আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দু'জন দেশপ্রেমিকের প্রতি প্রণতি



দু'জন দেশপ্রেমিকের প্রতি প্রণতি ফকির ইলিয়াস ============================= গেল ক'দিনের ব্যবধানে আমার দেখা দু'জন প্রজ্ঞাবান দেশপ্রেমিককে চিরতরে হারালাম। দেওয়ান ফরিদ গাজী। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের এলাকা, নির্বাচনী প্রচারণায় চষে বেড়িয়েছেন। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর গায়ে খদ্দরের চাদর জড়ানো এক বাগ্মী নেতা।

আমার বড় চাচার খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন আমাদের 'গাজী চাচা'। ভরদুপুর ভরা রাজনৈতিক প্রচারণা সেরে আমাদের জলটুঙ্গী ঘরে সদলবলে দুপুরের আহার সেরেছেন তিনি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ানো ছিল তার কাজ। উত্তর সুরমা কিংবা দক্ষিণ সুরমার কোন গ্রামটি অপরিচিত ছিল তার! মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মন্ত্রিপরিষদে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর 'সবুজ বিপ্লব' প্রকল্পের একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী আমাদের এলাকায়। না, তার মাঝে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি।

সেই প্রাণখোলা হাসি। নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে গিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে করমর্দন, কোলাকুলি। তারপর অনেকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি দীর্ঘদিন। সেখানেই তার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়।

একজন বিনীত মেধাবী রাজনীতিক তো বটেই, সাহিত্য-সংস্কৃতির তিনি ছিলেন একজন মুগ্ধ এবং বোদ্ধা ব্যক্তিত্ব। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর অনেক দুঃসহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয় তাকে। বন্দুকের নলের মুখে তাকে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য করা হয়। এজন্য তার একটা দুঃখবোধ বরাবর জাগ্রত ছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন।

তিনি নিজের মুখেই বলেছেন, পরিস্থিতির শিকার ছিলেন তিনি, অন্যান্য আরও অনেকের মতো। গভীরভাবে ধার্মিক হয়েও যে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকা চিরজীবন সমুন্নত রাখা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। সমাজের কোন কপটতা তাকে ছুঁতে পারেনি। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। গ্রামে গ্রামে হেঁটে মুক্তিফৌজ জোগাড় করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের মা-বাবা, পরিবার-পরিজনের খোঁজ নিয়েছেন। সাহস জুগিয়েছেন। পরিণত বয়সেই চিরবিদায় নিয়েছেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। আমৃত্যু নিজ এলাকার এমপি ছিলেন। সিলেট শহরের লামা বাজারের বাসিন্দা হিসেবে সিলেট-১ আসনের মানুষেরও তিনি ছিলেন আত্মার আত্মীয়।

বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে বিনীত অনুরোধ করি, এ মহান রাজনীতিকের স্মৃতি রক্ষার্থে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। বৃহত্তর সিলেট তথা রাজধানীতে দেওয়ান ফরিদ গাজীর নামানুসারে সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, স্থাপনার নামকরণ করা হোক। এ প্রজন্ম, আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি আলোকবর্তিকা হয়েই বেঁচে থাকবেন সন্দেহ নেই। দুই প্রায় হঠাৎ করেই চলে গেলেন আমার দেখা আরেকজন বীর বাঙালি মীর শওকত আলী। সব পরিচয় ছাড়িয়ে তার প্রধান পরিচয় ছিল তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের কৃতী সেক্টর কমান্ডার।

মীর শওকত আলী ছিলেন উত্তর সিলেট অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার। তাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোন একদিন। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে সিলেটে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রধান ক্যাম্প গড়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মনে পড়ছে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন সিলেট শহর দেখতে বেরিয়েছি।

শহরজুড়ে মাইকে মাইকে গান বাজছে। 'শোনো একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠধ্বনি, প্রতিধ্বনি- আকাশে-বাতাসে ওঠে রনি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ'। সেদিন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর ছুঁইছুঁই। আমার বড় ভাই দূর থেকে দেখালেন- ওই যে উনি শওকত সাহেব। আমাদের সেক্টর কমান্ডার।

দেখলাম একটা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে তিনি রোদ পোহাচ্ছেন। কাছে গেলাম। আমার ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে আদর করে কয়েকটি লজেন্স খেতে দিলেন। আমরা যখন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ঘুরছি, তখনই দেখলাম একদল অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা একজন কুখ্যাত রাজাকারকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসছেন।

হৈ-হুল্লোড় আঁচ করে মীর শওকত হুঙ্কার ছাড়লেন-'এই আমার কাছে নিয়ে আয়'। মুক্তিযোদ্ধারা ওই রাজাকারটিকে উনার কাছে নিয়ে গেলেন। আমরা তখন বেশ দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি ওই রাজাকারকে কি সব জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর দেখলাম, দাঁড়িয়ে খুব জোরে তার গাল-কান বরাবর একটি মাত্র চড় মারলেন মীর শওকত।

রাজাকারটি চড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আবার তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন। 'এই ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যা'। পরে শুনেছিলাম, ওই রাজাকারটি কিছুক্ষণ পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক মীর শওকত আলীকে এরপর আমি বহুবার খুব কাছে থেকে দেখেছি।

আমি যখনই তার পাশাপাশি কিংবা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি তখনই আমার বুকটি যেন ফুলে উঠত। বেড়ে যেত বুকের ছাতি। মনে হতো আমি একজন সৈনিকের প্রতিকৃতি, একজন বীরের প্রতিমূর্তির কাছাকাছি দাঁড়িয়েছি। মীর শওকত আলী রণাঙ্গনে 'টাইগার' কোড নামে পরিচিত ছিলেন। আসলেই তিনি ছিলেন ব্যাঘ্রসম চিত্তের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

তিনি যখন বিলাতে রাষ্ট্রদূত তখন তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথা হয়। বলেছেন, আমি এ দেশের মানুষের মুক্তির কল্যাণে চিরদিন কাজ করে যাব। তারপর তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বিষয়টি আমাকে সে সময় খুবই ভাবিয়েছিল, তিনি কেন বিএনপিতে যোগ দিলেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল, দলটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালনা করার জন্যই দলে যোগ দিয়েছেন।

তিনি নিউইয়র্কে এলে তা তার কাছে জানতেও চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ দল যদি মুক্তিযুদ্ধের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় তবে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। হ্যাঁ, আমরা সেটিই দেখেছিলাম ২০০১-এ নির্বাচনের পর। রাজাকার চক্রের জীবিত হোতাদের যখন খালেদা জিয়া মন্ত্রিত্ব দেন তখনই মীর শওকত বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এরপরই তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন বিএনপির সঙ্গে।

দলীয় কোন কর্মকান্ডে আর তাকে দেখা যায়নি। জীবনের শেষ সময়ে এসে ঘাতক-দালাল-রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন বীর উত্তম এ সেক্টর কমান্ডার। 'সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম'র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। একটি বিষয় খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ম্যান্ডেট নিয়ে যে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, একই দাবির অগ্রপথিক ছিলেন লে. জে. (অব.) মীর শওকত আলী। তারপরও তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক বাণী দেননি।

কেন দেননি? এর কারণ কি? একি আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য? সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তো তিনি রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে শ্রদ্ধার্ঘ পাওয়ার দাবি অবশ্যই রাখেন। টিভিতে মীর শওকত আলীর অন্তিমযাত্রার দৃশ্যগুলো দেখলাম। সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতারা পুষ্পার্ঘ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হয়নি। এ বেদনাবোধ গোটা জাতিকে অবশ্যই পীড়িত করবে।

মীর শওকত আলী ছিলেন এমন এক বীর যিনি সত্যের সঙ্গে আপস করেননি। ফলে বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন শেষ বয়সে। তার এ চেতনা প্রজন্মকে অনন্তকাল শানিত করবে। বর্তমান সরকারের উচিত, এ বীর পুরুষের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সর্বাত্মক সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ লেখাটি যখন লিখছি তখনই টিভিতে সংবাদ দেখলাম কুমিল্লার এমপি লুৎফুল হাই সাচ্চু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।

মাত্র ক'সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন সরকারদলীয় এ সংসদ সদস্য। তার সঙ্গে যখন দেখা হয় খুবই প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। খবরটা শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বারবারই ভাবি- হায় জীবন, তুমি এত ছোট কেন? তারপরও আমরা কেন ভুলতে পারি না সব সংকীর্ণতা। নিউইয়র্ক, ২৩ নভেম্বর ২০১০ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২৬ নভেম্বর ২০১০ শুক্রবার


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।