গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।
মা, তুমি যখন প্রথম অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলে তখন মনে মনে শুধু অপেক্ষা করতাম কবে সেরে উঠবে। কবে আবার নিজহাতে রান্না করে আমার জন্যে অপেক্ষায় থাকবে। তাই তোমাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম আমরা ভাইবোন সবাই। এর সাথে বুকের ভিতরে ধুকপুক করা কামনার উত্তাপ মিলে আমাকে এক অদ্ভূত ধ্যানের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু আস্তে আস্তে সেই উত্তাপ ঝিমিয়ে এলো, চেষ্টার আরাধনায় শিথীলতা নেমে এলো। কারণ, আমি জানতে পারলাম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার আর কোন সম্ভাবনা তোমার নেই। এসব রোগের এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তা মেনে নিলাম। তবে বিধাতার কাছে তোমার সুস্থতার জন্যে আরজি পেশ করতে থাকলাম ক্লান্তিহীনভাবে।
কিন্তু সেই অমোঘ পরিণতি যেন কিছুতেই তোমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিল না। বরং নির্মম বাস্তব সত্যটাকে আমার কাছে প্রকট করে তুললো। আর তখন থেকেই তোমার মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করতে লাগলো।
কিন্তু তোমার মৃত্যুকে কি করে আমি মেনে নিব মা ? বুকের ভিতর যে উত্তাপ নিয়ে বিধাতার কাছে তোমার রোগমুক্তি ভিক্ষে চাইতাম এরপর থেকে দেখলাম সেটা আর আমি করছিনা। আমি অবাক হয়ে গেলাম আমার অজান্তেই আমার আরাধনার ভাষাটা পাল্টে যাওয়ায়।
আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম আমার মা যেন আমার আগে মরে না যায়। তাহলে আমি তা সইতে পারবনা। শয়নে-স্বপ্নে-জাগরনে-চিন্তায়-কর্মে একটি গানের দুটি লাইন আমার মনে বাজতে লাগলো।
‘আমি কেমন করে দিব মাটি তোমার কবরে
মাগো, আমার আগে তুমি যেওনা মরে। ’
আমি দেখলাম বিধাতার কাছে তোমার জন্য এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি আরও বুঝলাম এই আরজি আমার অন্তরের গভীরতম খাদ থেকে উঠে আসছে। তোমার জন্য বিধাতার দরবারে পেশ করার এর চেয়ে উত্তম ভাষা আর নেই পৃথিবীতে।
কিন্তু তাতেও আমি ব্যর্থ হলাম মা। বিধাতাকে তার অমোঘ বিধান থেকে এতটুকু টলাতে পারলাম না। আমার মনের ব্যথাগুলোকে অঝোর কান্নায় ঝরিয়ে তিনি তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।
জানিনা মা, হয়তো আমার আরাধনায় কোন ত্র“টি ছিল। মাকে ধরে রাখার জন্য যতটুকু বিসর্জন দেয়া প্রয়োজন তাতে হয়তো আমার কমতি ছিল। তাই হারিয়ে ফেললাম তোমাকে মা। সেই সাথে হারিয়ে ফেললাম জগতের সমস্ত নির্মল সুখ ঐশ্বর্যকে। কিন্তু সেই সুখ ঐশ্বর্য যে এখনও আমাকে টানে মা! তাই বার বার মনে হয়, শুধু আর একটিবার যদি তোমাকে দেখতে পেতাম! আর একটিবার যদি তোমাকে মা বলে ডাকতে পারতাম! তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমার তৃষিত মনে প্রশান্তি ফিরে আসত।
মা, তুমি জানো। তোমার মুখের একটি কথা শুনতে পেলে আমি পৃথিবীর সমস্ত বাঁধা-বিপত্তি জয় করার সাহস খোঁজে পেতাম। কিন্তু মা, আমি খুব ভালো করেই জানি এ একেবারেই অসম্ভব। তবু পারিনা নিজকে সামলাতে। তোমাকে আর একটিবার দেখার আকাংখাই এখন আমার অন্তরের আরাধনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি টের পাই আমার ভিতর আর একটা আমি সব সময় এই আরাধনা করে যাচ্ছে। আর আমার বাইরের উপলব্ধিতে তা প্রকাশ পাচ্ছে অন্য রকমভাবে। পাল্টে গেছে আমার আরাধনার ভাষা। আগের সেই গানের স্থলে অন্য একটি গানের প্রথম দুটি লাইন এখন সব সময় আমার মনে বাজে।
‘কতদিন দেখিনা তোমায়
বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি!’
জানিনা এই গানটির গীতিকার কার কথা মনে করেছিলেন গানটি লেখার সময়।
কিংবা গানটি গাওয়ার সময় গায়কের কারও কথা মনে পড়েছিল কি না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয় এই গানটি কোন হারিয়ে যাওয়া মায়ের উদ্দেশ্যে তার সন্তানের লেখা। যে মা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে, যে মাকে হারিয়ে সেই সন্তান বুকের ভিতর হাহাকারের গভীর ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে, সেই মায়ের উদ্দেশ্যে সন্তানের অন্তরের নিবেদন গানের এই দুটি লাইন ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা। মাগো, এই দুটি লাইন মনে পড়ার সাথে সাথে আমার বুকের ভিতরে দমিয়ে রাখা কান্নাগুলো বাঁধভাঙা স্রোতের ন্যায় চোখের পানিতে বেরিয়ে আসে।
মাগো, আমি বুঝে গেছি এ আমার সারা জীবনের কান্না।
আমি যতদিন বেঁচে থাকব তোমার উদ্দেশ্যে আমার অন্তরের আরাধনা হয়ে থাকবে এই দুটি লাইন। মাগো, তুমি জীবিত থাকতে তোমাকে নিয়ে বিধাতার দরবারে আমার অন্তরের আরাধনা প্রকাশ পেয়েছে ভিন্নভাবে। আজ তুমি নেই। বিধাতার দরবারে আমার একটাই আরজি। বড় সাধ জাগে মাকে আর একবার দেখতে।
কতদিন দেখিনা মাকে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।