স্রেফ গুজব। দুই দিন পার না হতেইবিএনপির অভিযোগ ছিল 'হরতালের গুজব ছড়াচ্ছে সরকার'! এ যেন গুজবে গুজবে রঙ্গভরা বঙ্গদেশে দিন গুজরানো! মারহাবা মারহাবা।
গুজবে ভর করে একদা আমেরিকারতেও নাকি ঘটেছিল মহা ধুন্ধুমার এক কাণ্ড। হাজারো লোক ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছুটে বেড়িয়ে প্রাণ বাচানোর চেষ্টা করেছিল সেদিন।
'মঙ্গল গ্রহ থেকে উড়ে আসা এক ভয়ংকর প্রাণী আমেরিকা ধ্বংস করে ফেলবে' এমন সায়েন্স ফিকশনকে রেডিও সংবাদ বিবরণী ভেবে রাজ্যশুদ্ধ লোক ভয়ে অস্থির হয়েছিল। যা নিয়ে গণযোগাযোগ বিদ্যায়তনে হয়েছিল ব্যাপক গবেষণা। যা স্থান করে নিয়েছে যোগাযোগের তত্ব নির্মাণে। সে কথা অন্য।
গুজব গুজবই।
রাজা থেকে প্রজা, প্রাচ্যের হ্যারিস থেকে বঙ্গের হাশেম কাউরেই ছাড়ে না গুজব । গুজবের এমনই এক শন্তিশালী জাল। যে জাল অন্তর্ভেদী। যে জাল কুহকের। যেই জালে ধরা না দিয়ে পার নেই চঞ্চল আর অস্থির এই সমাজের নাগরিকদের।
কিন্তু গুজবে ভর দিয়ে হাশেম আলীরা ঠকলেও এই খেলায় কারা জেতে তা কি আমরা ভেবে দেখি? সমাজে যখন স্বাভাবিক তথ্য উৎস বন্ধ হয়ে যায়, গণ্ডগোল সৃষ্টির আশঙ্খা তৈরি হয় তখনই তৈরি হয় যোগাযোগ ঘাটতি বা কমিউনিকেশন গ্যাপ। তাই বলি, স্বাভাবিক প্রবহমান সমাজ যখন এইরকম গুজব ছড়ানোর পেশায় জড়িয়ে পড়ে, তখন বলতে হয়, গুজবের ফাঁকতালে কারা যেন 'অন্য কোন ফন্দি ফিকির', 'অন্য কোন ধান্দা', 'অন্য কোন পরিকল্পনা' বাস্তবায়ন যে করছে না তার নিশ্চয়তা কী?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।