এখন সবাই ঘুরে বেড়ায় , এটা ভালো...
পদ্মহেম ধাম আয়োজিত লালন শাঁই বটতলা মধুপূর্নিমা সাধুসঙ্গে আমি একবারই গেছি। প্রতি বছর সেখানে লালন উৎসব হয়। পুর্নিমারাতের সে উৎসব আমাকে আজীবন তাঁড়িয়ে বেড়াবে। প্রথম বার গিয়েই আমি মুগ্ধ। তারপর প্রতি বছর যাবো যাবো করেও আর যেতে পারিনি অথবা যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তবে সাধুসঙ্গে আমি না গেলেও দোসরপাড়া বেড়াতে সব সময় যাই। এখানকার মানুষ-জনের সাথে আমার দারুন সখ্যতা । কাজে অকাজে সেখানে যাই। যায়গাটা আমার খুব প্রিয়। সাধুসঙ্গে যেতে পারিনা , তবে দোসর পাড়া আমাকে খুব টানে!
প্রথমআলোর আলোক চিত্রী সাহাদাত পারভেজের চারুকলার দাদুকে নিয়ে ফটো প্রদর্শনির প্রথমদিন।
আমি অমার জন্য নির্ধরিত বক্তৃতা শেষ করে মোটর সাইকেল স্টার্ট দেই। একাই যাচ্ছিলাম , ইব্রাহীম নবীর ডাকে দাঁড়াতে হয়। সে আমার সাথে যাবে। আমি নবীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এই প্রথম আমি সিরাজ দিখান যাচ্ছি।
ঢাকার বাবু বাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর ওপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি হেলমেট পরে নিলাম। নবীর কষ্ট হচ্ছিলো হেডলাইটের আলোর টানে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকার দল ছুটে আসছিলো , আর নবীর চোখ মুখ কাঁমড়ে দিচ্ছিলো। কিচ্ছু করবার ছিলোনা। এ ভাবেই আমরা নিমতলী পেীঁছি।
এখানে আমাদের অগ্রবর্তী নুরুজ্জামান লাবুর কাছে,মোবাইলে পথ চিনে , পানি আর চা পান করে আবার শুরু করি আমাদের যাত্রা। এবার অন্ধকারে পথ চলা এভাবেই আমরা ইমামগঞ্জ বাজারে এসে আবার চায়ের ওপর ঝাঁপাই , তারপর আবার সেই অন্ধকার পথ শেষে সিরাজাদখান। সেখান থেকে ট্রলারে দোসরপাড়া টেকের হাঁট যা এখন লালন সাঁই বটতলা নামে বিখ্যাত। সে দিন লালন উৎসবে লালনের গান শুনে আর আড্ডা মেরে সে রাত শেষ করে ভোরে ফিরতি পথ ধরি। ঝিরি ঝিরি বাতাস আর কুয়াশা ভেজা সে সকালে ইছামতি নদী , টেকের হাঁট আর সিরাজদিখান কে আমি অনন্য রূপে পাই।
সেই রুপবতী ইছামতি আর দোসরপাড়ার প্রতি সেদিন যে টান তৈরী হলো , তা কেবল বেড়েছে । আমি বার বার ছুটে গেছি সেখানে। ঋতুভেদে আমি নতুন রুপে , নতুন ভাবে পেয়েছি ইছামতি টেকের হাঁট আর দোসর পাড়াকে। আজ বলবো আমার প্রানের মাঝে লুকিয়ে থ্াকা সে সব গল্পের একদিনের কথা।
পঁচিশ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন।
এই নিয়ে আমার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা কিন্তু শুভমিতার ছিলো। সকালে সে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দুইটা ফতুয়া আর পাঞ্জাবি একখান হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত তৈরী হতে বলে নিজে রানাœ্ ঘরের দিকে ছুট দিলো। আমি চুপ মেরে কিছু সময় বসে থেকে নিজেও তৈরীতে ব্যাস্ত হলাম। কিছুন পর যখন তাকে পেলাম , তখন তার হাতে বার্থডে কেক , নিজের বানানো! আমরা কেক কাটলাম , নাস্তা সারলাম তারপর বের হলাম। কই যাবো? শুভমিতার উত্তর সিরাজদিখান!
শীতের কুয়াশা ভেজা সকাল।
শরীরে সব রকম শীত প্রটেকশন নিয়ে আমরা রওনা হই। নিমতলী পেরিয়ে সবকিছু অসাধারন মনে হয়। বামে ইছামতি নদী আর ডান পাশে খাল। আর বিস্তির্ন ধান তে এখন শর্ষে তে। যেন হলুদ দুনিয়া।
চোখ ভরে যায় , মন ভরে যায়! নতুন পাঞ্জাবীতে আমি মডেল হই , শুভমিতা ছবি তোলে। ভীড় করে আসে গ্রামের লোকজন। আমরা তাদের দিকে ক্যামেরা কিক করে আবার মটর সাইকেল চালুকরি। এখানে বেশ কয়টি বেইলি সেতু পেছনে ফেলে আসি। তেমনি একটি বেইলি সেতুর বাম পাশে সাইনবোর্ডে লেখা - চোর মর্দন শ্মশান ঘাট , চোরমর্দন।
শ্মশান ঘাট দেখে আমার শ্মশান ঘাট নিয়ে একটি গল্প মনে পরে যায়। খাইরুল বাবুইর বিয়েতে তার বাড়ি সোনাগাজীর নবাব পুরে গেছি। সারা রাত গল্প আডডা , চলছে কার্ড খেলা। সাথে উঁচু ভলিয়্যুমে হিন্দি গান। বাড়িতে ফোন করা হয়নি , আমি মাকে ফোন করি ।
শব্দ দুষন আমাকে কথা বলতে দেয় না। আমি বাবুইর বাড়ি থেকে বের হই। পাশেই মেঠো পথ , সে পথ ধরে হাঁটি আর কথা বলি। দশ মিনিট পর আমি বাবুইর বাড়ি আসি। পরদিন দুপুরে আবার সে পথে যাই।
ল্য করি , আমি রাতে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটি একটি শ্মশান। কালই সম্ভবত কাউকে পোড়ানো হয়েছে , চারটি বাশেঁর কঞ্চি আর উপরে কলাপাতা দিয়ে ঘেরা। ভয়ে আমার গা শির শির করে ওঠে! ঠিক এখন এই লাইন লিখতে গিয়েও আমার শরীরের রোম খাড়া হয়ে গেল যেমন! অবশ্য চোর মর্দন শ্মশান ঘাট মনে হলো নামেই শ্মশান ঘাট। সম্ভবত সেটি পরিত্যাক্ত , আমরা চোরমর্দন ত্যাগ করে সামনে যাই। সামনেই দানিয়াপাড়া বাজার তারপর মা ফিলিং ষ্টেশন শেষে সিরাজ দিখান।
সিরাজ দিখান প্রবেশ মুখেই এক লাইনে অনেক গুলো স্ব-মিল। আমরা সিরাজ দিখান থানা থেকে সামনে গিয়ে বিপ্লবের হোটেলের সামনে মটর সাইকেল ষ্ট্যান্ড করি। এখানেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নদীর ঘাটে যাই। শীতকাল বলে ঘাটে নৌকা কম। মাঝিরা এখন অন্য কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।
আমরা কিছুন অপো করে একটি নৌকা পেয়ে যাই। মাঝি কামাল মিয়া। কামাল মিয়া টেকের হাটের দিকে নৌকা ছোটায়।
নদীতে প্রচুর কচুরি পানা । ছুট বললে আর নৌকা ছোটেনা।
লগি দিয়ে কচুরি সরিয়ে সরিয়ে নৌকা চলে। আমরা ছবি তুলি। বেদেদের এখন অবসর। পুরো নদী জুড়েই বেদের বহর। আমাদের ছবি তুলতে দেখে এক বেদে কন্যা বলে ওঠে , আমাদের ছবি তোলেন যে! শুভমিতা বলে , ছবি তুলে দিচ্ছি কিছু খাওয়ান! আপনেগো কী খাওয়ামু আমরা- বেদে কন্যার উত্তর।
শূভমিতা বলে , বাইন মাছ খাওয়ান। ’ না বাইন মাছ না। আসেন মুরগি রাইন্ধা খাওয়াই! আমরা তার সাহসের তারিফ করে মুচকি হেসে সামনে যাই। আমাদের পাশেই একটি নৌকায় একদল লোক টেঁটা হাতে নদীতে কী যেন খুঁচিয়ে চলেছেন। অন্য একটা নৌকা থেকে একলোক চিৎকার করে তাদের উদ্যেশ্যে বলে উঠলেন , ত্বরা টেডা পাড়া আমি আইতাছি।
বড় বাইন পাইলে দিবি। ’ এখানকার আকাশে পানকৌড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে। এরা পানিতে ডুবদিয়ে মাছ ধরে খায়। ঠান্ডা লাগলে বাশেঁর আগায় বসে রোদ পোহায়! পানকৌড়ির দৌঁড়-ঝাঁপে খুবই মজা পাই। এখানে মাছরাঙাও প্রচুর।
ছোট মাছরাঙা , লালচে মাছরাঙা , মাথাকালো মাছরাঙা এবং পাকড়া মাছরাঙাও চোখে পড়ে। সাথে ঘুঘু , বক ও ভুবন চিল। এখানে ইছামতি নদীতে কোসা নৌকা , জেলে নৌকা আর ঘাসি নৌকার চলাচল। পুরো নদীতেই মাছের ফাঁদপাতা। সারা বছরই নদীতে মাছ ধরা চলে।
ভেসাল , চাই , বেড়াজাল কী নাই এখানে। আমরা টেঙ্গুর পাড়া ,রাইসদিয়া অতিক্রম করি এবং কামাল মাঝির টানাটানিতে তাঁর বাড়িতে নামি। সড়ক পাড় আর নদীর পার মিলে তার বাড়িটি অসম্ভব সুন্দরের যোগসূত্র। ইচ্ছে হয় তাঁর বাড়িতে থেকে যাই। জমির দাম জিঙ্ঘেস করি।
তারপর অনেক জোড়া জোড়ির পর শুটকির সাথে শাক আর গরুর মাথার মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে আবার নৌকায় চড়ে বসি। তারপর সাপের চড় হয়ে টেকের হাঁট।
আগেই বলেছি আমার জন্মদিনের কথা। জন্মদিন পালন করতেই আমরা দোসর পাড়া টেকের হাঁট লালন সাঁই বটতলায় এসেছি। আমাদের সামনে এখন সেই বিখ্যাত বটতলা।
১৯৮৬সালে এখানে বাজার ছিলো , সে বাজারে তখন যাত্রা গানের আসর বসতো। ৮৮র বন্যায় বাজারটি ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানিয় কালাই চাঁন কড়ই গাছ থেকে বর্তমান বটগাছটি সংগ্রহ করে এখানে রোপন করেন। তিন-চারবার গাছটি ছাগল খেয়ে ফেলার উপক্রম করলে কালাই চাঁন গাছটি বর্তমান যায়গাতে রোপন করে তাতে বেড়া দিয়ে দেন। স্থানীয় এক মহিলা প্রতিদিন গাছটিতে পানি দেয়ার কাজও শুরু করে দেন।
বট গাছটি বেড়ে ওঠে এবং তাকে কেন্দ্র করে আবার এখানে বাজার গড়ে ওঠে। তারপর প্রথম আলোর আলোকচিত্রী কবির হোসেন ও তাঁর সঙ্গীত একাডেমী পদ্মহেম ধাম আর স্থানিয়দের প্রচেষ্টায় ২০০৪ সালে এখানে শুরু হয় লালন উৎসব। তারপর থেকে দোসর পাড়ার নাম মানুষের মুখে মুখে। বর্তমানে এখানে কানিজ আলমাস , উলফাৎ কাদের এবং তক্বীর হোসেনের আর্থিক সহায়তায় গড়ে উঠেছে একটি লালন সঙ্গীত বিদ্যালয়। এখানে শিশু-কিশোর সহ নবীন-প্রবীন সবার লালনের গান শিার সুযোগ রয়েছে।
আমরা লালন সঙ্গীত বিদ্যালয়টি ঘুড়ে দেখি তারপর গ্রাম দেখতে বের হই। আমাদের সাথে এখানে ডলি ও সায়ন্তনির পরিচয় হয়। ওদের সাথে নিয়ে আমরা পুরোটা গ্রাম ঘুরে-ঘুরে দেখি। কবির হোসেনের ভাই আমাদের তাদের বাসায় যেতে বলেন। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে যাই , এখানে একটি শর্ষে েেতর ছবি তুলি।
নতুন সেতুর সামনের এক চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে লালন শাঁই বট তলায় ফিরে আসি। হঠাৎ এক অদ্ভুত ইচ্ছা মনে জাগে , আমি শুভমিতাকে বলি , এসো ইছামতির জলে নামি। সে যেন আমার বলার অপেক্ষায় ছিলো। আমরা ইছামতির ঠান্ডা জলে গা ভেজাই। এমন ভেজার সুখ স্মৃতি আমার নাই , আমার সমস্ত আবেগ উপচে পরে ইছামতি নদীর কিনারে।
তখন আমি শুভমিতার সাথে গুনগুন না করে চিৎকার করে গেয়ে উঠি-
ভাঁজ খোল আনন্দ দেখাও
করি প্রেমের তরজমা
যে বাক্য অন্তরে ধরি
নাই দাঁড়ি তার নাই কমা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।