আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙ্কার



ব্রক্ষ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দ। লাকড়ির নৌকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে যাচ্ছে মকবুল। লাকড়ি বিক্রি করে বাড়ির জন্য চাল-ডাল কিনবে। 'এ ইদার আও। ' (এই এদিকে এসো)।

তীর থেকে এক পাকিস্থানী সৈন্য ডাক দিলো মকবুলকে। ভোর থেকে নৌকা বাইছে মকবুল। এখন দুপুর। ক্ষুধায় পেট চনচন করছে। নৌকা থামানোর একটুও ইচ্ছা নেই মকবুলের।

কিন্তু পাকিস্থানী আর্মি ডাক দিয়েছে। নৌকা না ভিড়িয়ে উপায় নেই। লাঙ্গলবন্দ ব্রীজের পাশে নৌকা ভিড়ালো মকবুল। দু' আর্মি উঁচু থেকে নেমে এলো নদীর পাড়ে। 'ইয়ে খড়ি লেকে উপর যাও।

' (এই লাকড়ি নিয়ে উপরে যাও। ) 'সাহেব আমার অনেক ক্ষিধা লাগছে। উপরে লাকড়ি নেওনের শক্তি নাই। অন্য কেউরে ডাক দেন না। ' আর্মিদের সাথে ছিলো এক রাজাকার।

সে বললো,'ওই স্যারের লগে বেতমিজি করছ। স্যারে যেটা কইছে হেইটা কর। ' আর্মি ক্যাম্প কাছে না। লাকড়ি নিয়ে যেতে হয় বেশ দূরে। কয়েকবার দিয়ে এসে হাফাতে লাগলো মকবুল।

মে মাসের গরমে ওর শরির খারাপ লাগছে। বৃষ্টি নেই বেশ কয়েকদিন হলো। রোদের তাপ কয়েকদিন ধরে বেশি। মকবুল নৌকায় বসে বড় বড় নি:শ্বাস নিতে লাগলো। 'এ কেয়া হুয়া?' (এই কি হয়েছে) 'স্যার আমার শইল খারাপ লাগতাছে।

অন্য কেউরে কন স্যার। ' 'সালা হারাম খোর' বলেই সৈন্যটি গুলি করলো মাঝিকে। নৌকা থেকে মকবুলের শরিরটা পড়ে গেলো নৌকার পাশে নদীতে। লাল হয়ে গেলো নদীর পানি। খ পরদিন সকাল।

লাঙ্গলবন্দ বাজারে বসে চা খাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা খসরু, বাবুল, হাতেম। তিনজনেরই মন খারাপ। পাকিস্থানী আর্মিরা এলাকায় বেশ অত্যাচার চালাচ্ছে। সঙ্গ দিচ্ছে এলাকার মারোয়ারী পাটকল শ্রমিকরা। গতকালও আর্মিরা এক মাঝিকে হত্যা করেছে।

প্রতিশোধ নেয়া দরকার। একটা পাল্টা হামলা না হলে এদের দমানো যাবে না। চায়ের দোকান থেকে অল্প দূরে একটা পুরনো মন্দির। মন্দিরটার পাশে দাড়িয়ে আছে একটা চিকন লোক। বয়সে যুবক।

কিন্তু দাড়ি বৃদ্ধদের মতো লম্বা। যুবকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কাল রাতেও কি লোকটাকে দেখেছে? মনে হচ্ছে দেখেছে। এখন লুঙ্গি পাঞ্জাবী পড়েছে। রাতে লুঙ্গি আর শার্ট পড়া ছিলো।

ওদের অনুসরন করছে নাতো? চায়ের কাপ রেখে খসরু আস্তে উঠে দাড়ালো। অল্প অল্প করে লোকটার দিকে এগুলো। ও ভেবেছিলো লোকটা পালাবে। কিন্তু লোকটাও এগিয়ে এলো। লোকটা এগিয়ে আসার সাথে সাথেই খসরু লুঙ্গিতে গোজা রিভলবারটা শার্টে ঢেকেই ওর দিকে তাক করলো।

'ওই তর নাম কি?' 'বাই আমার নাম লোকমান। আপনের লগে কতা আছে। ' 'কি কতা? তুই আমারে ফলো করতাছস কে?' 'বাই কালকারথে আপনের লগে কতা কওনের চেষ্টা করতাছি। ডরে কইতে পারতাছি না। ' 'কি কতা? উল্টা-পাল্টা করলে একদম শেষ কইরা দিমু।

' লোকমান জানালো সে একজন রাজাকার। লাঙ্গলবন্দ ব্রীজ পাহাড়া দেয় তারা। ঢাকা থেকে চট্রগ্রামের সড়ক পথের যোগাযোগ টিকিয়ে রাখতে লাঙ্গলবন্দ ব্রীজ গুরুত্বপূর্ন। মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্রীজ উড়িয়ে দিতে পারে। এ আশঙ্কায় পাকিস্থানী আর্মিরা এখানে পাহাড়া বসিয়েছে।

ব্রীজের উত্তর পাশে মাটি খুড়ে বাঙ্কার তৈরী করেছে পাকিস্থানীরা। তবে সুবিধার কথা হলো বাঙ্কারে সাধারনত একজন আর্মি থাকে। মাঝে মধ্যে দু'তিনজন হয়। তাদের কাছে থাকে একটা করে এস এম জি আর এসেলার। পাহাড়ার বেশিরভাগ দায়িত্বই রাজাকারদের উপর।

আর রাজাকাররা যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলে যায় তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালালে সহজেই জয়ী হতে পারবে। লোকমান কথা দিলো রাজাকারদের পুরো গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করবে। শুধু একজন রাজাকার আর্মিদের পক্ষে ছিলো। সে গ্রামে গেছে আজ সকালে। 'ঠিক আছে আপনে এদিকেই থাকেন।

আপনেরে বিকালে জানাইতাছি। ' কসরু বললো। খসরু বাজার থেকে সড়ে গেলো তাদের গোপন আস্তানায়। খবরটি গিয়ে জানালো তাদের কমান্ডার শাহাবুদ্দিন খান সবুজকে। কমান্ডার শাহাবুদ্দিন অভিযানের সম্ভাব্যতা যাচাই করলেন।

একটা অভিযান চালানো দরকার। আজকে চালালে গতকালকের হত্যার একটা উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়। আর্মির কাছে একটা মেসেজ পাঠানো হয়। দুপুরে ছোট একটি দলকে লাঙ্গলবন্দ ব্রীজের আশেপাশে র্যাকি করতে পাঠানো হলো। তারা আসার পর শুরু হলো অভিযানের প্রস্তুতি।

সন্ধায় অভিযান হবে। কিন্তু দলের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না কমান্ডার শাহাবুদ্দিন। বাঙ্কারে হামলা চালাতে আরো কিছু অস্ত্র দরকার। হঠাৎ যদি আর্মির কোন টহল দল এসে পড়ে তবে প্রোটেকশন প্রয়োজন হবে। বিকেলে নিজেদের গোপন আস্তানা থেকে অল্প দূরে একটি দোকানে বসেছিলো খসরু।

এসময় তাকে সালাম দিলো এক যুবক। 'বাই স্লামালাইকুম। ' 'ওলাইকুম আসসালাম। ' 'বাই আমার নাম ইদ্রিস। ইসমাইল গ্রুপের।

' ইদ্রিস তার গোপন কোড বললো। কোড শুনে খসরু নিশ্চিত হলো ইদ্রিস মুক্তিযোদ্ধা। 'ও ইসমাইল গ্রুপের। বন। কয়টা অইলো?' 'না বেশি অয় নাই।

খবর কম পাইতাছি। আপনের তো যোগাযোগ বালা। আমাগো লগে লইয়েন। ' 'লগে?' খসরু কিছুক্ষন চুপ থেকে চিন্তা করলো। তারপর বললো, 'আজকা সন্ধায় যাইতে পারবেন?' 'পারমু।

' 'দলে কয়জন?' 'দশ-বারোজন। ' 'সন্ধায় আয়েন বুঝাইয়া দিমু। ' দুই গ্রুপে মিলে চবি্বশজন। চবি্বশজন চার গ্রুপে ভাগ হয়ে সন্ধায় প্রথমে ঘিরে ফেললো বাঙ্কার। এর বাইরে রয়েছে রাজাকাররাও।

আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিলো খসরু-ই প্রথমে গুলি করবে। খসরু বাঙ্কারের এমন জায়গা লক্ষ করে গুলি করলো যাতে গুলি বাঙ্কারে থাকা সৈন্যের শরিরে লাগে। প্রথম গুলির পরেই বাঙ্কার থেকে চিৎকার শোনা গেলো। এরপর বাঙ্কার ঘিরে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকাররাও বাঙ্কারে গুলি করতে লাগলো। পাল্টা গুলি চললো বাঙ্কার থেকেও।

কিন্তু সেখান থেকে গুলিবর্ষন কিছুক্ষন পরই বন্ধ হয়ে গেলো। পনেরো-বিশ মিনিট চললো মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষন। বিশ মিনিট পরে গুলি করা বন্ধ হলো কমান্ডারের নির্দেশে। সতর্কতার সাথে বাঙ্কার খোলা হলো। ভেতরে পরে আছে দুই আর্মির লাশ।

তাদের গোলা-বারুদ সব নিয়ে নিলো খসরুদের গ্রুপ। দেখতে দেখতে কোত্থেকে অনেক মানুষ জড়ো হলো। তারা জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তুললো চারিদিক। কিন্তু কমান্ডার শাহাবুদ্দিন সবাইকে সতর্ক করলো আর্মিদের পাল্টা হামলার ব্যাপারে। আশেপাশের গ্রামের লোকজনের নিরাপদ দূরত্বে সড়ে যাওয়া উচিৎ।

কারন পাকিস্থানী আর্মিরা প্রতিশোধ হিসেবে পাল্টা হামলা চালাতে পারে গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক পরে সেখানে এলো আর্মিরা। প্রচুর গুলিবর্ষন করলো পাশের গ্রামগুলিতে। তবে ভয়ে গ্রামগুলিতে নামলো না তারা। শুধু দূর থেকে গুলিবর্ষন করলো।

এ যুদ্ধে সহায়তা করা ঐ রাজাকারের পুরো গ্রুপটি পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। # *মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ খোরশেদ আলম খসরুর বক্তব্য অনুযায়ী সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। মোবাইল ফোন:০১৯১৩৩৯৮২২০ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আমার অন্য গল্পগুলি পড়তে ক্লিক করুন: Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।