আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশের মাটিতে ক'দিন: পর্ব ০২



সকাল এগারটা কুড়ির দিকে জার্মান সময়ে বিমান রওয়ানা দিয়ে বাহরাইন অভিমুখে। প্রায় ৮ ঘন্টার টানা যাত্রা। বাহরাইনে গিয়ে পৌঁছাবে সন্ধ্যা সাতটা কুড়িতে। সাধারণত: বিমান যাত্রায় মাঝপথটা বড্ডো বিরক্তিকর মনে হয়। হঠাৎ করে মনে হয়, সময় কাটছে না।

আমি চোখ বুঁজে সময় কাটাবার চেস্টা করি। তার মাঝে বিমানবালা এসে দুপুরের খাবার পরিবেশন করল। কোনকিছুই ভাল লাগছে না। মনটা কেমন যেন দোটানায় পড়ে আছে। একদিকে ভাবছি আমার স্ত্রী আর সন্তানরা ঠিক এখন কি করছে? স্কুলের পথে।

অন্যদিকে ভাবছি, বাবা কি করছে? হয়তো প্রহর গুণছেন। একমাত্র ছেলেকে কাছে ফিরে পাওয়ার আনন্দ কতো গভীর। সারাদিন শেষে আমার ছেলেমেয়েরা যখন প্রতিদিন দু বাহুতে আশ্রয় নেয়, তখন বাবা হওয়ার আনন্দটা গভীরভাবে বোধ করি। আর আমার বাবা যখন বছর শেষে তার ছেলেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য ফিরে পায়, তখন তার আনন্দ ও তৃপ্তি কতোটা গভীর ও বিশাল তা এখান থেকে একটু অনুভব করার চেস্টা করি। আজ আঠার বছর ধরে দেশের বাইরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুদূর আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার্থে যাত্রা দিয়ে শুরু হয় আমার প্রবাস জীবন। লেখা পড়া শেষে চাকরি নিয়ে এলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে আমার বাস আজ ষোল বছর ধরে। এর মাঝে সংসার জীবন শুরু করেছি। তিন সন্তানের জনক হয়েছি।

দেশের টানে অথবা আপনজনের টানে অন্তত তার ফাঁকেই প্রতি বছর অথবা এক বছর পর পর দেশে ছুটে এসেছি ছুটি কাটাতে। যতোবারই দেশে এসেছি, দেখেছি দেশ একটু বদলে গেছে। নিজের পাড়া, মহল্লা অথবা এই ঢাকা শহর যেখানে আমার জন্ম, আমার বেড়ে হওয়া তার সবটুকুই আস্তে আস্তে সরে গেছে আগের থেকে অনেকটুকু। চেনা মানুষকেও লাগে অচেনা। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি বদলেছি? হয়তোবা বদলেছি।

কিন্তু আমার বদলানোটা আমার নিজের কাছে অদৃশ্য ও অশ্পৃশ্য থাকে। তাই এখানকার পরিবর্তনটা খুব বেশী চোখে পড়ে যা অনেকটা পীড়াদায়ক। দেশের মানুষ দেশকে নিয়ে কতোটা ভাবে আমি জানি না। অবশ্যই ভাবে। না ভাবলে আমার এই চেনা শহর কিভাবে এতে তড়তড় করে লতানো গাছের মতো উপরের দিকে বেড়ে উঠল কিভাবে? আমার এই পাড়ার এক তলা দোতলা বাড়ীগুলো কোন এক যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ৬ থেকে ৭ তলা সুউচ্চ ও সুসজ্জিত ভবনে রুপান্তরিত হয়ে গর্বভরে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রতিবেশী এসব বাড়ীর মালিক যারা ছিল আমাদের আপনজন তারাও হারিয়ে গেছে বহুতল ফ্ল্যাটের আড়ালে। অনেকে চলে গেছে। তাই, এ শহরে এখন নিজেকে বড্ডো অচেনা লাগে। আমার বাড়ীর চারপাশের দু'চার মহল্লায় একজন বা দু'জন ছাড়া বাকীরা ইহজগত ত্যাগ করেছেন। নিজের বাবাও বার্ধক্যে ভুগছেন।

একদিন তাঁকেও বিদায় দিতে হবে। এটাই হচ্ছে সাইকেল অফ লাইফ। মনটার উপর বিষণ্ণতার ছায়া নেমে আসে। তার মাঝেও বাবার সাহচর্যের কথা ভাবতেই আনন্দে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠে। এই সাহচর্যের আনন্দটা শীতের সকালে নেমে আসা সূর্যের তাপ পোহানোর মতোই তৃপ্তিদায়ক মনে হতে থাকে।

বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তার মাঝে বিশাল নীল আকাশের মাঝে যেমন বিমানটা ছুটে চলছে ঠিক যে গতিতে ঠিক একই গতিতে তেমনি আমার মনটাও ইতস্তত: ছুটে বেড়াচ্ছে আমার স্মৃতির শহরে। দেশে গেলে একটা কথার মুখোমুখি হই প্রায়শ:ই: "দেশে ফিরছেন কবে"? এই সহজ প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ করেই নীরব ও শব্দহীন হয়ে পড়ি। কেন বিদেশে পড়ে আছি দেশের মায়া ছেড়ে? বিদেশে পড়ে থাকাতে হয়তো জনসংখ্যার ভারে ন্যুজ বাংলাদেশ থেকে একজন মানুষ কমেছে। পনেরো কোটি মানুষ পঞ্চান্ন হাজার মাইল জুড়ে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জনাকীর্ণ জনপদ।

জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে ম্যালথুসীয় তত্ত্ব পড়েছি, আর এখন সেই তত্ত্বকে নিজের দিব্যচোখে প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু দেশে ফিরে আসার আরেকটি উত্তর আছে যা দেশের আপনজনকে কখনই দেয়া যায় না। বিদেশে একবার আমার এক অধ্যাপক বলেছিলেন: "দেশে কি তোমার ক্লাশের সেরা ছিলে"? আমি সবিনয়ে উত্তর দিলাম: "না, দেশে আমি সেরা ছিলাম না"। সেরারা বিদেশে আসবে কেন? যারা দেশে সুবিধে করতে পারেনি তারাই তো বিদেশের দিকে পাড়ি জমায়। আমরা প্রবাসীরা হচ্ছি দেশের উদ্বৃত্ত অথবা উচ্ছিস্ট জনগোষ্ঠী যারা দেশের কাজে লাগতে পারিনি, তাই বিদেশের মাটি খামচে পড়ে আছি।

ভাবতে ভাবতে বিমান কখন যে বাহরাইনের কাছে চলে এসেছে তা টের করতে পারিনি। সবাই লাইন ধরে নেমেই টার্মিনালের ঢোকার পর পরই ট্রানজিট লাইনে সিকিউরিটি চেকের জন্য অপেক্ষমান। এখানে এসেই ঠাহর করতে পেলাম দেশের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। অপ্রশস্ত একটি হলওয়েতে ঠাসাঠাসি করে বেশ ক'শত যাত্রী সিকিউরিটি চেকের জন্য অপেক্ষা করছে। বাহরাইনী মহিলা নিরাপত্তা কর্মী দাঁড়িয়ে লাইনকে এগিয়ে দিচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে কথা বলছে।

কাজের ডিউটিতে শত শত অপেক্ষমান যাত্রীর সামনে কথা বলার এই ধারাটা বড্ডো অশোভনীয় তা তারা ঠিক বুঝতে পারে কি না জানি না। চেহারায় বিরক্তি ও রুক্ষ্মতার ছাপ। আহা, এই আয়েশী জীবনে এদের কেন যে কাজ করতে আসা সেটাই আমার প্রশ্ন। পেছন দিক থেকে ভারতীয় অথবা পাকী একজন বিমানবন্দর কর্মী আমাদেরকে হিন্দী বা উর্দুতে কিছু বলে সামনের দিকে ঠেলছে। নিজেকে এখানে এসে খুব লাগেজ লাগেজ বলে মনে হচ্ছিল।

এখানেও বিমানের ঢাকা ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা তেমন একটা দীর্ঘ নয়। আমি টার্মিনালের ভেতর পদচারি করছি। আমেরিকান ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ড সহ উপচে পড়া আলোয় আলোকিত বিপণী বিতানগুলোর মধ্যে ক্রেতারা ভীঁড় জমিয়ে কেনাকাটা করছে। আমি ঢাকাগামী ফ্লাইটের গেইটের কাছাকাছি আসতে দেখলাম বাঙ্গালী যাত্রীরা লাইন করে দাঁড়ানোর চেস্টা করছে। অকারণেই একটা চাপাচাপি আর ধাক্কাধাক্কি।

আমি সবার পেছনে এসে দাঁড়াই। লাইন শুরু হতেই এই হুড়োহুড়ি দেখলাম। এখানে ভাবটা এরকম যে, আগে না গেলে বিমানে সীট পাওয়া যাবে না। এখানেও বিমানবন্দরের একজন কর্মী বকাঝকা করছে। একটু শৃংখলা আনার চেস্টা করছে।

লাইন থেকে বোর্ডি কার্ড চেক করতে গিয়ে প্রায় ২/৩ জনকে বিদায় করা হলো যাদের ফ্লাইট পরের দিন তারা আগের দিন সন্ধ্যায় চলে এসেছে। এটা ইচ্ছাকৃত ভুল, না একটু ধান্ধা করে আগে আগে দেশের পথে পাড়ি জমানোর চেস্টা তা বুঝতে পারিনি। যাদের ঘামে ঝরা আয়ে বিদেশী রেমিটেন্স আসছে তাদের প্রতি উপেক্ষা ও নিগৃহটা বেশ লক্ষণীয়। যদি তাই না হতো তাহলে বাংলাদেশী শ্রমিক যাত্রীদের জন্য বাংলায় কোন ঘোষণা নেই কেন? যে বিমানভর্তি শুধু বাংলাদেশী যাত্রী তারা কি আরেকটু মানবিক ট্রিটমেন্ট আশা করতে পারে না? বিমানযাত্রার নিয়মাবলী নিয়ে কিছু প্রচারপত্রতো বাংলায় করা যেত। সেই উদ্যোগ নেবেটা কে? বিদেশী এয়ারলাইনস, বিদেশে আমাদের দূতাবাস, প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয়? মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকাগামী সকল বিমানের চেহারা একেবারেই অভিন্ন।

যাত্রীদের হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কি দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। মনে হয় ব্যায়ামের আগে যেমন ওয়ার্ম আপ করতে হয়, দেশে যাওয়ার আগে তেমনি এরকম দৈহিক কসরতের একটা অলিখিত মহড়া করে নিতে হয়। বিমানের ক্রুরাও এদের অনেকের সাথে অসদাচরণ করে। কারণটা অজানা নয়। এরাও বিরক্ত।

বাথরুমে সিগারেট খেয়ে এলার্ম বাজানো একটা নিয়মিত সমস্যা। আজকের ফ্লাইটেও তাই দেখলাম। বাথরুমগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। ফ্লাইটে কয়েকজন যারা বীয়ার চেয়ে বিমানবালাদের বিরক্ত করছিল তাদেরকে বলা হলো, "নো বীয়ার"। পুরো দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করে যতোটা খারাপ লাগছিল, তার চেয়েও বেশী লাগছিল কস্ট।

রাতের আকাশে বিমান চলছে। একটু চোখ বন্ধ করার চেস্টা করছি। এমন সময় একজনের চীৎকারে চোখ খুলে দেখি, একজন যাত্রী পাশের জনকে বেশ জোরেই ঝাঁকুনি দিয়েছে, কারণ সে খুব জোরে নাক ডাকছিল। ঘুমন্ত যাত্রীটি ঘুম ভাঙ্গার কস্টে পাশের যাত্রীর প্রতি বিক্ষুদ্ধ, বলতে গেলে মারমুখো হয়ে উঠেছে। (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.